শুধু হেমপ্রভার জন্য রহিল অগাধ পরমায়ু আর দুরপনেয় কলঙ্ক।
কলঙ্ক বৈকি! শুধু তো বিবাহের কথা দিয়া সত্যবদ্ধ হওয়া নয়, প্রতিকারবিহীন শৃঙ্খলের বন্ধনে সমস্ত ভবিষ্যৎ যে বাঁধা পড়িয়া গেল তাপসীর।
বিবেচক কান্তি মুখুজ্জে যে মৃত্যুকালে এত বড় অবিবেচনার কাজ করিয়া যাইবেন, এ কথা যদি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করিতেন হেমপ্রভা, হয়ত এমন কাণ্ড ঘটিতে দিতেন না।
অকস্মাৎ মারাত্মক অসুখের সংবাদ বহন করিয়া যে লোকটা আসিল সে শুধু সংবাদ দিয়াই ক্ষান্ত রহিল না, বিনীত নিবেদন জানাইলকর্তার শেষ অনুরোধ, হেমপ্রভা যেন তাপসীকে লইয়া একবার দেখা করিতে যান। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হেমপ্রভার সাধ্য কি এ অনুরোধ এড়ান?
কিন্তু সেখানে যে তাহার জন্য মৃত্যুবাণ প্রস্তুত হইয়া আছে সে কথা টের পাইলে হয়তো এ ।অনুরোধও ঠেলিয়া ফেলা অসম্ভব ছিল না। কিছুই আশঙ্কা করেন নাই, গিয়া দেখিলেন বিবাহের সমস্ত ব্যবস্থা প্রস্তুত–পুরোহিত ও নাপিত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছে।
কুশল প্রশ্ন ভুলিয়া হেমপ্রভা সেই অর্ধ-অচৈতন্য রোগীর কাছে গিয়া প্রায় তীব্রস্বরে কহিলেন–এ কী কাণ্ড মুখুজ্জে মশাই?
কান্তি মুখুজ্জে চোখ খুলিয়া মৃদু হাসির আভাস ঠোঁটে আনিয়া ধীরে ধীরে কহিলেন– ঠিকই হল বেয়ান, দেখছেন না বিধাতার বিধান!
কিন্তু ওর বাপ-মা জানতে পর্যন্ত পেল না, এ মুখ আমি দেখাব কি করে তাদের? কি বলে বোঝাব?
–অবস্থাটা খুলে বলবেন। বুঝবে বই কি, আপনার ছেলে তো মূর্খ নয়। আর–আর মৃত্যু না হইলে নাকি স্বভাব যায় না মানুষের, তাই পরিহাসরসিক কান্তি মুখুজ্জে মৃদু পরিহাসের ভঙ্গীতে বলেন–সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন, ধরে এনে তো আর জেলে দিতে পারবে না আমাকে! অবিশ্যি বলবেন, তার কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছে কান্তি মুখুজ্জে। অসময়ে ডাক এসে গেল যেকরি কি বলুন?
এ কথার আর কি উত্তর দিবেন হেমপ্রভা?
কিন্তু মুদিতপ্রায় নিষ্প্রভ চোখেও ধরা পড়িল হেমপ্রভার অসহায় হতাশ মুখচ্ছবি, তাই কিছুক্ষণ স্থির থাকিয়া ক্ষীণস্বরে কহিলেন–ভাববেন না–আমি কথা দিচ্ছি সুখী হবে ওরা, আমার বুলু বড় ভাল ছেলে, কিন্তু বড় হতভাগ্য। তাই লক্ষ্মীপ্রতিমার সঙ্গে বেঁধে দিলাম ওকে।…আর অভিভাবক ঠিক করে দিয়ে গেলাম ওর। আমি চোখ বুজলে যে ওর পৃথিবী শূন্য, বেয়ান! ক্লান্তিতে দুই চোখের পাতা জড়াইয়া আসিল।..ওদিকে তখন বিবাহের অনুষ্ঠান শুরু হইয়াছে।
ক্রন্দনরতা কনেকে অনেকে অনেক বুঝাইয়া চুপ করাইয়াছে।…কিন্তু ভিতর হইতে ক্রন্দনোচ্ছ্বাস গলা পর্যন্ত ঠেলিয়া আসিতেছে তাপসীর। সে তো নিজের হিতাহিত ভাবিয়া নয়, চিত্রলেখা জানিতে পারিলে কি হইবে সেই কথা ভাবিয়াই সর্বশরীর হিম হইয়া আসিতেছে তাহার। যেন তাপসী নিজেই কি ভয়ানক অপকর্ম করিয়াছে!
