প্রথম পর্যায়ের লেখা এই পর্যন্তই। তারিখ দেয়া আছে। সময় লেখা – রাত দুটা পনেরো। সময়ের নিচে লেখা – একটানা অনেকক্ষণ লিখলাম। ঘুম পাচ্ছে। এখন ঘুমুতে যাব। মা আমার বিছানায় এসে শুয়েছেন। আজ সারাদিন হাঁপানিতে কষ্ট পেয়েছেন। এখন সম্ভবত হাঁপানিটা কমেছে। আরাম করে ঘুমুচ্ছেন। আজ সারাদিন মা’র নামাজ কাজা হয়েছে। ঘুম ভাঙলে কাজ নামাজ শুরু করবেন। রাত পার করে দেবেন নামাজে। কাজেই মা’র ঘুম না ভাঙ্গিয়ে খুব সাবধানে বিছানায় যেতে হবে।
মিসির আলি তাঁর নোটবই বের করে পয়েন্ট নোট করতে বসলেন। পয়েন্ট একটিই – মেয়ের মা’র চরিত্রে যে- অস্বাভাবিকতা আছে তা মেয়ের মধ্যেও চলে এসেছে। মেয়ে নিজে তা জানে না। সে নিজেকে যতটা স্বাভাবিক ভাবছে তত স্বাভাবিক সে নয়। একটি স্বাভাবিক মেয়ে তার মৃত বাবার জন্যে অনেক বেশি ব্যস্ততা দেখাত। এত বড় একটি লেখার কোথাও সে বাবার নাম উল্লেখ করেনি। এমন না যে বাবার নাম তার অজানা। মা’র সম্পর্কে রূপবতী শব্দটি সে ব্যবহার করেছে – বাবা সম্পর্কে কিছুই বলেনি। তার মা এত বড় একটা কাণ্ড করার পরেও মা’র কষ্টটাই তার কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে সে মা’র কাছ থেকে আলাদা করতে পারছে না। এর ফলাফল সাধারণত শুভ হয় না। এত বড় ঘটনার পরেও যে মা’র কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারছে না সে আর কোনোদিনও পারবে না।
মিসির আলি রূপার খাতার পাতা ওল্টালেন।
অনীশ – ০৬
এসএসসিতে আমার এত ভাল রেজাল্ট হবে আমি কল্পনাও করিনি। আমাদের ক্লাসের অন্যসব মেয়ের প্রাইভেট টিউটর ছিল, আমার ছিল না। মা’র পছন্দ নয়। মা’র ধারণা অল্পবয়স্ক প্রাইভেট মাস্টাররা ছাত্রীর সাথে প্রেম করার চেষ্টা করে, বয়স্করা নানান কৌশলে গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে। কাজেই যা পরলাম, নিজে নিজে পরলাম।
রেজাল্ট হবার পর বিস্ময়ে হকচকিয়ে গেলাম। কী আশ্চর্য কাণ্ড, ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফিফথ। পাঁচটা বিষয়ে লেটার।
আমি বললাম, তুমি কি খুশি হয়েছ মা?
মা যন্ত্রের মত বললেন, হু ।
‘খুব খুশি না অল্প খুশি?’
‘খুব খুশি।’
‘আমাদের সঙ্গে যে-মেয়েটা ফোর্থ হয়েছে সে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাচ্ছে। তুমি কি আমাকে শান্তিনিকেতনে পড়তে দেবে?’
মা আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, দেব।
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ সত্যি। কীভাবে যেতে হয়, টাকাপয়সা কত লাগে খোঁজখবর আন।’
‘তুমি সত্যি সত্যি বলছ তো মা?’
