মিসির আলি তাকিয়ে আছেন।
দরজা ধরে যে-মহিলা দাঁড়িয়ে তার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হলেও তাকে দেখাচ্ছে বালিকার মতো। লম্বাটে মুখ, কাটা-কাটা চেহারা। অসম্ভব রূপবতী। সাধারণত রূপবতীরা মানুষকে আকর্ষণ করে না- একটু দূরে সরিয়ে রাখে। এই মেয়েটির মধ্যে আকর্ষণী-ক্ষমতা প্রবল। মিসির আলি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটি বলল, ‘আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’
‘না।’
‘সে কী, চেনা উচিত ছিল তো! আপনি সিনেমা দেখেন না নিশ্চয়ই?’
‘না।’
‘টিভি? টিভিও দেখেন না? টিভি দেখলেও তো আমাকে চেনার কথা!’
‘আমার টিভি নেই। বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়ে অবশ্যি মাঝে মাঝে দেখি। আপনি কি কোনো অভিনেত্রী?’
‘হ্যাঁ। এলেবেলে টাইপ অভিনেত্রী নই। খুব নামকরা। রাস্তায় বের হলে “ট্রাফিক জ্যাম” হয়ে যাবে।’
মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গিতে মিসির আলি হেসে ফেললেন। মেয়েটিও হাসল। অভিনেত্রীর মাপা হাসি নয়। অন্তরঙ্গ হাসি। সহজ-সরল হাসি।
‘আপনি কিন্তু এখনও আমার নাম জিজ্ঞেস করেননি।’
‘কী নাম?’
‘আসমানি । এটা আমার আসল নাম। সিনেমার জন্যে আমার ভিন্ন নাম আছে। সেই নাম আপনার জানার দরকার নেই। ভেতরে আসব?’
‘আসুন।’
মেয়েটি ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল। গলার স্বর খানিকটা গম্ভীর করে বলল, ‘শুনলাম আপনি নাকি কুসংস্কার সহ্য করতে পারেন না।’
‘ঠিকই শুনেছেন। সহ্য করি না এবং প্রশ্রয় দিই না।’
কুসংস্কার টুসংস্কার কিছু না। আপনি আপনার ঘরটা আমাকে ছেড়ে দিন। আমার এই কেবিন খুব পছন্দ। আমি আপনার কাছে হাতজোড় করছি। প্লীজ!’
মেয়েটি সত্যি সত্যি হাতজোড় করল। মিসির আলি লজ্জায় পড়ে গেলন। একী কাণ্ড!
‘আমি এক্ষুনি ছেড়ে দিচ্ছি। হাতজোড় করতে হবে না।’
‘থ্যাংকস!’
‘থ্যাংকস বলারও প্রয়োজন নেই, তবে আমার ধারণা এই কেবিনটিতেও শেষ পর্যন্ত আপনি থাকতে রাজি হবেন না।’
‘এরকম মনে হবার কারণ কী?’
‘আপনি রাতে যখন ঘুমুতে যাবেন তখন হঠাৎ করে দেয়ালের একটা লেখা আপনার চোখে পড়বে – সবুজ মার্কারে কাঁচা কাঁচা হাতে লেখা –
এই ঘরে যে থাকবে
সে মারা যাবে।
ইহা সত্য, মিথ্যা নয়।
লেখা পড়েই আপনি আঁতকে উঠবেন। যেহেতু আপনার মন খুব দুর্বল সেহেতু আপনি আর এখানে থাকবেন না।’
আসমানি বলল, ‘কোথায় লেখাটা দেখি?’
তিনি লেখাটা দেখালেন। আসমানি বলল, কে লিখেছে?’
মিসির আলি থেমে থেমে বললেন, ‘যে লিখেছে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, তবে আমি অনুমান করতে পারি, একটি বাচ্চা মেয়ের লেখা। মেয়েটির উচ্চতা চারফুট দুইঞ্চি। এবং মেয়েটি এই ঘরেই মারা গেছে।’
আসমানি ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এসব আপনার অনুমান?’
‘জি, অনুমান। তবে যুক্তিনির্ভর অনুমান।’
‘যুক্তিনির্ভর অনুমান মানে?’
‘এক এক করে বলি। এটা একটা মেয়ের লেখা তা অনুমান করছি দেয়ালে আঁকা কিছু ছবি দেখে। সবুজ মার্কারে আঁকা বেশকিছু ছবি আছে, সবই বেণি বাঁধা বালিকাদের ছবি। মেয়েরা একটা বয়স পর্যন্ত শুধু মেয়েদের ছবি আঁকে।’
‘তা-ই বুঝি?’
‘হ্যাঁ, তা-ই। মেয়েটির উচ্চতা আঁচ করেছি আরও সহজে। আমরা যখন দেয়ালে কিছু লিখি তখন লিখি চোখ বরাবর। মেয়েটি বিছানায় বসে বসে লিখেছে। সেখান থেকে তার উচ্চতা আঁচ করলাম।’
‘দাঁড়িয়েও তো লিখতে পারে। হয়তো মেঝেতে দাঁড়িয়ে লিখেছে।’
‘তা পারে। তবে মেয়েটি অসুস্থ। বিছানায় বসে বসে লেখাই তার জন্যে যুক্তিসঙ্গত।’
আসমানি গম্ভীর গলায় বলল, ‘মেয়েটি যে বেঁচে নেই তা কী করে অনুমান করলেন?’ কাউকে জিজ্ঞেস করেছেন?’
‘না, কাউকে জিজ্ঞেস করিনি। এটাও অনুমান। বাচ্চারা দেয়ালে লেখার ব্যাপারে খুবই পার্টিকুলার। যা বিশ্বাস করে তা-ই সে দেয়ালে লেখে। যদি বাচ্চাটি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যেত তা হলে অবধারিতভাবে এই লেখার জন্যে সে লজ্জিত বোধ করত, এবং হাসপাতাল ছেড়ে যাবার আগে লেখাটি নষ্ট করে যেত।’
‘আপনি কী করেন জানতে পারি?’
