.
কিন্তু এ কি! সব শোক উড়াইয়া চোখ জুড়াইয়া দিলে যে তাপসী! এতকাল আগের শাড়ীখানা কোথায় পাইল সে? টুকটুকে লাল জর্জেটের উপর রূপালি জরির চওড়া ভারী পাড় বসানো সেই শাড়ী–যে শাড়ী পরা লক্ষ্মীরূপ দেখিয়া বুড়ো কান্তি মুখুজ্জের মাথা ঘুরিয়া গিয়াছিল! কে জানে কোথায় কোন্ দেরাজের কোণে পড়িয়াছিল? মূল্যবান জিনিস, এই দীর্ঘদিনের অব্যবহারেও ম্লান হয় নাই। প্রায় তেমনি উজ্জ্বল, তেমনি কোমল আছে।
হেমপ্রভার অনেক ভাবে-ভরা দৃষ্টির সামনে একটু কুণ্ঠিত না হইয়া পারে না তাপসী। ঝোঁকের মাথায় পরিয়া ফেলিয়া বেজায় লজ্জা করিতেছে যে!
–এ কাপড় কোথায় পেলি রে?
কথা কহার উপলক্ষ পাইয়া বাঁচে তাপসী। তাড়াতাড়ি বলে–এখানেই ছিল গো নানি, তোমার সেই প্রকাণ্ড সিন্দুকটার মধ্যে। কত সব শাল র্যাপার পুরনো পুরনো–দেখছিলাম। সেদিন। এ শাড়ীখানা কি করে ঢুকে গেছে তার সঙ্গে কে জানে! তবে দুঃখের বিষয়, পোকায় কেটে দিয়েছে অনেক জায়গায়।
–আহা রে! তাও বলি কাটবে না তো কি করবে? এতদিন যে রেখেছে এই ঢের! কিন্তু এ শাড়ী তোমরা পরলে তো মানায় না বাছা–তোমরা আপিসে যাবে, সাইকেল চড়বে, ট্রামগাড়ীর জন্যে ছুটোছুটি করবে, তোমাদের ওই সব খাকির কোট-পাজামা পরাই উচিত! এ তো বিয়ের কনের শাড়ী!
–ধ্যেৎ! শাড়ীতে যেন লেখা থাকে!…চলো বাপু, ফুলগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে!
–ফুল তো সবই শুকোলো তোমার, দেবতার চরণে আর দিলে কই? নারায়ণ! নারায়ণ! গাড়ী আসিয়া ডাকাডাকি করিতেছে।
.
আগামী কাল ফুলদোল। মন্দিরের সাজসজ্জায়, বিগ্রহের বেশবাসে আসন্ন উৎসবের সমারোহ। ধূপধুনা ও অজস্র সুগন্ধিপুষ্পের সম্মিলিত সুরভিতে বৈশাখী প্রভাতের চঞ্চল হাওয়া যেন কম্পিত মন্থর।
নিজেদের হাতের ফুলের ডালা বিগ্রহের সামনে নামাইয়া দিয়া ঠাকুমা-নাতনী সামনের চাতালের একধারে বসিয়া পড়েন। বৈশাখের শুচিস্নিগ্ধ নির্মল সকালের মতই শুভ্র নির্মল মার্বেলের পাথরের মেঝে–বসিতে লোভ হয়।
উৎসুক দৃষ্টি মেলিয়া চারিদিকে তাকাইয়া দেখে তাপসীবহুদিন আগে আর একবার যে আসিয়াছিল, সেও এমনি বৈশাখী পূর্ণিমার দিন ছিল না? কি অদ্ভুত যোগাযোগ! সেদিনের সেই সুরভিবাহিত এলোমেলো বাতাস কি এতদিন লুকাইয়া ছিল মন্দিরের খিলানে খিলানে, কার্নিশের খাঁজে খাঁজে? তাপসীর সাড়া পাইয়া আজ আবার বাহির হইয়া পড়িয়াছে?
