তাপসীকে একবার দেখাইয়া এদের ‘বড় মুখ’ হেঁট করা গেল না, এ কি কম আপসোসের কথা? তাপসীর কাছে লিলি? কিসে আর কিসে! লিলি! কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন আর কাকে বলে!…ওই রূপে আবার সাজের ঘটা কত! এই যে নিত্য নূতন পোশাকের চটক, দেখানে-পনা ছাড়া আর কি! মতলব বোধ করি চিত্রলেখাকে অবাক করিয়া দেওয়া। অবশ্য চিত্রলেখা এত নির্বোধ নয় যে অবাক হইবে। লিলির তুলনায় ‘বেবি’ অর্থাৎ তাপসীর যে আরও কত অজস্র রকমের পোশাক-পরিচ্ছদ আছে সে কথাগুলি নিতান্তই গল্পচ্ছলে উচ্চারণ করিতে হয়। যথা–এত যে রকম রকম জামা-জুতো করিয়ে দিচ্ছি বিলাতী দোকানে অর্ডার দিয়ে, তা সৃষ্টিছাড়া মেয়ে কিছু যদি পরবে! অথচ এই দেখ, লিলি! যা দিচ্ছ তাই আনন্দ করে পরছে।
বেবির গানের মেডেলগুলা আনিবার কথা অবশ্য নয় কিন্তু কি জানি কি ভাবে আসিয়া পড়িয়াছে! সুটকেসের কোণেই পড়িয়াছিল হয়তো। যাই হোক, আসিয়া পড়িয়াছে বলিয়াই পাঁচজনকে দেখানো। নইলে ও আর কি–হরদমই তো পাইতেছে! রেডিও কোম্পানী তো চিত্রলেখার বাড়ির মাটি লইয়াছে! চিত্রলেখার ইচ্ছা নয় যে তুচ্ছ কারণে মেয়ে গলা নষ্ট করে। হা, তবে ‘হিজ মাস্টারস’-এর ওখানে বরং এক-আধবার পাঠানো চলে।…সেজকাকী আর তস্য দিদির দুর্ভাগ্য যে, ‘বেবী’র গান শুনিয়া জীবনটা ধন্য করিয়া লইবার সুযোগ পাইলেন না।
প্রথম প্রথম কথা কহার সুখটুকুই ছিল–কিন্তু ইদানীং যেন সেটাও যাইতে বসিয়াছে। দেখা যাইতেছে এসব গল্পে আর কেউ বিশেষ আমল দিতেছে না। এমন কি মণীন্দ্র পর্যন্ত মাঝে মাঝে চিত্ৰলেখার কাছে কথার ট্যাক্স চান। চিত্রলেখা নাকি আজকাল বড় বেশী বাজে বাজে কথা বলে!
শোনো কথা! এরপর আরো যে কি-না-কি বলিয়া বসিবেন মণীন্দ্র কে জানে! বৃদ্ধ হইতে যে আর বিশেষ বাকি নাই সেটা ধরা পড়ে এমনি বুদ্ধিভ্রংশ কথাবার্তায়! সংসারে কি আছে না আছে মণীন্দ্র জানেন? না বেবির গুণপনার সব হিসাব তিনি রাখেন? তবে? যা-তা একটা বলিয়া চিত্রলেখার মুখ হাসানো কেন?
রাগে রাগে কোন সময়ই তাই আর চিত্রলেখা মুখে হাসিই আসিতে দেয় না। এমনই যাই যাই’ গাছের মনের অবস্থায় হঠাৎ হেমপ্রভার ‘তার’ আসিয়া হাজির হইল।
অন্য সময় হইলে চিত্রলেখা হয়তো শাশুড়ীর এরকম বেয়াড়া আবদারে রীতিমত জ্বলিয়া উঠিত, কিন্তু এক্ষেত্রে মনে করিল–যাক, তবু মন্দের ভালো। স্বামীর কাছে মান খোয়াইয়া কলিকাতায় ফেরার কথা ভোলা যাইতেছিল না, এ তবু একটা উপলক্ষ পাওয়া গেল!
টেলিগ্রামখানা বার দুই-তিন পড়িয়া মণীন্দ্র বোধ করি মায়ের অসুখের গুরুত্বটা নির্ণয় করার চেষ্টা করিতেছিলেন, চিত্রলেখা সাড়া দিয়া কহিল–তা হলে যাবে নাকি?