‘মাস্টারি করতাম, এখন করি না। পার্ট টাইম টিচার ছিলাম। অস্থায়ী পোস্ট। চাকরি চলে গেছে।’
‘আপনি আমাকে দেখে কি আমার সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন?’
‘একটা সামান্য কথা বলতে পারি – আপনার ডাকনাম আসমানি নয় – অন্যকিছু।’
‘এরকম মনে হবার কারণ কী?’
‘আসমানি নামটি আপনি এমনভাবে বললেন যাতে আমার কাছে মনে হল অচেনা একটি শব্দ বলছেন। তার চেয়েও বড় কথা আপনার পরনে আসমানি রঙের একটি শাড়ি। শাড়িটি পরার পর থেকেই হয়তো আসমানি নামটি আপনার মাথায় ঘুরছে। প্রথম সুযোগে এই নামটি বললেন।’
‘আমার ডাক নাম বুড়ি।’
মিসির আলি কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বুড়ি বলল, ‘আপনি অনুমানগুলি কীভাবে করেন?’
‘লজিক ব্যবহার করে করি। সামান্য লজিক। লজিক ব্যবহার করার ক্ষমতা সবার মধ্যেই আছে। বেশির ভাগ মানুষই তা ব্যবহার করে না। যেমন আপনি ব্যবহার করছেন না। ভেবে বসে আছেন চারশো নয় নম্বর ঘরটি আপনার জন্যে লাকি। এরকম ভাবার পেছনে কোন লজিক নেই।’
‘লজিকই কি এই পৃথিবীর শেষ কথা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে লজিকই হচ্ছে পৃথিবীর শেষ কথা। লজিকের বাইরে কিছু নেই? পৃথিবীর সমস্ত রহস্যের সমাধান আছে লজিকে, পারবেন বলতে?’
‘পারব।’
‘ভাল কথা। শুনে খুশি হলাম। আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?’
‘আমার নাম মিসির আলি। আপনি কি কাল ভোরে এই কেবিনে আসতে চান? না মত বদলেছেন?’
‘আমি কাল ভোরে চলে এসব। যাই মিসির আলি সাহেব। স্লামালিকুম।’
মেয়েটি নিজের কেবিনে ফিরে গেল। রাত দশটার ভেতর চারশো নয় নম্বর কেবিনে আগের রোগীর যাবতীয় তথ্য জোগাড় করল। এই কেবিনে ‘লাবণ্য’ নামের দশ বছর বয়েসি একটি মেয়ে থাকত। হার্টের ভাল্বের কী একটা জটিল সমস্যায় সে দীর্ঘদিন এই ঘরটিতে ছিল। মারা গেছে মাত্র দশদিন আগে। তার ওজন তেষট্টি পাউণ্ড। উচ্চতা চার ফুট এক ইঞ্চি।
মিসির আলি সাহেব সামান্য ভুল করেছেন? তিনি বলেছেন চার ফুট দুইঞ্চি। এইটুকু ভুল বোধহয় ক্ষমা করা যায়।
অনীশ – ০২
চারশো ন নম্বর কেবিনের ভোল পুরোপুরি পালটে গেছে। দেয়াল ঝকঝক করছে। কারণ প্লাস্টিক পেইন্ট করা হয়েছে। অ্যাটাচড বাথরুমের দরজায় ঝুলছে হালকা নীল পর্দা। বাথরুমের কমোডের ফ্ল্যাশ ঠিক করা হয়েছে। পানির ট্যাপও সরানো হয়েছে। মেঝেতে পানি জমে থাকত – এখন পানি নেই।
কেবিনের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বুড়ি বিছানায় শুয়ে শুয়ে গভীর মনযোগে খাতায় কীসব লিখছে। লেখার ব্যাপারটি যে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যাচ্ছে হাতের কাছে বাংলা অভিধান দেখে। সে মাঝেমাঝেই অভিধান দেখে নিচ্ছে। লেখার গতি খুব দ্রুত নয়। কিছুক্ষণ পর পরই খাতা নামিয়ে রেখে তাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম করতে দেখা যাচ্ছে। এই সময় টেবিল-ল্যাম্পটি সে নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিচ্ছে। টেবিল-ল্যাম্পটা খুব সুন্দর। একটিমাত্র ল্যাম্প ঘরের চেহারা পালটে দিয়েছে।
বুড়ি লিখছে –
গত পরশু মিসির আলি নামের একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। পরিচয় বলা ঠিক হচ্ছে না – কারণ আমি তাঁর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। তিনিও আমার সম্পর্কে কিছু জানেন না। মানুষটি বুদ্ধিমান, নিশ্চয়ই এটা চমৎকার একটা গুণ। কিন্তু তাঁর দোষ হচ্ছে তিনি একই সঙ্গে অহংকারী। অহংকার, বুদ্ধির কারণে, যেটা আমার ভাল লাগেনি। বুদ্ধির খেলা দেখিয়ে তিনি আমাকে অভিভূত করতে চেয়েছেন। কেউ আমাকে অভিভূত করতে চাইলে আমার ভাল লাগে না। রাগ হয়। বয়স হবার পর থেকেই দেখছি আমার চারপাশে যারা আসছে তারাই আমাকে অভিভূত করতে চাচ্ছে। এক-একবার আমার চেঁচিয়ে বলার ইচ্ছা হয়েছে – হাতজোড় করছি, আমাকে রেহাই দিন। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। পৃথিবীতে অসংখ্য মেয়ে আছে যাদের জন্মই হয়েছে অভিভূত হবার জন্যে। তাঁদের কাছে যান। তাদের অভিভূত করুন, হোয়াই মী?