‘বললাম তো হ্যাঁ।’
‘আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘বিশ্বাস না হবার কী আছে? এই দেশে কি আর পড়াশোনা আছে? টাকা থাকলে তোকে বিলেতে রেখে পড়াতাম।’
আমার আনন্দের সীমা রইল না। ছোটাছুটি করে কাগজপত্র জোগাড় করলাম। অনেক যন্ত্রণা। সরকারি অনুমতি লাগে। আরো কী কী সব যন্ত্রণা। সব করলেন রুমার বাবা। রুমা হচ্ছে সেই মেয়ে যে ফোর্থ হয়েছে। রুমার বাবা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এডিশনাল সেক্রেটারি। তিনি যে শুধু ব্যবস্থা করে দিলেন তা-ই না, আমাদের দুজনের জন্যে দুটো স্কলারশিপেরও ব্যবস্থা করে দিলেন। পাসপোর্ট ভিসা সব উনি করলেন। বাংলাদেশ বিমানে যাব, ভোর ৯টায় ফ্লাইট। উত্তেজনায় আমি রাতে ঘুমুতে পারলাম না। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে সারারাতই ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। খানিকক্ষণ কাঁদেন, তারপর বলেন, ও বুড়ি, তুই কি পারবি আমাকে ছেড়ে থাকতে?
‘কষ্ট হবে, তবে পারব। তুমিও পারবে।’
‘না, আমি পারব না।’
‘যখন খুব কষ্ট হবে তখন কলকাতা চলে যাবে। কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন দেড় ঘণ্টা লাগে ট্রেনে। শান্তিনিকেতনে অতিথিভবন আছে, সেখানে উঠবে। আমার যখন খারাপ লাগবে, আমিও তা-ই করব, হুট করে ঢাকায় চলে আসব।’
‘তুই বদলে যাচ্ছিস।’
‘আমি আগের মতোই আছি মা। সারাজীবন এইরকমই থাকব।’
‘না, তুই বদলাবি। তুই ভয়ংকর রকম বদলে জাবি। আমি বুঝতে পারছি।’
‘তোমার যদি বেশিরকম খারাপ লাগে তা হলে আমি শান্তিনিকেতনে যাবার আইডিয়া বাদ দেব।’
‘বাদ দিতে হবে না। তোর এত শখ, তুই যা।’
‘মা শোন, যাবার পর যদি দেখি খুব খারাপ লাগছে তা হলে চলে আসব।’
খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙল। দেখি মা বিছানায় নেই। দরজা খুলতে গিয়ে দেখি বাইরে থেকে তালাবন্ধ। আমি আগেরবারের মত হৈচৈ চেঁচামেচি করলাম না, কাঁদলাম না, চুপ করে রইলাম। তালাবন্ধ রইলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যাবেলা মা নিচুগলায় বললেন, ভাত খেতে আয় বুড়ি। ভাত দিয়েছি।
আমি শান্তমুখে ভাত খেতে বসলাম। এমন ভাব করলাম যেন কিছুই হয়নি। মা বললেন, ডালটা কি টক হয়ে গেছে? সকালে রান্না করেছিলাম, দুপুরে জ্বাল দিতে ভুলে গেচি। আমি বললাম, টক হয়নি। ডাল খেতে ভাল হয়েছে মা।
‘ভাত খাবার পর কি চা খাবি? চা বানাব?’
‘বানাও।’
আমি চা খেলাম খবরের কাগজ পড়লাম। ছাদে হাঁটতে গেলাম। মা যখন এশার নামাজ পড়তে জায়নামাজে দাঁড়ালেন তখন আমি এক অসীম সাহসী কাণ্ড করে বসলাম। বাড়ি থেকে পালালাম। রাত ন’টায় উপস্থিত হলাম এষার বাসায়। এষা আমার বান্ধবী। এষার বাবা-মা খুবই অবাক হলেন। তাঁরা তক্ষুনি আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে চান। অনেক কষ্টে তাঁদের আটকালাম। একরাত তার বাসায় থেকে ভোরবেলা চলে গেলাম রুবিনাদের বাড়ি। রুবিনাকে বললাম, আমি দুদিন তোদের বাড়িতে থাকব। তোর কি অসুবিধা হবে? আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি।
রুবিনা চোখ কপালে তুলে ফেলল। আমি বললাম, তুই তোর বাবা-মাকে কিছু একটা বল যাতে তাঁরা সন্দেহ না করেন যে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি।
রুবিনাদের বাড়িতে দুদিনের জায়গায় আমি চারদিন কাটিয়ে পঞ্চমদিনের দিন মা’র কাছে ফিরে যাওয়া স্থির করলাম। বাড়ি পৌঁছলাম সন্ধ্যায়। মা আমাকে দেখলেন, কিছুই বললেন না। এরকমভাবে তাকালেন যেন কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছি। আমি চাপাগলায় বললাম, কেমন আছ মা?
