দায়সারা-গোছ একটা প্রণাম করিয়া বুলু চঞ্চলভাবে বলে–দাদু, যাই?
–আচ্ছা যাও। এখন তো এসেই পালাবার তাড়া! দেখব এরপর।…কি বলেন বেয়ান? হ্যাঁ, বেয়ানই বলি–সম্বন্ধটা যখন পাকা হয়ে গেল! দেখুন, আপনার আর কিছু বলবার আছে? ছেলে দেখলেন তো? এরা যে পরস্পরের জন্যে সৃষ্টি হয়েছে, এ কি অস্বীকার করতে পারেন?
–না মুখুজ্জে মশাই, প্রত্যক্ষ দেখলাম এ ভগবানের বিধান। বলবার কিছু নেই। …নিজের অজ্ঞাতসারেই কথাটা উচ্চারণ করেন হেমপ্রভা। কে যেন বলাইয়া লয় তাহাকে।
কান্তি মুখুজ্জে প্রাণখোলা হাসি হাসিয়া ওঠেন হবেই তো, কান্তি মুখুজ্জের চোখ ভুল করে না, বুঝলেন? জমির ওপর থেকে ধরতে পারি কার নীচে আছে কয়লা, আর কার নীচে হীরে!
বিচক্ষণ কান্তি মুখুজ্জে তো হীরক-খনি নির্ণয় করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন, কিন্তু হেমপ্রভার কোথায় সে নিশ্চিন্ততার সুখ?
বাড়ি ফিরিয়া তিনি ছটফট করিতে থাকেন।
এ কি করিলাম! এ কি করিয়া বসিলাম!
মন্দির-প্রাঙ্গণে এ কি সত্য করিয়া বসিলেন হেমপ্রভা? এ যে কত বড় অনধিকারচর্চা সে কথা হেমপ্রভার চাইতে বেশী কে জানে? কেন হেমপ্রভা দুই হাত জোড় করিয়া ক্ষমা চাহিলেন না কান্তি মুখুজ্জের কাছে? কেন বলিলেন না—’যে সত্য রাখিতে পারিব না, সে সত্যের মূল্য কি?’ নিজের দৈন্য স্বীকার করিয়া লইলেই তো গোল মিটিয়া যাইত!
হেমপ্রভা মণীন্দ্রর মা, তাই তাহার উপরওয়ালা? হেমপ্রভার কথা বিলেতের আপীল? হায়, হেমপ্রভার জীবনে এ কথা পরিহাস ছাড়া আর কি! কিন্তু স্পষ্ট করিয়া এই সত্যটুকু প্রকাশ করিবার সাহস কেন হইল না তখন? অহঙ্কার? আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগিত?
কিন্তু তাই কি ঠিক? হেমপ্রভার কি তখন অত ভাবিবার ক্ষমতা ছিল? নিয়তি কি এই কথা বলাইয়া লইলেন না হেমপ্রভার বিহ্বলতার সুযোগে?
নিজের মনকে প্রবোধ দিতে যদিও বা নিয়তিকে দায়ী করা যায়, চিত্রলেখার সামনে দাঁড় করাইবেন কাহাকে? নিয়তিকে? তাপসীর বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করিয়াছেন শুনিলে চিত্রলেখা শাশুড়ীকে পাগলাগারদের বাহিরে রাখিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিবে? হেমপ্রভার আহার-নিদ্রা ঘুচিয়া গেল। যে তৃপ্তিটুকু কয়দিন ভোগ করিয়া লইয়াছেন, এ যেন তাহারই খেসারৎ।
নিজের উপর রাগ হয়, কান্তি মুখুজ্জের উপর রাগ হয়, সারা বিশ্বের উপরই যেন বিরক্তি আসে। কোন মন্ত্রের প্রভাবে সেদিনের সকালটা যদি ফিরাইয়া আনা যাইত, মন্দিরের ত্রিসীমানায় যাইতেন না হেমপ্রভা। এত কাণ্ডের কিছুই ঘটিত না।
তবু সেই কিশোর দেবতার মত ছেলেটির মুখ মনে পড়িলেই যেন হৃদয় উদ্বেলিত হইয়া উঠিতে চায়। মনে হয়, ছেলে-বৌয়ের হাতে ধরিয়া সম্মতি আদায় করিয়া লইতে পারিব না? না হয় হেমপ্রভার মানটা কিছু খাটো হইল। না হয় জীবনে ওরা আর হেমপ্রভার মুখ না দেখুক, দেবমন্দিরে দাঁড়াইয়া যে সত্য করিয়া ফেলিয়াছেন হেমপ্রভা, তার মর্যাদাটুকু শুধু রাখুক ওরা।
মণীন্দ্রর নিজের কোন সত্তা থাকিত যদি, হয়তো এত অকূল পাথারে পড়িতেন না হেমপ্রভা, কিছুটা সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করিতেন। কিন্তু চিত্রলেখা যে মণীন্দ্রর হৃদয়বৃত্তির সব কিছু আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে, একথা জানিতে কি বাকি আছে এখনও?