এই কথাগুলি আমি মিসির আলি সাহেবকে বলতে পারলে সবচে’ খুশি হতাম- তাঁকে বলতে পারছি না। কারণ উনি আমাকে সত্যি সত্যি অভিভূত করেছেন। চমকে দিয়েছেন। ছোট বালিকারা যেমন ম্যাজিক দেখে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয় আমার বেলাতে তা-ই হয়েছে। আমি হয়েছি বাক্যহারা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার এই বিস্ময়কে তিনি মোটেই পাত্তা দিলেন না। ম্যাজিশিয়ানরা অন্যের বিস্ময় উপভোগ করে। তিনি করেননি।
সবুজ রঙের দেয়ালের লেখা প্রসঙ্গে যখন আমি যা জেনেছি তা তাঁকে বলতে গেলাম, তিনি কোনো আগ্রহ দেখালেন না। আমি যখন তাঁর বিছানার পাশের চেয়ারে বসলাম, তিনি শুকনো গলায় বললেন – কিছু বলতে এসেছেন?’
আমি বললাম, না। আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।
তিনি বললেন, ও । তাঁর চোখমুখ দেখেই মনে হল, তিনি বিরক্ত, মহাবিরক্ত। নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারছেন না। চেয়ারে বসেছি, চট করে উঠে যাওয়া ভাল দেখায় না। কাজেই মিসির আলি সাহেবের অসুখটা কী, কতদিন ধরে হাসপাতালে আছেন এই সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। তিনি নিতান্তই অনাগ্রহে জবাব দিলেন। আমি যখন বললাম, আচ্ছা তা হলে যাই? তিনি খুবই আনন্দিত হলেন বলে মনে হল। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আচ্ছা আচ্ছা। ‘আবার আসবেন’ এই সামান্য বাক্যটি বললেন না। এটা বলাটাই স্বাভাবিক ভদ্রতা।
তাঁর ঘর থেকে ফিরে আমার বেশ কিছু সময় মন-খারাপ রইল। আমার জন্যে এটাও একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। আমার এক ধরনের ডিফেন্স মেকানিজম আছে – অন্যের ব্যবহারে আমি কখনো আহত হই না – কারণ এসবকে আমি ছেলেবেলা থেকেই তুচ্ছ করতে শিখেছি।
মিসির আলি সাহেব আমার কিছু উপকার করেছেন, তাঁর নিজের কেবিন ছেড়ে দিয়েছেন। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাই বলে তিনি আমাকে অপমান করতে পারেন না। এই অধিকার তাঁর নেই। ঘণ্টা দুই আগে তিনি যা করলেন তা অপমান ছাড়া আর কি? উনি রেলিং ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি ব্লাড ম্যাচিং নাকি কী হাবিজাবি করে উপরে এসেছি। আমার পায়ের শব্দে তিনি তাকালেন। আমি বললাম, ভাল আছেন? তিনি কিছু বললেন না। তাকিয়েই রইলেন। আমি বললাম, চিনতে পারছেন তো? আমি বুড়ি । তিনি বললেন, ও আচ্ছা।
‘ও আচ্ছা’ কোনো বাক্য হয়? এত তাচ্ছিল্য করে কেউ কখনো আমাকে কিছু বলেনি। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার উচিত ছিল আর কোনো কথা না বলে নিজের কেবিনে চলে আসা। তা না করে আমি গায়ে পড়ে বললাম, আজ আপনার শরীরটা মনে হয় ভাল, হাঁটাহাঁটি করছেন। তাঁর উত্তরে তিনি আবারও বললেন – ও আচ্ছা ।
তার মানে হচ্ছে আমি কী বলছি তা নিয়ে তাঁর কোন মাথাব্যথা নেই। দায়সারা ‘ও আচ্ছা’ দিয়ে সমস্যা সমাধান করছেন। আমি তো তাঁকে বিরক্ত করার জন্যে কিছু বলিনি। আমি কাউকে বিরক্ত করার জন্যে কখনো কিছু করি না। উলটোটাই সব সময় হয়। লোকজন আমাকে বিরক্ত করে। ক্রমাগত বিরক্ত করে।
মিসির আলি নামের আপাতদৃষ্টিতে বুদ্ধিমান এই মানুষটি আমাকে অপমান করছেন। কে জানে হয়তো জেনেশুনেই করছেন। মানুষকে অপমান করার সূক্ষ্ম পদ্ধতি সবার জানা থাকে না, অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান মানুষরাই শুধু জানেন এবং অকারণে প্রয়োগ করেন। সে সুযোগ তাঁদের দেয়া উচিত না। আমি শীতল গলায় বললাম, মিসির আলি সাহেব!
উনি চমকে তাকালেন। আমি বললাম, ঠিক করে বলুন তো আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘চিনব না কেন?’
‘আমি যা-ই জিজ্ঞেস করছি আপনি বলছেন – “ও আচ্ছা” । এর কারণটা কি আপনি আমাকে বলবেন?’
‘আপনি কী বলছেন আমি মন দিয়ে শুনিনি। শোনার চেষ্টাও করিনি। মনে হয় সেজন্যেই “ও আচ্ছা” বলছি।’
‘কেন বলুন তো?’