মা বললেন, ভাল।
‘তুমি মনে হয় আমার উপর ভয়ংকর রাগ করেছ। কী শাস্তি দিতে চাও দাও। আমি ভয়ংকর অন্যায় করেছি। শাস্তি আমার প্রাপ্য।’
মা কিছু বললেন না। রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। আমি লক্ষ করলাম, বসার ঘরে অল্প-বয়েসি একটি ছেলে বসে আছে। কঠিন ধরনের চেহারা। রোগা, গলাটা হাঁসের মতো অনেকখানি লম্বা। মাথার চুল তেলে জবজব করছে। সে খবরের কাগজ পড়ছিল। আমাকে একনজর দেখে আবার খবরের কাগজ পড়তে লাগল।
আমি মাকে গিয়ে বললাম, বসার ঘরে বসে আছে লোকটা কে?
‘ওর নাম জয়নাল। আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ফাইনাল ইয়ারে। এবছর পাশ করে বেরুবে।’
‘এখানে কী জন্যে?’
‘তুই চলে যাবার পর আমি খবর দিয়ে আনিয়েছি। একা থাকতাম। ভয়ভয় লাগত।’
‘আই অ্যাম সরি মা। এ রকম ভুল আর করব না। আমি চলে এসেছি, এখন তুমি ওঁকে চলে যেতে বলো।’
‘তুই আমার ঘরে আয় বুড়ি। তোর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’
আমি মা’র ঘরে গেলাম। মা দরজা বন্ধ করে দিলেন। মা’র দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম। এতক্ষণ লক্ষই করিনি এই পাঁচদিনে মা’র চেহারা, স্বাস্থ্য সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে একটা জীবন্ত কঙ্কাল। মা বললেন, তুই চলে যাবার পর থেকে আমি পানি ছাড়া আর কিছু খাইনি। এটা কি তোর বিশ্বাস হয়?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, হয়।
মা বললেন, দোকান থেকে ইঁদুর-মারা বিষ এনে আমি গ্লাসে গুলে রেখেছি – তোর সামনে খাব বলে। আমি যে তোর সামনে বিষ খেতে পারি এটা কি তোর বিশ্বাস হয়?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, হয়।
মা বললেন, এক শর্তে আমি বিষ খাব না। আমি যে-ছেলেটিকে বসিয়ে রেখেছি তাকে তুই বিয়ে করবি। এবং আজ রাতেই করবি। আমি কাজি ডাকিয়ে আনব।
আমি বললাম, এসব তুমি কী বলছ মা!
‘এই ছেলে খুব গরিব ঘরের ছেলে। ভাল ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। আমি তাকে ইন্টারমিডিয়েট থেকে পড়ার খরচ দিয়ে যাচ্ছি। তোর জন্যেই করছিলাম। এই ছেলে বিয়ের পর এ-বাড়িতে থাকবে, আমাদের দুজনকে দেখাশোনা করবে।
আমার মুখে কথা আটকে গেল। মাথা ঘুরছে। কী বলব কিছুই বুজতে পারছি না। মা বললেন, টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখ – গ্লাসে বিষ গোলা আছে। এখন মন ঠিক কর। তারপর আমাকে বল।