কান্তি মুখুজ্জে মারা গেলেন পরদিন সন্ধ্যায়।
ফুলশয্যা হইল না, কুশণ্ডিকার সিঁদুর পরিয়া ঠাকুমার সঙ্গে ফিরিয়া আসিল তাপসী।
পাড়ার গৃহিণীরা বলিতে লাগিলেন—’ভগবানের খেলা’…’ভবিতব্য’! ভট্টাচার্য টিকি দুলাইয়া আশ্বাস দিলেন–বিধাতার নির্দিষ্ট বিধান, আমরা তো নিমিত্ত মাত্র।
.
কিন্তু হেমপ্রভা কিছুতেই সান্ত্বনা খুঁজিয়া পান না। ছেলে-বৌকে মুখ দেখাইবেন কোন্ মুখে–এ উত্তর কে দিবে তাহাকে? কঠিন একটা রোগ কেন হয় না হেমপ্রভার? কান্তি মুখুজ্জের মত?…হায়, এত ভাগ্য হেমপ্রভার হইবে?
অথচ এ এমন ব্যাপার যে লুকাইয়া রাখার উপায় নাই, চাপিয়া ফেলার জো নাই!
অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া ছেলের নামে একখানা জরুরী টেলিগ্রাম পাঠাইলেন, ‘মা মৃত্যুশয্যায়, শেষ দেখা করতে চাও তো এসো।” পাঠাইয়া দিয়া অবিরত প্রার্থনা করিতে থাকেন কল্পিত রোগ যেন সত্য হইয়া দেখা দেয়…মণীন্দ্র আসিয়া যেন দেখে যথার্থই মৃত্যুশয্যায়।
অপরাধিনী মাকে তখন ক্ষমা করা হয়তো অসম্ভব হইবে না মণীন্দ্রের পক্ষে।
.
এবারে বিদেশে আসিয়া চিত্রলেখার মন বসিতেছিল না। ছেলেমেয়েদের না আনিয়া যে এত খারাপ লাগিবে এ কথা আগে খেয়াল হয় নাই। তাহারা কাছে না থাকিলে ছটা বিকীর্ণ করিবার উপায় কোথা? শুধু নিজেকে দিয়া কতটাই আর প্রকাশ করা যায়? কতই বা সাজসজ্জা করা যায় তিনবেলা?
মেয়েকে তালিম দিয়া গড়িয়া তোলার উদ্দেশ্য কি তবে? যদি উপযুক্ত ক্ষেত্রটাই মাঠে মারা গেল?
এবার তো আবার শুধু প্রতিবেশী হিসাবে নয়, সেজকাকীর সংসারেই আশ্রয় লইতে হইয়াছে যে–অবশ্য ‘পেয়িং-গেস্ট হইয়া। আসিবার আগে সেজকাকা একখানা বাড়ির আশ্বাস দিয়াছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আর জুটিল না। সেজকাকীর ভগ্নীপতির চাহিদা ফেলিয়া তো আর চিত্রলেখাকে দেওয়া যায় না! অগত্যা ভাইঝি ও ভাইঝি-জামাইকে নিজের বাড়িতেই আশ্রয় দিতে হইয়াছে তাহাকে, নেহাৎ যখন আসিয়া পড়িয়াছে।
কিন্তু ভাইঝি তো আর দুঃখী দরিদ্র নয় যে “বিনামূল্যের অন্ন” গলাধঃকরণ করিবে! বরং নিজেদের খরচের উপরিই সে দেয়। কিন্তু তাহাতেই বা শান্তি কই? সুখ কই?
সেজকাকার কালো কুমড়ো’র মত খেদি মেয়েটা যখন নাচিয়া গাহিয়া আসর জমকায় আর পাড়ার লোকের বাহবা কুড়ায়, সেজকাকীর দিদি যখন পাশের বাড়ি হইতে বেড়াইতে আসিয়া বোনঝির রূপগুণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইয়া ওঠেন, তখন সর্বাঙ্গ জ্বালা করে চিত্রলেখার।