‘আমি প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি। এই উপসর্গ নতুন হয়েছে, আগে ছিল না। আমি মাথাব্যথা ভুলে থাকার জন্যে নানান কিছু ভাবছি। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি।’
আমি বললাম, মাথাব্যথার সময় আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। কিছু মনে করবেন না।
আমি নিজের ঘরে চলে এলাম, কিন্তু ভদ্রলোকের মাথাব্যথার গল্প বিশ্বাস করলাম না। প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে এমন শান্ত ভঙ্গিতে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে না। এবং প্রচণ্ড মাথাব্যথায় এত সুন্দর যুক্তিভরা কথাও মনে আসে না। ভদ্রলোকের মানসিকতা কী তা মনে হয় আমি আঁচ করতে পারছি। কিছু-কিছু পুরুষ আছে যারা রূপবতী তরুণীদের অগ্রাহ্য করে একধরনের আনন্দ পায়। সচরাচর এরা নিঃসঙ্গ ধরনের পুরুষ হয়, এবং নারীসঙ্গের জন্যে বাসনা বুকে পুষে রাখে।
মিসির আলি সাহেব যে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ তা এই দুদিনে আমি বুঝে ফেলেছি। এই ভদ্রলোককে দেখতে কোনো আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব এখন পর্যন্ত আসেনি। আমাদের দেশে গুরুতর অসুস্থ একজনকে দেখতে কেউ আসবে না তা ভাবাই যায় না। একজন কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে তার আত্মীয়স্বজন আসে, বন্ধুবান্ধব আসে, পাড়া-প্রতিবেশী আসে, এমনকি গলির মোড়ের যে মুদি দোকানি সেও আসে-এটা একধরনের সামাজিক নিয়ম। মিসির আলির জন্যে কেউ আসছে না।
অবশ্যি আমাকে দেখতেও কেউ আসছে না । আমার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যায়। আমি কাউকেই কিছু জানাইনি। যারা জানে তাদের কঠিনভাবে বলা হয়েছে তারা যেন আমাকে দেখতে না আসে। তারা আসছে না, কারণ আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করলে তাদেরই সমস্যা।
আচ্ছা, আমি এই মানুষটিকে নিয়ে এত ভাবছি কেন? নিতান্ত অপরিচিত একজন মানুষকে নিয়ে এত চিন্তাভাবনা করার কোনো মানে হয়! আমি নিজে নিঃসঙ্গ বলেই কি একজন নিঃসঙ্গ মানুষের প্রতি মমতা বোধ করছি?
ভদ্রলোক আমার প্রতি অবহেলা দেখিয়েছেন আমি তাতে কষ্ট পাচ্ছি। আমরা অতি প্রিয়জনদের অবহেলাতেই কষ্ট পাই। কিন্তু এই ভদ্রলোক তো আমার অতিপ্রিয় কেউ নন। আমরা দুজন দুপ্রান্তের মানুষ। তাঁর জগৎ ভিন্ন, আমার জগৎ ভিন্ন। হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাবার পর আর কখনো হয়তো তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে না।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই হাসপাতালে যে-কটা দিন আছি সেই কটা দিন ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্পটল্প করলে আমার ভাল লাগবে। কারও সঙ্গেই কথা বলে আমি আরাম পাই না। যার সঙ্গেই কথা বলি আমার মনে হয় সে ঠিকমতো কথা বলছে না। ভান করছে। নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছে। যেন সে পৃথিবীর সবচে’ জ্ঞানী মানুষ। সে ধরেই নিচ্ছে তার কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে আমি মনেমনে তার সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা করছি, অথচ আমি যে মনেমনে অসংখ্যবার বলছি হাঁদারাম, হাঁদারাম, তুই হাঁদারাম, সেই ধারণাও তার নেই।
মিসির আলি নিশ্চয়ই সেরকম হবেন না। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিশ্চয়ই আমি কখনো মনেমনে বলব না – ‘হাঁদারাম’ । আমার নিজের একটি নিতান্তই ব্যক্তিগত গল্প আছে যা আমি খুব কম মানুষকেই বলেছি। এই গল্পটাও হয়তো আমি তাঁকে বলতে পারি। আমার এই গল্প আমি যাঁদেরকে বলেছি তাঁদের সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে শুনেছেন, তারপর বলেছেন – আপনার মানসিক সমস্যা আছে। ভাল কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান।
মানুষ এই এক নতুন জিনিশ শিখেছে, কিছু হলেই সাইকিয়াট্রিস্ট। মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। সাইকিয়াট্রিস্ট সেই এলোমেলো মাথা ঠিক করে দেবেন। মানুষের মাথা কি এমনই পলকা জিনিস যে সামান্য আঘাতেই এলোমেলো হয়ে যাবে? এই কথাটিও মিসির আলি সাহেবকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। ভদ্রলোক মাস্টার-মানুষ, কাজেই ছাত্রীর মতো ভঙ্গিতে খানিকটা ভয়ে ভয়ে যদি জিজ্ঞেস করা যায়- আচ্ছা স্যার, মানুষের মাথা এলোমেলো হবার জন্যে কত বড় মানসিক আঘাতের প্রয়োজন? তখন তিনি নিশ্চয়ই এই প্রশ্নের জবাব দেবেন। সে জবাবের গুরুত্ব থাকবে। কারণ মানুষটির ভেতর লজিকের অংশ বেশ শক্ত।
অনীশ – ০৩
বুড়ি বলল, ‘স্যার আসব?’
মিসির আলি বিছানায় কাত হয়ে বই পড়ছিলেন – বইটির নাম লেখক – ‘Mysteries of afterlife’ লেখক F. Smyth. মজার বই। মৃত্যুর পরের জগৎ সম্পর্কে এমনসব বর্ণনা আছে যা পড়লে মনে হয় লেখকসাহেব ঐ জগৎ ঘুরে এসেছেন। বেশ কিছুদিন সেখানে ছিলেন। ভালমতো সবকিছু দেখা। এজাতীয় লেখা হয়, ছাপা হয় এবং হাজার হাজার কপি বিক্রি হয় এটাই এক বিস্ময়।
তিনি বই বন্ধ করে বুড়ির দিকে তাকালেন। মেয়েটির সঙ্গে বেশ কয়েকবার তাঁর দেখা হয়েছে। মেয়েটির ভাবভঙ্গিতে মনে হয় তাঁর সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে সে এক ধরনের আগ্রহবোধ করছে। আগ্রহের কারণ স্পষ্ট নয়। তার কি কোনো সমস্যা আছে? থাকতে পারে।
মিসির আলি এই মুহূর্তে অন্যের সমস্যা নিয়ে ভাবতে চাচ্ছেন না। তাঁর নিজের সমস্যাই প্রবল। শারীর-সমস্যা। ডাক্তাররা অসুখের ধরন এখনও ধরতে পারছেন না। বলেছেন যকৃতের একটা অংশ কাজ করছে না। যকৃত মানুষের শরীরের বিশাল এক যন্ত্র। সেই যন্ত্রের অংশবিশেষ কাজ না করলেও অসুবিধা হবার কথা না। তা হলে অসুবিধা হচ্ছে কেন? মাথার যন্ত্রণাই – বা কেন হচ্ছে? টিউমার জাতীয় কিছু কি হয়ে গেল? টিউমার বড় হচ্ছে – মস্তিষ্কে চাপ দিচ্ছে। সেই চাপটা শুধু সন্ধার পর থেকে দিচ্ছে কেন?
