কান্তি মুখুজ্জে কেমন যেন আত্মহারা ভাবে এদের পানে চাহিয়াছিলেন, হঠাৎ এই অবান্তর প্রশ্নে সচেতন হইয়া বলেন–কোন্ মিস্ত্রীটা বলল তো?
–ওই কাঠের ঘোড়াগুলো যে গড়েছে! আমি একটা ঘোড়া গড়তে দেব মনে করছি। সিদ্ধার্থের এ হেন বিজ্ঞজনোচিত সুচিন্তিত মন্তব্যে উপস্থিত সকলেই হাসিয়া ওঠে। কান্তি মুখুজ্জে তাহার গায়ে একটি আদরের থাবড়া মারিয়া বলেন–ঘোড়া কেন দাদা, সোজাসুজি একটা হাতিই গড়তে দিও তুমি, কিন্তু এইটি তোমার দিদি? কী নাম তোমার লক্ষ্মী?
তাপসী অস্ফুট স্বরে নিজের নাম উচ্চারণ করে।
–তাপসী? চমৎকার! কিন্তু এ নাম তো তোমার জন্যে নয় দিদি। তপস্যা করবে সে, যে তোমাকে পেয়ে ধন্য হবে।..সন্দেহ করবার কিছু নেই, ব্রাহ্মণকন্যা তো বটেই, তবু পদবীটা যে। জানতে হবে আমার।…তোমার বাবার নাম কি দিদি?
লাজুক দিদি উত্তর দিবার আগেই অমিতাভ গম্ভীরভাবে বলে–বাবার নাম এম. ব্যানার্জি। দিদি ও ছোট ভাইয়ের মাঝখানে নিজে কেমন গৌণ হইয়া যাইতেছিল বলিয়াই বোধ করি নিজের সম্বন্ধে সকলকে সচেতন করিয়া দিতে উত্তরটা দেয় অমিতাভ। কিন্তু সিদ্ধার্থর কাছে তার পরাজয় অনিবার্য।
তীব্র তিরস্কারের ভঙ্গীতে দাদার দিকে চাহিয়া সিদ্ধার্থ বলে–আবার ওইরকম বলছিস? নানি কি বলে দিয়েছেন? এখানে কি বলতে হয়?…বাবার নাম হচ্ছে শ্রীমণীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বুঝলেন?
–বুঝেছি। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ—
কান্তি মুখুজ্জে সোজাসুজি হেমপ্রভার সামনে আসিয়া বলেন–বাধ্য হয়ে আপনাকে সম্বোধন করতে হল, লজ্জা করবেন না–আমি আপনার চেয়ে অনেক বড়। এই মেয়েটি আপনার পৌত্রী?
‘নানি’ শব্দটা সন্দেহজনক বলিয়াই বোধ করি সম্পর্কটা যাচাই করিয়া লন ভদ্রলোক।
হেমপ্রভা মাথা হেলাইয়া জানান তাই বটে।
–তা হলে–আপনার কাছে আমার একটি আবেদন–মেয়েটিকে আমায় দিন। আমার একটি নাতি আছে, মা-বাপ-মরা হতভাগ্য, তবে আমার যা খুদকুঁড়ো আছে সবই তার। কিন্তু সে যাক–ছেলেটাকে একবার দেখে আপনি কথা দিন আমায়।
হেমপ্রভা যেন দিশেহারা হইয়া যান। অকস্মাৎ এ কি বিপদ!
এ অঞ্চলে কান্তি মুখুজ্জে যে-সে লোক নন। এত বড় একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির এই বিনীত আবেদনকে হেমপ্রভা উপেক্ষা করিবেন কোন মুখে? প্রতিবাদের ভাষা পাইবেন কোথায়? অথচ চিত্রলেখার মেয়েকে দান করিয়া বসিবার স্পর্ধাই বা কোথায়?
