হায়, তাপসী কেন কিছুই বলিতে পারে না? . সমস্ত ভাল ভাল কথাগুলো বুলুই বলিয়া লইবে? সে কথা কি তাপসীও ভাবিতেছে না? তবু নিজেকে ধরা দিবার একান্ত বাসনাকে গলা টিপিয়া মারিয়া, নিজের মনকে যাচাই করিতে হইতেছে তাহাকে–এ ব্যক্তি যদি কিরীটী না হইয়া কেবলমাত্র বুলু’ হইত, কি করিত সে? স্বামী বলিয়া বিনা দ্বিধায় সমর্পণের মন্ত্র পড়িতে পারিত?
কিন্তু এ কথাও কি বলা যায় না–কিরীটীকে দেখিবামাত্র সমস্ত প্রাণ যে তাহার কাছে আছড়াইয়া পড়িতে চাহিত, সে বুলু’ বলিয়াই। কই, আর কবে কাহার উপর এ আকর্ষণ অনুভব করিয়াছে তাপসী?…অথচ এ-হেন অলৌকিক কথা কে বিশ্বাস করিবে? বিশ্বাস করিবার মত কথা কি?
বুলু বোধ করি কোনো একটু উত্তরের আশায় মিনিটখানেক চুপ করিয়া থাকিয়া বলে–আমি তোমাকে বুঝতে পারছি তাপসী, মনকে প্রস্তুত করে নেবার অবসর পাওনি তুমি। অপেক্ষা করে থাকব সেই আশায়। কিন্তু চলো তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি। নানি হয়তো খুঁজবেন, নাটমন্দিরে বসে রয়েছেন।
নানি! ও তাই তো! তাপসী তো এখানে হঠাৎ আকাশ হইতে আসিয়া পড়ে নাই! আশ্চর্য, কিছুই মনে ছিল না!
বুলু উঠিতে বলিলে কি হইবে, তাপসীর কি উঠিবার ক্ষমতা আছে? উঠিয়া পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ই যে এই স্বর্গসুখ চিরদিনের মত ফুরাইয়া যাইবে! সত্যই যদি এমনই বসিয়া থাকা যাইত! অনন্ত দিন–অনন্ত রাত্রি।
বুলু আবার হঠাৎ একটু হাসিয়া উঠিয়া বলে–হঠাৎ যদি কেউ দেখে ফেলে কি ভাববে বলল দেখি? পারলে না বলতে? ভাববে সদ্য বিয়ের বর-কনে! তোমার শাড়ীটা ঠিক নূতন কনের মত–আর আমি–আমি তো বল্লভজীর বেগার খাটতে বরসজ্জা করেই বসে আছি। লোকে হয়তো ভাববে দু’জনে বাসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে একটু নির্জন অবসরের আশায়, তাই না? মনে হচ্ছে যেন ঠিক অবিকল এই রকম শাড়ীতেই প্রথম দেখেছিলাম তোমায়। ওই কলকাতার বাড়ীতে তো কোনদিন এমন অপূর্ব মূর্তি নিয়ে দেখা দাওনি তাপসী! এ যেন এখানকার তুমি!
এত কথার উত্তরে তাপসী শুধু বলে–সেই শাড়ীটাই।
–সত্যি? আশ্চর্য তো! এখনও রয়েছে? এতদিন পরে আবার হঠাৎ এইখানেই আজ তোমার পরতে ইচ্ছা হল? সবটাই আশ্চর্য!
এবারে তাপসী মুখ তুলিয়া বড় স্পষ্ট করিয়া তাকায়। ম্লান হাসির সঙ্গে বলে–আমার জীবনের তো সবটাই আশ্চর্য! চলুন–কবে ফিরবেন কলকাতায়?
–ফেরবার দিনের প্রোগ্রাম যা কিছু ছিল, সবই তো বাতিল হয়ে গেল। পরে ভেবেছিলাম আজই চলে যাব, তাও ইচ্ছে হচ্ছে না। এই দেশটায় তুমি আছ ভাবতেও ভালো লাগে। একটু থামিয়া সামান্য হাসিয়া বলে–ফেরার সময়কার ছবিটা সম্বন্ধে কত কল্পনাই করেছিলাম বোকার মত!