বুড়ি আবার বলল, ‘স্যার, আমি কি আসব?’
মেয়েটির পরনে প্রথম দিনের আসমানি রঙের শাড়ি। হয়তো এই শাড়িটাই তাঁর ‘লাকি শাড়ি’। অপারেশন টেবিলে যাবার আগে সে বলবে – আমাকে এই লাকি শাড়িটা পরতে দিন। প্লীজ ডাক্তার, প্লীজ!
রাত আটটা প্রায় বাজে। এমন কিছু রাত নয়, তবু মিসির আলির ঘুম পাচ্ছে। কারও সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তিনি তার পরেও বললেন, ‘আপনার কি মাথাধরা আছে?’
‘এখন নেই। রোজই সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়। আজ এখনও কেন যে শুরু হচ্ছে না বুঝতে পারছি না।’
বুড়ি হাসতে হাসতে বলল, ‘মনে হচ্ছে মাথা না ধরায় আপনার মন খারাপ হয়ে গেছে। স্যার, আমি কি বসব?’
‘বসুন বসুন। আমাকে স্যার বলছেন কেন তা বুঝতে পারছি না।’
‘আপনি শিক্ষক-মানুষ এইজন্যেই স্যার বলছি। ভাল শিক্ষক দেখলেই ছাত্রী হতে ইচ্ছা করে।’
‘আমি ভাল শিক্ষক আপনাকে কে বলল?’
‘কেউ বলেনি। আমার মনে হচ্ছে। আপনি কথা বলার সময় খুব জোর দিয়ে বলেন। এমনভাবে বলেন যে যখন শুনি মনে হয় আপনি যা বলছেন তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন বলেই বলছেন। ভাল শিক্ষকের এটা হচ্ছে প্রথম শর্ত।’
‘দ্বিতীয় শর্ত কি?’
‘দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে জ্ঞান। ভাল শিক্ষকের প্রচুর জানতে হবে এবং ভালমতো জানতে হবে।’
‘আপনি নিজেও কিন্তু শিক্ষকের মতো কথা বলছেন।’
বুড়ি বলল, ‘আমার জীবনের ইচ্ছা কী ছিল জানেন? কিণ্ডারগার্ডেনের শিক্ষিকা হওয়া। ফ্রক-পরা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়াবে, আমি তাদের পড়াব, গান শেখাব। ব্যথা পেয়ে কাঁদলে আদর করব। অথচ আমি কী হয়েছি দেখুন – একজন অভিনেত্রী! আমার সমস্ত কর্মকাণ্ড বয়স্ক মানুষ নিয়ে। আমার জীবনে শিশুর কোনো স্থান নেই। স্যার, আমি কি বকবক করে আপনাকে বিরক্ত করছি?’
‘না, করছেন না।’
‘আপনি আমাকে তুমি করে ডাকলে আমি খুব খুশি হব। আপনি আমাকে তুমি করে ডাকবেন, এবং নাম ধরে ডাকবেন। প্লীজ!’
‘বুড়ি ডাকতে বলছ?’
‘হ্যাঁ, বুড়ি ডাকবেন। আমার ডাকনামটা বেশ অদ্ভুত না? যখন সত্যি সত্যি বুড়ি হব তখন বুড়ি বলে ডাকার কেউ থাকবে না।’
মিসির আলি বললেন, ‘তুমি কি সবসময় এমন গুছিয়ে কথা বল?’
‘আপনার কি ধারণা?’
‘আমার ধারণা তুমি কথা কম বল। যারা কথা বেশি বলে তারা গুছিয়ে কিছু বলতে পারে না। যারা কম কথা বলে তারা যখন বিশেষ কোনো কথা বলতে চায় তখন খুব গুছিয়ে বলতে পারে। আমার ধারণা তুমি আমাকে বিশেষ কিছু বলতে চাচ্ছ।’
‘আপনার ধারণা সত্যি নয়। আমি আপনাকে বিশেষ কিছু বলতে চাচ্ছি না। আগামীকাল আমার অপারেশন। ভয়ভয় লাগছে। ভয় কাটানোর জন্যে আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।’
‘ভয় কেটেছে?’
‘কাটেনি। তবে ভুলে আছি। আপনার এখান থেকে যাবার পর – গরম পানিতে গোসল করব। আয়াকে গরম পানি আনতে বলেছি। গোসলের পর কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব।’
মিসির আলি হাই তুললেন। মেয়েটির কথা এখন আর শুনতে ভাল লাগছে না। তাকে বলাও যাচ্ছে না – তুমি এখন যাও, আমার মাথা ধরেছে। মাথা সত্যি সত্যি ধরলে বলা যেত। মাথা ধরেনি।
‘আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন স্যার?’
মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, ‘গল্পটা বলো।’
‘কোন গল্পটা বলব?’
