মিসির আলির ঘুম ভাঙল সকাল নটার দিকে।
ট্রেতে করে হাসপাতালের নাশতা নিয়ে এসেছে। দু স্লাইস রুটি, একটা ডিমসেদ্ধ, একটা কলা এবং আধগ্লাস দুধ। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের একটির জন্যে বেশ ভাল খাবার স্বীকার করতেই হবে। তবু বেশির ভাগ রোগী এই খাবার খায় না। তাদের জন্যে টিফিন-ক্যারিয়ারে ঘরের খাবার আসে। ফ্লাস্কে আসে দুধ।
জেনারেল ওয়ার্ডের অবস্থা অবশ্য ভিন্ন। সেখানকার রোগীরা হাসপাতালের খাবার খুব আগ্রহ করে খায়। যারা খেতে পারে না তারা জমা করে রাখে। বিকেলে তাদের আত্মীয়স্বজনরা আসে। মাথা নিচু করে লজ্জিত মুখে এই খাবারগুলি তারা খেয়ে ফেলে। সামান্য খাবার, অথচ কী আগ্রহ করেই-না খায়! বড় মায়া লাগে মিসির আলির। কতবার নিজের খাবার ওদের দিয়ে দিয়েছেন। ওরা কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়েছে।
আজকের নাশতা মিসির আলি মুখে নিতে পারলেন না। পাউরুটিতে কামড় দিতেই বমি-ভাব হল। এক চুমুক দুধ খেলেন। কলার খোসা ছাড়ালেন, কিন্তু মুখে দিতে পারলেন না। শরীর সত্যি সত্যি বিদ্রোহ করেছে।
খাবার নিয়ে যে এসেছে সে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ চোখে। রোগী খাবার খেতে পারছে না এই দৃশ্য নিশ্চয়ই তার কাছে নতুন নয়। তবু তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে দুঃখিত। লোকটি স্নেহময় গলায় বলল, ‘কষ্ট কইরা খান। না খাইলে শরীরে বল পাইবেন না।’
মিসির আলি শুধুমাত্র লোকটিকে খুশি করার জন্য পাউরুটি দুধে ভিজিয়ে মুখে দিলেন। খেতে কেমন যেন ঘাসের মতো লাগছে।
আজ শুক্রবার।
শুক্রবারে রুটিন ভিজিটে ডাক্তাররা আসেন না। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁদের ঘর-সংসার আছে, পুত্রকন্যা আছে। জন্মদিন, বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী আছে। একটা দিন কি তাঁরা ছুটি নেবেন না? অবশ্যই নেবেন। মিসির আলি ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর কাছে কেউ আসবে না। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে অ্যাপ্রন গায়ে মাঝবয়েসি এক ডাক্তার এসে উপস্থিত। ডাক্তার আসার এটা সময় নয়। প্রথমত শুক্রবার, দ্বিতীয়ত দেড়টা বাজে, লাঞ্চ ব্রেক। ডিউটির ডাক্তাররাও এই সময় ক্যান্টিনে খেতে যান।
ডাক্তার সাহেব বল্লেন,’কেমন আছেন?’
মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, ‘ভাল থাকলে কি হাসপাতালে পড়ে থাকি?’
‘আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে ভাল আছেন। কাল রাত খুব খারাপ অবস্থায় ছিলেন। প্রবল ডেলিরিয়াম।’
‘আপনি রাতে এসেছিলেন?’
‘জি।’
‘চিনতে পারছি না। মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। গত রাতে কী ঘটেছে কিচ্ছু মনে নেই।’
ডাক্তার সাহেব চেয়ারে বসলেন। তাঁর শরীর বেশ ভারী। শরীরের সঙ্গে মিল রেখে গলার স্বর ভারী। চশমার কাচ ভারী। সবই ভারী-ভারী, তবুও মানুষটির কথা বলার মধ্যে সহজ হালকা ভঙ্গি আছে। এ-জাতীয় মানুষ গল্প করতে এবং শুনতে ভালবাসে। মিসির আলি বললেন,’ডাক্তার সাহেব, আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি বলুন।’
‘একটা সমস্যার সমাধান করতে পারেন। এই কেবিনটা ছেড়ে অন্য কেবিনে চলে যেতে পারেন। একজন মহিলা এই কেবিনে আসতে চাচ্ছেন।’
মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি এই মুহূর্তে কেবিন ছেড়ে দিচ্ছি।’
‘এই মুহূর্তে ছাড়তে হবে না। কাল ছাড়লেও হবে।’
ডাক্তার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। মিসির আলি বললেন, ‘ভদ্রমহিলা বিশেষ করে এই কেবিনে আসতে চাচ্ছেন কেন?’
‘তাঁর ধারণা এই কেবিন খুব লাকি। কেবিনের নম্বর চারশো নয়। যোগ করলে হয় তেরো। তেরো নম্বরটি নাকি তাঁর জন্যে খুব লাকি। সৌভাগ্য সংখ্যা। নিউমোরলজির হিসাব।’
‘কী অদ্ভুত কথা!’
ডাক্তার সাহেব হালকা স্বরে বললেন, ‘অসুস্থ অবস্থায় মন দুর্বল থাকে। দুর্বল মনে তেরো নম্বরটি ঢুকে গেলে সমস্যা।’
‘মনের মধ্যে যা ঢুকেছে তা বের করে দিন।’
ডাক্তার সাহেব হেসে ফেলে বললেন, ‘এটা তো কোনো কাঁটা না রে ভাই যে চিমটা দিয়ে বের করে নিয়ে আসব। এর নাম কুসংস্কার। কুসংস্কার মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় ছড়িয়ে দেয়। কুসংস্কারকে তুলে ফেলা আমার মতো সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। যাই ভাই। আপনি তা হলে কাল ভোরে কেবিন নম্বর চারশো পাঁচে চলে যাবেন। কেবিনটা সিঁড়ির কাছে না, কাজেই হৈচৈ হবে না। তা ছাড়া জানালার ভিউ ভাল। গাছপালা দেখতে পারবেন।
মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি এই রুম ছাড়ব না। এখানেই থাকব।’
ডাক্তার বিস্মিত হয়ে তাকালেন। কী একটা বলতে গিয়েও বললেন না। মিসির আলি বললেন, ‘রুম ছাড়ব না, কারণ, ছাড়লে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয়া হয়। আমি এই জীবনে কুসংস্কার প্রশ্রয় দেবার মতো কোনো কাজ করিনি। ভবিষ্যতেও করব না।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আপনি যদি অন্য কোনো কারণ বলতেন, রুম ছেড়ে দিতাম। আমার কাছে চারশো নয় নম্বর যা, চারশো পাঁচও তা। তফাত মাত্র চারটা ডিজিটের।’
ডাক্তার সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, ‘আপনি কি ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলবেন?’
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভদ্রমহিলা এ-ঘরে না আসা পর্যন্ত অপারেশন করাবেন না। অপেক্ষা করবেন। অথচ অপারেশনটা জরুরি।’
‘ওঁর অসুবিধা কী?’
‘কিডনির কাছাকাছি একটা সিস্টের মতো হয়েছে। আপনি যদি তাঁর সঙ্গে কথা বলেন তা হলে ভাল হয়। ভদ্রমহিলাকে আপনি চেনেন।’
‘তা-ই না কি?’
‘হ্যাঁ। ভাল করেই চেনেন। উনি অনুরোধ করলে না বলতে পারবেন না।’
‘নাম কী তাঁর?’
‘আমি ওঁকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি কথা বলুন।’