.
কিন্তু এ কী! ফিরিবার পথ কোথায়? পথ আগলাইয়া যে দাঁড়াইয়া আছে, মুখ ফিরাতেই চোখোঁচাখি হইয়া গেল তাহার সঙ্গে। মিস্টার মুখার্জি বলিয়া চিনিবার উপায় নাই। নিতান্তই বুলু। চওড়া জরির আঁচলাদার সাদা বেনারসীর জোড় পরা সুগঠিত সুঠাম দেহরক্তকমলের মত নগ্ন দুখানি পা–অবিন্যস্ত চুলের নীচে মসৃণ ললাটে সাদা চন্দনের একটি টিপ। যুগান্তর পূর্বের সেই কিশোর দেবতার মূর্তি ধরিয়া তাপসীকে কেউ ছলনা করিতে আসিল নাকি?
কি এক অজানা আশঙ্কায় বুক থরথর করিতেছে যে! হায় হায়, তাপসী কেন আসিয়াছিল এখানে? এখন কেমন করিয়া পালাইবে সে? ওর কাছ ঘেঁষিয়া যাওয়া ছাড়া তো আর উপায় নাই! তবে?
মাটির ওই পুতুলগুলোর মত শুধু নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিবে নিষ্পলক দৃষ্টিতে? কিন্তু তাপসী নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিলেই কি সকল সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে? তাপসীর সম্মুখবর্তী এই ছদ্মবেশী দেবমূর্তি তো মন্দিরে অবস্থিত চিরকিশোর মূর্তির মত স্থাণু নয়। সে যে চঞ্চল ব্যাকুল, নিতান্তই অস্থির।
তবে? তবে কেমন করিয়া নিজেকে সামলাইবে সে? কেমন করিয়া কঠিন হইয়া থাকিবে মানসম্ভ্রমের দুর্বহ ভার বহিয়া?
.
হায় ভগবান! সমস্ত মানসম্রম জলাঞ্জলি দিয়া এ কি করিয়া বসিল তাপসী? নিতান্ত অসহায়ের মত নিজেকে কোথায় সঁপিয়া দিল বিনা দ্বিধায়, বিনা প্রতিবাদে?
কোথায় লুকানো ছিল তাপসীর পরাজয়ের শৃঙ্খল? খসিয়া পড়া খসখসে বেনারসী চাঁদরের আবরণমুক্ত স্পন্দিত বক্ষের স্পর্শের ভিতর? আবেগতপ্ত বলিষ্ঠ বাহুবেষ্টনের মধ্যে?
পরাজয়! পরাজয়ে এত সুখ? এমন নিশ্চিন্ত শান্তি? বিজয়ীর নিবিড় আলিঙ্গনের মধ্যে নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করিয়া দেওয়ায় এত তৃপ্তি?
একথা তো আগে কেউ বলিয়া দেয় নাই তাপসীকে!
আবাল্যসঞ্চিত ব্যর্থ বেদনার জ্বালা, সদ্য-প্রজ্বলিত অগ্নিপরীক্ষার জ্বালা, নিজেকে বশে রাখিবার অক্ষমতার জ্বালা সব কিছুই যে জুড়াইয়া গেল!
এই অনাস্বাদিত শাস্তি কি অবাস্তব? এই অজানিত অনুভূতি কি স্বপ্ন? এই নির্জন পরিবেশ, এই পুষ্পগন্ধবাহী চঞ্চল বাতাস, এই চির-আকাঙ্ক্ষিত উষ্ণ স্পর্শ–সমস্তই কি কল্পনা? সত্য হইলে কি এত অনায়াসে হার মানিতে পারিত তাপসী?
না না, মুহূর্তের বিহ্বলতাকে প্রশ্রয় দিবে না সে। পরীক্ষকের কাছে হার মানা যায় না।
.
–ছেড়ে দিন আমায়!
–ছেড়ে? না, না, আর ছেড়ে দেব না তোমায়। কোনদিন না, কখনো না।
তবু ছাড়াইয়া লয় তাপসী। মুক্ত করিয়া লয় নিজেকে পরম আকাঙ্ক্ষিত সেই বাহুবন্ধন হইতে। প্রায় কাঁদো কাঁদো হইয়া বলে–কেন আপনি অপমান করবেন আমায়?