‘কেউ যখন জানতে চায়, আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন তখন তার মাথায় একটা ভূতের গল্প থাকে। ঐটা সে শোনাতে চায়। তুমিও চাচ্ছ।’
‘আপনি ভুল করেছেন। আমি আপনাকে কোনো গল্প শোনাতে চাচ্ছি না। কোনো ভৌতিক গল্প আমার জানা নেই।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আর একটা কথা, আপনি দয়া করে “ও আচ্ছা” বাক্যটা বলবেন না। এবং নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে করবেন না।’
‘বুড়ি, তুমি রেগে যাচ্ছ।’
‘আমাকে তুমি তুমি করেও বলবেন না।’
বুড়ি উঠে দাঁড়াল এবং প্রায় ঝড়ের বেগে ঘর ছেড়ে চলে গেল। মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর মনে হল প্রকৃতি শুধুমাত্র মেয়েদের মধ্যেই বিপরীত গুণাবলির দর্শনীয় সমাবেশ ঘটিয়েছে। মেয়েকে যেহেতু সবসময়ই সন্তানধারণ করতে হয় সেহেতু প্রকৃতি তাকে করল শান্ত, ধীর, স্থির। একই সঙ্গে ঠিক একই মাত্রায় তাকে করল অশান্ত, অধীর, অস্থির। প্রকৃতি সবসময়ই মজার খেলা খেলছে।
মিসির আলি বই খুললেন, মৃত্যুর পরের জগৎ সম্পর্কে স্মিথ সাহেবের বক্তব্য পড়া যাক।
‘স্থুল দেহের ভেতরেই লুকিয়ে আছে মানুষের সূক্ষ্ম দেহ। সেই দেহকে বলে বাইওপ্লাজমিক বডি। স্থুল দৃষ্টিতে সেই দেহ দেখা যায় না। স্থুল দেহের বিনাশ হলেই সূক্ষ্ম দেহ বা বাইওপ্লাজমিক বডি – স্থুল দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়। সূক্ষ্ম দেহ শক্তির মতো। শক্তির যেমন বিনাশ নেই – সূক্ষ্ম দেহেরও তেমন বিনাশ নেই। সূক্ষ্ম দেহের তরঙ্গ-ধর্ম আছে। তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য, স্থুল দেহের কামনা-বাসনার সঙ্গে সম্পর্কিত। যার কামনা-বাসনা বেশি তার তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য তত বেশি।’
মিসির আলি বই বন্ধ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। স্মিথ নামের এই লোক কিছু বৈজ্ঞানিক শব্দ ব্যবহার করে তাঁর গ্রন্থটি ভারিক্কি করার চেষ্টা করেছেন। নিজের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছেন পাঠকদের কাছে। গ্রন্থের শুভ ভূমিকার কথাই সবাই বলে – গ্রন্থের যে কী প্রচণ্ড ‘ঋণাত্মক’ ভূমিকা আছে সেই সম্পর্কে কেউ কিছু বলে না। একজন ক্ষতিকর মানুষ সমাজের যতটা ক্ষতি করতে পারে তারচেয়ে একশো গুণ বেশি ক্ষতি করতে পারে সেই মানুষটির লেখা একটি বই। বইয়ের কথা বিশ্বাস করার আমাদের যে-প্রবণতা তার শিকড় অনেকদূর চলে গেছে। একটা বই মাটিতে পড়ে থাকলে টা মাটি থেকে তুলে মাথায় ঠেকাতে হয়। এই ট্রেনিং দিয়ে দেয়া হয়েছে সুদূর শৈশবে।
‘স্যার আসব?’
মেয়েটি আবার দরজার কাছে আসে দাঁড়িয়েছে। তাকে লজ্জিত এবং অনুতপ্ত মনে হচ্ছে। ঝড়ের বেগে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার অপরাধে সে নিজেকে অপরাধী করে কষ্ট পাচ্ছে।
‘স্যার আসব?’
মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, ‘না।’
মেয়েটি ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘একটু আগে নিতান্ত বালিকার মত যে ব্যবহার আপনার সঙ্গে আমি করেছি এরকম ব্যবহার আমি কখনোই কারও সঙ্গেই করি না। আপনার সঙ্গে কেন করলাম তাও জানি না। আপনার কাছেই আমি জানতে চাচ্ছি কেন এমন ব্যবহার করলাম।’
মিসির আলি বললেন, ‘এটা বলার জন্যে তুমি আসনি। অন্যকিছু বলতে এসেছ – সেটাই বরং বলো।’
বুড়ি নিচু গলায় বলল, ‘আমি খুব বড় ধরনের একটা সমস্যায় ভুগছি। কষ্ট পাচ্ছি। ভয়ংকর কষ্ট পাচ্ছি। আমার সমস্যাটা কেউ একজন বুঝতে পারলে আমি কিছুটা হলেও শান্তি পেতাম। মনে হয় আপনি বুঝবেন।’
‘বোঝার চেষ্টা করব। বলো তমার সমস্যা।’
‘বড় একটা খাতায় সব লেখা আছে। খাতাটা আপনাকে দিয়ে যাব। আপনি ধীরে-সুস্থে আপনার অবসর সময়ে পড়বেন। তবে একটি শর্ত আছে।’
‘কী শর্ত?’
‘কাল আমার অপারেশন হবে। আমি মারাও যেতে পারি। যদি মারা যাই তা হলে আপনি এই খাতায় কী লেখা আছে তা পড়বেন না। খাতাটা নষ্ট করে ফেলবেন। আর যদি বেঁচে থাকি তবেই পড়বেন।’
মিসির আলি বললেন, ‘তোমার এই শর্তপালনের জন্যে সবচে ভাল হয় যদি খাতাটা তোমার কাছে রেখে দাও। তুমি মারা গেলে আমি খাতাটা পাব না। বেঁচে থাকলে তুমি নিজেই আমাকে দিতে পারবে।’
‘খাতাটা আমি আমার কাছে রাখতে চাচ্ছি না। আমি চাই না অন্য কেউ এই লেখা পড়ুক। আমি মারা গেলে সেই সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। আপনার কাছে খাতাটা থাকলে এই দুশ্চিন্তা থেকে আমি মুক্ত থাকব।’
‘দাও তোমার খাতা।’
‘কাল ভোরবেলা অপারেশন থিয়েটারে যাবার আগে-আগে আপনার কাছে পাঠাব।’
‘ভাল কথা, পাঠিও।’
‘এখন আপনি কোনো একটা হাসির গল্প বলে আমার মন ভাল করে দিন।’
‘আমি কোনো হাসির গল্প জানি না।’
‘বেশ, তা হলে একটা দুঃখের কথা বলে মন-খারাপ করিয়ে দিন। অসম্ভব খারাপ করে দিন। যেন আমি হাউমাউ করে কাঁদি।’
রাতের বেলার রাউন্ডের ডাক্তার এসে মিসির আলির ঘরে বুড়িকে দেখে খুব বিরক্ত হলেন। কড়া গলায় বললেন, কাল আপনার অপারেশন। আপনি ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন এর মানে কী?’