চিত্রলেখার মুখ মনে পড়িলে কোনদিকে আর কূলকিনারা দেখিতে পান না হেমপ্রভা।
.
দিন কয়েক কাটে।
হেমপ্রভা ভাবিতে চেষ্টা করেন–ও কিছু নয়, ব্যাপারটা হয়ত ঘটে নাই। সেদিনের সমস্ত কথাগুলি বার বার স্মরণ করিতে চেষ্টা করেন, এমন আর কি গুরুতর প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন তিনি? মেয়ে-ছেলে থাকিলেই কত জায়গায় সম্বন্ধ হয়…কিন্তু যতই হাল্কা করিবার চেষ্টা করুন, বিগ্রহের সমীপবর্তী মন্দির প্রাঙ্গণ যেন পাহাড়ের ভার লইয়া বুকে চাপিয়া বসিয়া থাকে।
তাছাড়া ভুলিয়া থাকিবার জো কই? কান্তি মুখুজ্জের বাড়ি হইতে প্রায় প্রত্যহই তত্ত্ব আসিতে শুরু করিয়াছে–একলা তাপসীর জন্যই নয় শুধু, তিন ভাইবোনের জন্য অজস্র খেলনা, খাবার, জামাকাপড়।
হেমপ্রভা নাচার হইয়া মনে মনে ভাবেন–আচ্ছা ঘুঘু বুড়ো! ঝুনো ব্যবসাদার বটে! মুখের কথা হাওয়ায় ভাসিয়া যাওয়ার আশঙ্কায় বস্তুর পাষাণভার গলায় বাঁধিয়া দিয়া হেমপ্রভাকে ডুবাইয়া মারার কৌশল ছাড়া এ আর কি?
সব কথা খুলিয়া বলিয়া ছেলেকে একখানা চিঠি লিখিবার চেষ্টা করেন হেমপ্রভা, কিন্তু মুসাবিদা ঠিক করিয়া উঠিতে পারেন না। এদিকে বিধাতাপুরুষ একদা যা মুসাবিদা করিয়া রাখিয়াছিলেন, পাকা খাতায় উঠিতে বিলম্ব হয় না তার। হেমপ্রভা কী কুক্ষণেই দেশে আসিয়াছিলেন এবার!
.
এদিকে নাতির জন্য ‘কনে’ দেখিয়া পর্যন্ত নূতন করিয়া যেন প্রেমে পড়িয়া গিয়াছেন কান্তি মুখুজ্জে। চোখে যৌবনের আনন্দদীপ্তি, দেহে যৌবনের স্ফুর্তি।..বিবাহের তারিখের জন্য ‘দুই এক বছর অপেক্ষা’ করার প্রতিশ্রুতিটাও যেন এখন বিড়ম্বনা মনে হয়। মনে হয়, এখনি সারিয়া ফেলিলেই বা ক্ষতি কি ছিল? কবে আছি কবে নাই!
কিন্তু নিতান্ত সাধারণ এই মামুলী কথাটা যে কান্তি মুখুজ্জের জীবনে এত বড় নিদারুণ সত্য হইয়া দেখা দিবে, এ আশঙ্কা কি স্বপ্নেও ছিল তার? কে বা ভাবিয়াছিল মৃত্যুদূত এমন বিনা নোটিশে কান্তি মুখুজ্জের দরজায় আসিয়া দাঁড়াইবে! বয়স হইলেও–অমন স্বাস্থ্য সুগঠিত দেহ, অমন প্রাণবন্ত উজ্জ্বল চরিত্র, অত আশা-আকাঙ্ক্ষাভরা হৃদয়, মুহূর্তের মধ্যে সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটিয়া গেল।