–ছি তাপসী! ও কথা বলতে নেই!
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিরদিন আপনি অপমান করেছেন আমায়। এততেও আশ মেটেনি? আবার চান আমি আপনার কাছেই–আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসে তাপসীর।
কিরীটীর কণ্ঠস্বরও গভীর আবেগপূর্ণ–হ্যাঁ তাপসী, ‘আবার’ নয়–বরাবর চাই, চিরদিনই চাই। দিনেরাত্রে অহরহ চেয়েছি তুমি আমার কাছে এসে ধন্য করবে আমায়। সেই তীব্র আকাক্ষার বশে–ছেলেবেলায় কলেজ কামাই করে ঘুরে বেড়িয়েছি তোমার স্কুলের কাছে, কলেজের রাস্তায়। সন্ধ্যার অন্ধকারে তোমাদের বাড়ীর কাছের পার্কের বেঞ্চিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বোকার মত বসে থেকেছি দোতলার ঘরে জানালার আলোর দিকে তাকিয়ে। কোন ঘরে তুমি থাকো, কোনখানে তুমি বসো কিছুই জানতাম না–তবু বসে থাকা চাই। সাত বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছি কত দেশ-বিদেশে, তবু সর্বদা মনে পড়েছে–কি এক অদৃশ্যসূত্রে বাঁধা আছি তোমার সঙ্গে। ফিরে এসে তাই লোভ সামলাতে পারলাম না, অথচ পারলাম না নিজের পরিচয় দিয়ে সোজাসুজি তোমাকে প্রার্থনা করতে। সাহস হল না। যে বন্ধন আমার কাছে সত্য, তা তোমার কাছে হয়তো নিতান্তই মিথ্যে, এই ছিল আশঙ্কা।
–আর, আর কি যন্ত্রণা আমি পেয়েছি, অহরহ কি যুদ্ধ করতে হয়েছে–তা কি বুঝতে পারেন নি?
–হয়তো পেরেছি, হয়তো পারিনি, বুদ্ধির বড়াই করতে চাই না তাপসী। তবু প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করেছি ছদ্মবেশ মোচন করতে, সহজ হয়ে নিজেকে ধরা দিতে, কিন্তু পারিনি। আমার এই অক্ষমতাই তোমার এই যন্ত্রণার মূল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, যেদিন সমস্ত শক্তি একত্রিত করে প্রতিজ্ঞা নিয়ে গেলাম, ঠিক সেদিনই তুমি অভিমানে ঘর ছাড়লে। চিঠির ভেতর দিয়ে অপরাধ স্বীকার করে চাইলাম তোমার ক্ষমা, নানির কাছে শুনলাম তুমি সে চিঠি পড়লেই না, ছিঁড়ে ফেললে!
–কি লিখেছিলেন তাতে? হালকাভাবে প্রশ্ন করে তাপসী। কি লিখিয়াছিল সে সংবাদ তো নানির কাছে পাইয়াছে।
–কি আর, আমার দুষ্কৃতির কাহিনী। অবশেষে পরিচয় দিলাম অভীর কাছে। সে বেচারা অনুতাপানলে দগ্ধ হতে লাগল।
–আর মা?
–মা? মৃদু হাসে কিরীটীমা এত বেশী গুম হয়ে গেলেন শুনে যে সেই অবধি আর কথাই কইলেন না আমার সঙ্গে। বোধ হয় ভাবলেন আমি তাকে ঠকিয়েছি। কিন্তু আশ্চর্য, চিনতে যদিও না পেরেছিলে, আমার নামটাও কি সত্যি জানতে না তুমি? সেই অদ্ভুত রাত্রে মন্ত্র-উচ্চারণের সঙ্গেও কি কানে যায়নি একবার?
তাপসী মাথা নাড়ে। মুহূর্তে ছবির মত ভাসিয়া ওঠে সেই অদ্ভুত রাত্রের দৃশ্য তাপসীর দৃষ্টির সামনে। হায়, তাপসীর কি জ্ঞান চৈতন্য অনুভূতি কিছুই ছিল সেদিন!