বুড়ি শান্ত গলায় বলল, ‘এমনও তো হতে পারে ডাক্তার সাহেব যে আজ রাতই আমার জীবনের শেষ রাত। মৃত্যুর পর কোনো একটা জগৎ থাকলে ভাল কথা, কিন্তু জগৎ তো নাও থাকতে পারে। তখন?’
ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘প্লীজ আপনি নিজের ঘরে যান। বিশ্রাম করুন।’
বুড়ি উঠে চলে গেল। ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে কি আপনার পরিচয় আছে?’
‘সম্প্রতি হয়েছে।’
‘উনি তো ডেঞ্জারাস মহিলা!’
‘ডেঞ্জারাস কোন অর্থে বলছেন?’
‘সব অর্থেই বলছি। যে কোন সিনেমা পত্রিকা খুঁজে বের করুন – ওঁর সম্পর্কে কোনো না-কোনো স্ক্যাণ্ডালের খবর পাবেন। একবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছেন – একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন। এই হাসপাতালেই চিকিৎসা হয়। বাইরে থেকে স্কিন-গ্রাফটিং করিয়েছেন।’
‘মনে হচ্ছে খুব ইন্টারেস্টিং চরিত্র।’
‘অনেকের কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হতে পারে। আমার কাছে কখনো মনে হয় না। এই মহিলার লক্ষ লক্ষ টাকা। ইচ্ছা করলেই তিনি ইংল্যান্ড আমেরিকায় গিয়ে অপারেশনটা করাতে পারেন। দেশেও দামি দামি ক্লিনিক আছে সেখানে যেতে পারেন। তা যাবেন না। এসে উঠবেন – সরকারি হাসপাতালে। কেন বলুন তো?’
‘কেন?’
‘পাবলিসিটি, আর কিছুই না। অপারেশন হয়ে যাবার পর পত্রিকায় খবর হবে, অমুক হাসপাতালে অপারেশন হয়েছে। স্রোতের মতো ভক্ত আসবে। হাসপাতাল অ্যাডমিনিসট্রেশন কলাপস করবে। আমাদের পুলিশে খবর দিতে হবে। হাসপাতাল থেকে রিলিজড হয়ে যাবার পর তিনি খবরের কাগজে ইন্টারভিউ দেবেন। সাংবাদিক জিজ্ঞেস করবে, আপনি বিদেশে চিকিৎসা না করিয়ে এখানে কেন করালেন?’ তিনি হাসিমুখে জবাব দেবেন – ‘আমি দেশকে বড় ভালবাসি।’ খবরের কাগজে তাঁর হাস্যময়ী ছবি ছাপা হবে। নিচে লেখা – রূপা চৌধুরী দেশকে ভালবাসেন।
‘তাঁর নাম রূপা চৌধুরী?’
‘কেন, আপনি জানতেন না?’
‘না।’
‘রূপা চৌধুরীর নাম জানেন না শুনলে লোকে হাসবে। ওঁর কথা বাদ দিন, আপনি কেমন আছেন বলুন। মাথা ধরা শুরু হয়েছে?’
‘এখন হয়নি, তবে হবে হবে করছে।’
‘আগামী বুধবার পিজিতে আপনার ব্রেনের একটা ক্যাট স্ক্যান করা হবে।’
‘টিউমার সন্দেহ করছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘সর্বনাশ!’
‘আগে ধরা পড়ুক তারপর বলবেন সর্বনাশ। তবে সর্বনাশ বলার কিছু নেই – মস্তিষ্কের টিউমার প্রায় কখনোই ম্যালিগনেন্ট হয় না। তা ছাড়া মস্তিষ্কের অপারেশন প্রায়ই হয়। অপারেশন তেমন জটিলও নয়। নিউরো সার্জনরা আমার কথা শুনলে রেগে যাবেন, তবে কথা সত্যি।’
অনীশ – ০৪
ডাক্তার সাহেবের কথা সত্যি।
অপারেশন শেষ হবার পরপরই খবর ছড়িয়ে পড়ল রূপা চৌধুরী এই হাসপাতালে আছেন। হাজার হাজার লোক আসতে থাকল। সে এক দর্শনীয় ব্যাপার!
মিসির আলি খবর পেলেন অপারেশন ঠিকঠাকমতো হয়েছে। মেয়েটি ভাল আছে। এটিও আনন্দিত হবার মতো ব্যাপার। তার দিয়ে-যাওয়া খাতাটা পড়া শুরু করা জায়। পড়তে ইচ্ছা করছে না। অসুস্থ অবস্থায় কোনো কিছুতেই মন বসে না।
ক্যাট স্ক্যান করা হয়েছে। কিছু পাওয়া যায়নি। তারচেয়েও বড় কথা লিভারের সমস্যা বলে যা ভাবা হয়েছিল দেখা যাচ্ছে সমস্যা সেখানে না। মেডিক্যাল কলেজের যে-অধ্যাপক চিকিৎসা করছিলেন, তিনি গতকাল বলেছেন – আপনার শরীরে তো কোনো অসুখ পাচ্ছি না। অসুখটা আপনার মনে না তো?
