–তাপসী, আজকের এই ঘটনাকে কি দেবতার দান বলে মনে হয় না তোমার? আমার তো আজ এদিকে আসবার কোনো ঠিকই ছিল না, সামান্য আগেও না। নিতান্তই পিসিমার উপরোধে পড়ে দেখতে এলাম পুতুলগুলোর অবস্থা–পোটো লাগিয়ে সংস্কার করতে হবে নাকি ওগুলো!…কিন্তু আমি কি ভেবেছিলাম–স্বপ্নেও ভেবেছিলাম–মাটির পুতুলের ঘরে দেখা মিলবে সোনার পুতুলের! এই বল্লভজীর মন্দিরেই প্রথম দেখেছিলাম তোমায়, তাই হয়তো বল্লভজীই ষড়যন্ত্র করে দুইজনকেই টেনে আনলেন তার এলাকায়। এ সৌভাগ্যকে অবহেলা কোরো না তাপসী।
কিন্তু তাপসী কেমন করিয়া বলিবে—’না, অবহেলা করিব না!’ মানসম্রম চুলায় যাক, কিন্তু লজ্জা? দুর্নিবার লজ্জায় যে কণ্ঠ চাপিয়া ধরিয়াছে তাহার। বলিতে পারিলে তো অনেক কথাই বলার ছিল। তাপসীর জীবনেই কি নাই ব্যর্থ সন্ধানের হাস্যকর ইতিহাসঃ পথে পথে, কলেজে, হোস্টেলে, আরো কত সম্ভব-অসম্ভব স্থানে? হায়, তেমন করিয়া গুছাইয়া বলিবার শক্তি তাহার কোথায়?
–উত্তর দেবে না? চুপ করেই থাকবে? বলল কি করবে তুমি?
দ্বিধা কাটাইয়া সহসা মুখ তুলিয়া যে উত্তর দেয় তাপসী, সেটা কেবলমাত্র কিরীটীকেই আহত করে না, যেন তাপসীর কানকেও আঘাত করে। এমন করিয়া তো বলিতে চাহে নাই সে! কিন্তু বলিয়াছে–
–আমাকে আপনারা সকলেই ছেড়ে দিন দয়া করে, যেমন করে হোক একটা কাজ খুঁজে নেব আমি।
–কাজ! কাজ করবে তুমি? কি কাজ? চাকরি?
–ক্ষতি কি?
–লাভ-ক্ষতির হিসেব সকলের সমান নয় তাপসী, কিন্তু থাক, অনুরোধ-উপরোধের চাপে আর বিব্রত করব না তোমাকে। আমার জন্যে তোমার মন প্রস্তুত হয়ে নেই, এই কথাটাই বুঝতে একটু দেরি হয়ে গেল বলে অনেক জ্বালাতন সইতে হল তোমায়। যাক ক্ষমা চাইছি। জানোই তো পৃথিবীতে নির্বোধ লোকের সংখ্যাই বেশী!
অজন্তার ছাঁদে গড়া রেখায়িত অধরে ম্লান একটু হাসি ফুটিয়া ওঠে।
–আচ্ছা চলি। আজকের এই অপ্রত্যাশিত দেখাটা মনে থাকবে, কি বলল? আমি অবশ্য আমার কথাই বলছি।…নানির সঙ্গে এসেছ বোধ হয়? অনেকক্ষণ আছ, খুঁজছেন হয়তো।…কবে ফিরবে কলকাতায়?
–কাল। অস্ফুট একটা শব্দ হইতে আন্দাজে ধরিয়া লইতে হয় উত্তরটা।
–বেশী লাভ করতে গিয়ে সবই হারাতে হল, তাই না তাপসী? এর পর দৈবাৎ কোনোদিন দেখা করতে গেলেও হয়তো ধৃষ্টতা হবে, কি বলল? মাটিতে লুটাইয়া পড়া উত্তরীয়ের আঁচলটা কুড়াইয়া লইয়া ধীরে ধীরে ফিরিয়া যায় কিরীটী।
.