তাই সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে গোছ সুরে বলেন–আপনার ঘরে যাবে সে তো পরম সৌভাগ্যের কথা, তবে নেহাৎ ছেলেমানুষ
–ছেলেমানুষ তা দেখতে পাচ্ছি বৈকি, আমার নাতিটাও ছেলেমানুষ যে। অপেক্ষা করব বৈকি, দু-এক বছর অপেক্ষা করব আমি, কিন্তু ক্ষমা করবেন আমায়–এ মেয়েকে ছাড়বার উপায় আমার নেই। এর মুখে রাধারাণীর ছায়া দেখতে পাচ্ছি আমি। আমায় কথা দিন।
হেমপ্রভা কুণ্ঠিতভাবে বলিলেন–আপনার ঘরে কাজ করতে পেলে আমি তো ধন্য মনে। করব, কিন্তু ছেলেকে না জানিয়ে
–নিশ্চয়, জানাবেন তো বটেই,–কিন্তু আপনি ছেলের মা সেটা তো মিথ্যে নয়? আপনার কথা বিলেতের আপীল। তার ওপর আর কথা কি! অবিশ্যি আমার নাতিকেও আগে দেখুন আপনি…ওরে কে আছিস…বুলুবাবুকে ডেকে দে তো!
একটি ভৃত্য আসিয়া কহিল–দাদাবাবু ঠাকুরের সিংহাসনে নিশেন খাড়া করছে
–আচ্ছা একবার আসতে বল, বলবি আমি ডাকছি।
হুকুমটা দিয়া কান্তি মুখুজ্জে বোধ করি একবার মনে মনে হাসেন…সুন্দরী নাতনীটির জন্য দ্বিধায় পড়িয়াছে…রোসো, তোমাকেও আমার মত ফাঁদে পড়িতে হয় কিনা দেখ!
হ্যাঁ, ফাঁদে পড়িতে হয় বৈকি, একেবারে অথৈ জলে পড়িতে হয় যে! স্বপ্নের কল্পনা যদি প্রত্যক্ষ মূর্তি ধরিয়া সামনে আসিয়া দাঁড়ায়, দিশাহারা হইয়া পড়া ছাড়া উপায় কি?
ঠিক এমনি একটি তরুণ সুকুমার কিশোর মূর্তির কল্পনাই করিতেছিলেন নাকি হেমপ্রভা? দেবতা ছলনা করিতে আসিলেন না তো? তা নয় তো এ কি অপূর্ব বেশ! চওড়া জরির আঁচলাদার সাদা বেনারসীর জোড় পরা, কপালে শ্বেতচন্দনের টিপ। জুতাবিহীন খালি পা দুইখানির সৌন্দর্যই কি কম! হাতে একটা লাল শালুর নিশান। পিতামহের আহ্বানে আসিয়া হঠাৎ এতগুলি অপরিচিত মুখ দেখিয়া অবাক হইয়া দাঁড়াইয়াছে…
না, তাপসীর মত অত উজ্জ্বল গৌর রং নয় বটে, কিন্তু প্রথম ফায়ূনের কচি কিশলয় কি গৌর? সে কি কম উজ্জ্বল? মুখশ্রী গঠনভঙ্গী যে তাপসীর চাইতেও নিখুঁত, একথা অস্বীকার করিবার উপায় থাকে না হেমপ্রভার।
–এই যে এসেছ! কি হচ্ছিল?
এতগুলি অপরিচিত মূর্তির সামনে নিজের ছেলেমানুষী প্রকাশ করিবার ইচ্ছা বোধ করি বুলুর ছিল না। পিতামহের এ রকম অহেতুক প্রশ্নে মনে মনে চটিয়া গম্ভীরভাবে বলে সিংহাসনের ওপর নিশেনটা লাগাবো।
–তা বেশ। কিন্তু দেবতার মাথার ওপর আবার একটা শালুর নিশেন খাড়া করা কেন বল । তো?…বলিয়া সকৌতুকে হাসিতে থাকেন কান্তি মুখুজ্জে।
বুলু আরও গম্ভীরভাবে বলে–তাতে কি? রথের চুড়োয় নিশেন দেন না?
–ঠিক ঠিক, নিশ্চয় তো বটে, আমারই ভুল। আচ্ছা এসো, প্রণাম করো এঁকে– মণীন্দ্রবাবুর মা ইনি। মণীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়–বুঝেছ তো? ঈশানপুর, কুসুমহাট ইত্যাদি ওঁদের।
কান্তি মুখুজ্জের প্রকাণ্ড জমিদারির ঠিক সীমানাতেই এই সব মাঝারি তালুক। তবু বিবাদ বিসম্বাদের প্রয়োজন হয় নাই কোনদিন।