মিসির আলি হেসে ফেললেন।
প্রফেসর সাহেব বললেন, ‘হাসছেন কেন? আপনি মনোবিদ্যার একজন ওস্তাদ মানুষ তা জানি- কিন্তু মনোবিদ্যার ওস্তাদ মানুষদের মনের রোগ হবে না এমন তো কোনো কথা নেই। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরও ক্যান্সার হয়। হয় না?’
‘অবশ্যই হয়। তবে মনের রোগ এবং জীবাণু বা ভাইরাস ঘটিত রোগকে এক লাইনে ফেলা ঠিক হবে না।’
‘আচ্ছা ফেলছি না। আপনাকে আমার যা বলার তা বললাম, আপনার অসুস্থতার কোনো কারণ ধরা যাচ্ছে না।’
‘আপনি কি আমাকে হাসপাতাল ছেড়ে দিতে বলছেন?’
‘শুধুশুধু কেবিনের ভাড়া গোনার তো আমি কোনো অর্থ দেখি না। অবশ্যি একটা উপকার হচ্ছে। বিশ্রাম হচ্ছে। যে-কোনো রোগের জন্যই বিশ্রাম একটা ভাল ওষুধ। সেই বিশ্রাম আপনি বাড়িতে গিয়েও করতে পারেন।’
‘তা পারি।’
‘আমি আপনাকে একটা পরামর্শ দিই মিসির আলি সাহেব?’
‘দিন।’
‘ময়মনসিংহের গ্রামে আমার সুন্দর একটা বাড়ি আছে। পৈতৃক বাড়ি যা সারাবছর খালি পড়ে থাকে। আপনি আমার ঐ বাড়িতে কিছুদিন থেকে আসুন-না!’
‘আপনার পৈতৃক বাড়িতে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই বিশেষ ফেভার আপনি কেন করতে চাচ্ছেন? আমি আপনার একজন সাধারণ রোগী। এর বেশি কিছু না। আপনি নিশ্চয়ই আপনার সব রোগীদের হাওয়া-বদলের জন্যে আপনার পৈতৃক বাড়িতে পাঠান না?’
‘না, পাঠাই না।’
‘আমাকে পাঠাতে চাচ্ছেন কেন?’
‘আমি যদি বলি মানুষ হিসেবে আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে তা হলে কি আপনার বিশ্বাস হবে?’
‘বিশ্বাস হবে না। যেসব গুণ একজন মানুষকে সবার কাছে প্রিয় করে তার কিছুই আমার নেই। আমি শুকনো ধরনের মানুষ। গল্প করতে পারি না। গল্প শুনতেও ভাল লাগে না।’
ডাক্তার সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘আমার বড় মেয়েটি আপনার ছাত্রী। তার ধারণা আপনি অসাধারণ একজন মানুষ। সে চাচ্ছে যেন আপনার জন্যে বিশেষ কিছু করা হয়।’
মিসির আলি হেসে ফেললেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে সম্পূর্ণ অন্য চোখে দেখে এটা তিনি লক্ষ করেছেন। যদিও তার কোনো কারণ বের করতে পারিনি। অন্য দশজন শিক্ষক যেভাবে ক্লাস নেন তিনিও সেভাবেই নেন। এর বেশি তো কিছু করেন না! তার পরেও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা এরকম ভাবে কেন? রহস্যটা কী?
‘মিসির আলি সাহেব!’
‘জি।’
‘আমার বড় মেয়ের স্বামী ধনবান ব্যক্তি। আমার বড় মেয়ে চাচ্ছে তার খরচে আপনাকে বাইরে পাঠাতে যাতে সর্বাধুনিক চিকিৎসার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন।
আপনি রেগে যাবেন কি না এই ভেবেই এ-প্রস্তাব এতক্ষণ দিই নি।’
‘আপনার বড় মেয়ের নাম কী?’
‘আমার মেয়ে বলেছে আপনি আমার নাম জানতে চাইলে নাম যেন আমি না বলি। সে তার নাম জানাতে চাচ্ছে না। আপনি কি আমার মেয়ের প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন?’
‘না, তবে আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করব। আপনার পৈতৃক বাড়িতে কিছুদিন তাকব। বাড়ি নিশ্চয়ই খুব সুন্দর?’
‘হ্যাঁ, খুবই সুন্দর। সামনে নদী আছে। আপনার জন্যে নৌকার ব্যবস্থা থাকবে। ইচ্ছা করলে নৌকায় রাত্রিযাপন করতে পারবেন। পাকা বাড়ি। দোতলার বারান্দা বেশ বড়। বারান্দায় এসে দাঁড়ালে ঘরে যেতে ইচ্ছা করে না- এমন।’
মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাকে তেমন আকর্ষণ করে না।’
‘গিয়ে দেখুন এখন হয়তো করবে। অসুস্থ মানুষকে প্রকৃতি খুব প্রভাবিত করে। পরিবেশেরও রোগ-নিরাময়ের ক্ষমতা আছে। আমি কি ব্যবস্থা করব?’
‘করুন।’
‘দিন পাঁচেক সময় লাগবে। আমি একজন ডাক্তারের ব্যবস্থাও করব। আমার ছাত্র গৌরীপুর শহরে প্র্যাকটিস করে। তাকে চিঠি লিখে দেব যাতে তিন-চারদিন পরপর সে আপনাকে দেখে আসে। খাওয়াদাওয়া নিয়ে চিন্তা করবেন না। বজলু আছে। সে হচ্ছে একের ভেতর তিন। কেয়ারটেকার, কুক এবং দারোয়ান। এই তিন কাজেই সে দক্ষ। বিশেষ করে রান্না সে খুব ভাল করে। মাঝে মাঝে তার রান্নার প্রশংসা করবেন। দেখবেন সে কত খুশি হয়।’