অবাক নেত্রে চাহিয়া থাকে তাপসী। চলিয়া গেল? তাপসীর জীবনে আর কোনোদিন দেখা মিলিবে না ওর? ধূ ধূ মরুভূমির মত শুষ্ক শ্রীহীন জীবন লইয়া করিবে কি তাসী? না না, ছুটিয়া গিয়া ফিরাইয়া আনিবে সে, কিন্তু কেমন করিয়া ফিরাইবে? ছুটিয়া গিয়া পায়ে পড়িবে? নিতান্ত নির্লজ্জের মত দুই হাত দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া আশ্রয় লইবে স্বর্গের দুয়ারে? সকল জ্বালা জুড়াইয়া দেওয়া সেই শান্তির স্বর্গে? ক্ষণপূর্বে মুহূর্তের জন্য যে স্বর্গের আস্বাদ পাইয়া আপনাকে হারাইতে বসিয়াছিল তাপসী?…না–কিছুই পারে না তাপসী, শুধু দাঁড়াইয়া থাকিবার মত ক্ষমতার অভাবেই দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বসিয়া পড়ে ধূলার উপর।
.
কতক্ষণ বসিয়াছিল তাপসী? ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল নাকি? চৈতন্য ছিল তো? সময়ের জ্ঞান হারাইয়া গিয়াছে কেন? …পিঠের উপর আলগোছে একটু স্পর্শ কার হাতের?
–তাপসী চলো, তোমাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আসি। কি মমতা-স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর!–তোমাকে এখানে একা ফেলে চলে যেতে পারলাম না তাপসী, আবার এলাম নির্লজ্জের মত। চলো–শুধু তোমাকে বাড়ী পৌঁছে দেবার অনুমতিটুকু চাইছি।
কিন্তু অনুমতি দেবে কে? ভিতরে যাহার ভূমিকম্পের আলোড়ন চলিতেছে? শুধু কণ্ঠের স্বরে এত মমতা ভরা থাকিতে পারে? যে মেয়ে আবাল্য হাসির আড়ালে সব কিছু গোপন করিয়া আসিয়াছে, সে-ই কিনা কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিল কণ্ঠস্বরের সামান্য একটু স্নেহস্পর্শে? হায় হায়! লজ্জা রাখিবার স্থান রহিল কই? লজ্জা সম্রম সবই যে গেল! অশ্রুকণিকাকে গোপন করা চলে, কিন্তু অসাগরকে?
–তাপসী ওঠো। তাপসী চলো লক্ষ্মীটি! কত লোক ঘোরাঘুরি করছে, হঠাৎ কেউ এদিকে এসে পড়লে হয়তো কি না কি ভাববে!
–কেন ভাববে? কিছু ভাববে না কেউ। যাব না আমি। এতক্ষণে কথা বাহির হয় তাপসীর মুখে।
–যাবে না? কিরীটী মৃদু হাসে–আমার পক্ষে তো শাপে বর! তাহলে এইভাবে বসে থাকা যাক, কি বলো? বলিয়া নিজেও বেনারসীর জোড়সমেত ধূলার উপর বসিয়া পড়ে, কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখিয়া।
–তাপসী, সত্যই যদি এমনি বসে থাকা যেত চিরদিন, চিরকাল!
ভাঙা মাটির পুতুলগুলার পানে নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলিয়া কি দেখিতেছিল তাপসী কে জানে, বুলুর কথায় মুখ ফিরাইয়া এক নিমেষ চোখ তুলিয়া চায়।
.
আবার কিছুক্ষণ কাটে।
এক সময় সামান্য একটু হাসিয়া বুলু বলে–সত্যিই আমি বড় নির্লজ্জ তাপসী, তুমি আমাকে সহ্য করতে পারছ না, তবু জবরদস্তি করে বসে আছি কাছে। কিছুতেই যেন উঠে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আচ্ছা মাঝখানের এই বছরগুলো কিছুতেই মুছে ফেলা যায় না? সেই যেদিননতুন দৃষ্টি নিয়ে প্রথম তাকিয়েছিলাম পৃথিবীর দিকে–যেদিন জীবনের কোনো জটিলতা ছিল না, কোনো সমস্যা ছিল নাখন মান-অপমানের প্রশ্ন নিয়ে সব কিছুকে বিচার করতে বসতে হত না!