–যাব না! মণীন্দ্র অবাক হইয়া তাকান। অবশ্য কিছুটা বিরক্তিও ধরা পড়ে প্রশ্নের সুরে।
–হ্যাঁ, যাবে তো নিশ্চয়ই, প্রশ্ন করাই অন্যায় হয়েছে আমার, যাক, আমিও মনে করছি চলে যাই এই সঙ্গে, আমায় কলকাতায় নামিয়ে দিয়ে তুমি পরের ট্রেনে চলে যেও।
মণীন্দ্র বোধ করি সামান্য আশা করিয়াছিলেন, মায়ের মৃত্যুশয্যাপার্শ্বে সস্ত্রীক উপস্থিত হইতে পারিবেন, কিন্তু চিত্রলেখার প্রস্তাবে হতাশ হন। কর্তব্যবোধ জাগাইবার দুরাশা অবশ্য নাই, তবু ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদ করেন–তোমার একবার না যাওয়াটা ভাল হবে? ধর যদি মা’র–
যতই হোক মা, তাই অকল্যাণকর বাকি কথা বোধ করি উচ্চারণ করিতে বাধে মণীন্দ্রর।
চিত্রলেখার অবশ্য জানিতে বাকি নাই, মণীন্দ্রর প্রাণ পড়িয়া থাকে কোথায়! নেহাৎ নাকি চিত্রলেখা বেশী আদিখ্যেতা দেখিতে পারে না, তাই ‘মা মা’ করিয়া বাড়াবাড়ি করিবার সাহস হয় না। তবে চিত্রলেখার অত শখ নাই। অগ্রাহ্যের ভঙ্গীতে বলে–তুমি যতটা সিরিয়াস’ ভাবছ, আমার তো তা মনে হচ্ছে না। সেকেলে মানুষ, অল্পে ব্যস্ত হওয়া স্বভাব আর কি! হয়তো সামান্য কিছু হয়েছে, তার’ ঠুকে দিয়েছেন।
–বেশী যে হয়নি তারই বা প্রমাণ কি পাচ্ছ তুমি?
–প্রমাণ আবার কি, নিজের ধারণার কথাই বলছি। কেবল তর্ক, চিরদিন এক স্বভাব গেল! যাক, তোমার মা’র বিষয় তুমিই ভাল বুঝবে, তবে তোমার যদি এতই তাড়া থাকে, বর্ধমানে নেমে পড়ে চলে যেও কুসুমহাটি, হাওড়া স্টেশনে এসে একটা ট্যাক্সি করে নিয়ে বাড়ি পৌঁছবার ক্ষমতা আমার যথেষ্ট আছে।
–তাহলে তুমি না যাওয়াই ঠিক করলে? কাজটা কি রকম হবে তাই ভাবছি!
চিত্রলেখা এবার ঈষৎ নরম সুরে উত্তর দেয়–বেশ তো, তুমি গিয়ে অবস্থা দেখে একটা টেলিগ্রাম করেও দিতে পার তো! দরকার বুঝি-যাওয়া এমন কিছু শক্ত নয়, ঘণ্টাকয়েকের মামলা, আমার পক্ষে এখন তৈরি হওয়া বড় সহজ কাজ নয়। উঃ, বিরাট জিনিসপত্র ম্যানেজ করা–
মণীন্দ্র দোষারোপের ভঙ্গীতে বলেন–তখনই বলেছিলাম ‘লাগেজ’ বড় বেশি হয়ে যাচ্ছে– ছেলেমেয়েরা এল না, মাত্র দু’জনের জন্যে সাতটা সুটকেস, দুটো হোল্ডল–
সে তুমি বলবে জানি, অথচ সেজকাকার বাড়িতে থাকা হল বলেই না এ সব লাগেজ বাড়তি মনে হচ্ছে! একটা সংসার ম্যানেজ করতে হলে কত কি লাগে! তা ছাড়া ছোটলোকের মত একই শাড়ী ব্লাউজ বার বার পরতে আমার প্রবৃত্তি হয় না সে তো তোমার অজানা নয়। কি আর করা যাবে?
স্বামীর সঙ্গে দুই দণ্ড প্রেমালাপ করিবে কি, কথাবার্তা শুনিলেই যে গা জ্বলিয়া যায়। চিত্রলেখার! উপরে যতই পালিশ পড়ক লোকটার, ভিতরে যে কোথায় একটু গ্রাম্যভাব রহিয়া গিয়াছে, যেটা এমন চটকদার পালিশের নীচে হইতেও মাঝে মাঝে উঁকি মারে, অন্ততঃ চিত্রলেখার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ধরা পড়িতে দেরি হয় না।