সহসা আবার একটা আকস্মিক ভূমিকম্পের প্রবল আলোড়নে যত্নে-গঠিত অভিযানের প্রাসাদ বিদীর্ণ হইয়া গেল নাকি? নাকি স্বর্গচ্যুত হইবার আশঙ্কায় এতক্ষণে হুঁশ হইল তাপসীর? তাই পাতাল-প্রবেশের পরিবর্তে স্বৰ্গকে দুই হাতে আঁকড়াইয়া আগলাইতে চায়?
–কেন তবে সে ছবি ছিঁড়ে ফেলবে? কেড়ে নিয়ে যেতে পারো না? পারো না জোর করতে? সব দায়িত্ব আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে ফিরে যাবে?
–তাপসী! তাপসী! অজন্তার শিল্পছাঁদে গঠিত ওষ্ঠাধরযুগল নামিয়া আসিয়াছে, অর্ধচন্দ্রের ছাঁদে গড়া শুভ্র একখানি ললাটের উপর।
–তাপসী, এ সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারব তো? এ আমার কল্পনার ছলনা নয় তো?
আকাঙ্ক্ষিত নিতান্ত পীড়নে নিপীড়িত হইয়া অশ্রু-ছলছল চোখে হাসিয়া ফেলে তাপসী। হাসিয়া বলেউঃ, অত বেশী জোর করতে বলিনি তা বলে!
–ইস্ খুব লেগেছে। আমি একটা বুনোহঠাৎ সৌভাগ্যের আশায় দিশেহারা হয়ে ওজন রাখতে পারিনি। আচ্ছা ছেড়ে দিলাম–দেখি তো–তাকাও না একটু, শুভদৃষ্টির সময় তাকিয়ে দেখনি বলেই না এত বিপত্তি! কি হল আবার? মুখে মেঘ নামছে কেন?
–না, ভাবছি–ভাবছি তুমি যদি তুমি না হয়ে কেবলমাত্র ‘বুলু’ হতে, কি হতো!
–কিরীটী গভীর সুরে বলে–প্রায় এই রকমই হত তাপসী। হয়তো কেবলমাত্র ‘বুলু’ আমার চাইতে একটু কম বেহায়া হত। কিন্তু আমার ক্যাপাসিটি তো বারেবারেই প্রমাণ হয়ে গেছে, গৌরব যা কিছু বুলুরই। আমার ভাগ্যে বিয়ের ভয়ে বৌ পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। সত্যি তাপসী, যেদিন সেই উৎসব-বাড়ী থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে তুমি, সেদিন যে কি অদ্ভুত অবস্থা আমার! তবু ভেবে ভেবে মনকে ঠিক দিলাম–আমার প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ রীতিমত প্রবল! তোমার মানসিক দ্বন্দ্বের ছবি চোখ এড়ায়নি–সে সময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম যে তবু ভাল, ছদ্মবেশের আড়ালেই আছি। শুধু প্রার্থীর পক্ষে প্রত্যাখ্যান বরং সহনীয়, দাবীদারের পক্ষে বেজায় অপমান নয় কি? হায় হায়, তখন কি জানি আমার সেই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নয়–দুগ্ধপোষ্য বুলু! জানলে এইরকম জোর করে ধরে শুনিয়ে ছাড়তাম ‘হতভাগ্য কিরীটীই সেই ভাগ্যবান বুলু’! আবার যেদিন হঠাৎ কলকাতার বাড়ীতে পিসিমার চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অমিতাভ গিয়ে জানালে–দেশের বাড়ীতে নানি এসেছে তোমাকে নিয়ে, কি জানি কেন আনন্দে অধীর হয়ে উঠলাম! মনে হল তোমাকে পেয়েই গেলাম বুঝিবা! শেষে আবার কি যে হল–
তাপসী মৃদু হাসির মাধ্যমে বলে–দুর্লভ বস্তু অত সহজে পাওয়া যায় না!
–ঠিক বলেছ তাপসী, খুব সত্যি। তাই এত কষ্ট, এত আয়োজনের দরকার ছিল। চলো দু’জনে গিয়ে প্রণাম করিগে তাকে, যিনি অনেক বুদ্ধি খাঁটিয়ে এমন নিখুঁত আয়োজনটি সম্ভব করেছেন।