সুগন্ধের মত বিস্মৃত স্মৃতির বাহক এমন আর কে আছে? কালের প্রাচীর অতিক্রম করিয়া মুহূর্তের মধ্যে অতীতকে ফিরাইয়া আনিবার এমন ক্ষমতা আর কার আছে? তাই বিস্মৃত দিনের সেই সোনালী সকালটি যেন সহসা এই ফুলচন্দন ধূপধুনার সৌরভজড়িত উত্তরীয় গায়ে দিয়া একমুখ হাসি লইয়া তাপসীর সামনে আসিয়া দাঁড়াইল।
–আচ্ছা নানি, সেই ঘোড়াটা আছে এখনো? রথের কাঠের ঘোড়াটা?
অকস্মাৎ এ-হেন অভিনব প্রশ্নে চমকিত হেমপ্রভা হাতের জপের মালাটা স্থগিত রাখিয়া বলেন–কি আছে? রথের ঘোড়া?
–হ্যাঁ গো, সেই যে বাবলুবাবুর যা দেখে বেজায় ঘূর্তি লেগেছিল!
–আ কপাল! এত বেশ থাকতে সেই কাঠের ঘোড়াটার চিন্তা! আছে অবিশ্যিই, যাবে আর কোথায়?
–তা চল না, ঘুরে ঘুরে সব দেখি।
হেমপ্রভা অসমাপ্ত মালাগাছটি আবার কপালে ঠেকাইয়া বলেন–দেখবার আর কি আছে? এই যা দেখছি জগতের সারবস্তু। তোর ইচ্ছে হয়, একটু ঘুরেফিরে দেখে আয়। এখুনি হয়ত জয়কেষ্ট গাড়ী এনে ডাকাডাকি করবে।’
তাপসী ইতস্তত করিয়া বলে–কেউ কিছু বলবে না তো?
–ওমা বলবে আবার কি! এই তো এত লোক আসছে, যাচ্ছে, বসছে, পুজো দিচ্ছে, মালা দিচ্ছে–কে কাকে কি বলছে!
–আমি একলা যাব? তুমি যাবে না নানি?
–না ভাই, আর ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছেও নেই, সামর্থ্যও নেই। তুই একপাক দেখে আয় না। পিছনদিকে মস্ত নাকি বাগান করেছে।
তাপসী কুণ্ঠিতভাবে এদিক ওদিক চাহিয়া প্রাঙ্গণে নামে। কেন কে জানে–রংচটা রথ, কাঠের ঘোড়া ও মাটির সখী-পুতুল জড়ো করিয়া রাখা মন্দিরের সেই অবহেলিত দিকটা দেখিবার জন্য কৌতূহল প্রবল হইয়া উঠিয়াছে।
.
মন্দিরের পিছনে এদিকটা একেবারে নির্জন। মন্দিরে আসিয়া ভাঙা পুতুল দেখিবার শখ আবার কার হয় তাপসীর মত! টানা লম্বা একটা দালানের ভিতর গাদাগাদি করিয়া নূতন পুরানো ভাঙা আস্ত অনেক পুতুল। প্রমাণ মানুষের আকৃতিবিশিষ্ট এই পুতুলগুলি দেখিতে মজা লাগে বেশ। ছেলেমানুষের মত কৌতূহলী দৃষ্টি লইয়া দেখিতে থাকে তাপসী।
এত পুতুল সেবারে ছিল না তো কই! বৎসরে বৎসরে নূতন করিয়া যোগ হইয়াছে বোধ হয়! দালানের বাহিরে খোলা মাঠে কাত হইয়া পড়িয়া আছে ঘোড়াটা।
কি আশ্চর্য! এদের কি মায়া-মমতা বলিয়া কিছুই নাই?
‘এদের’ ভাবিতে অকস্মাৎ একটা কথা মনে পড়িয়া মুহূর্তে লজ্জায় লাল হইয়া ওঠে তাপসী।..মন্দিরটা কান্তি মুখুজ্জের না? বুলুর দাদুর?..আসিবার আগে অত খেয়াল হয় নাই তো?
হেমপ্রভা আসিতেছেন শুনিয়া মনটা কেমন চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। ওদের কেউ যদি এখানে উপস্থিত থাকে? কেউ আর কে–রাজলক্ষ্মী! দেখা হইয়া গেলে লজ্জায় মারা যাইবে কিন্তু তাপসী!
চোখের আড়ালে গাড়ী ফেরত দেওয়া যত সহজ, চোখোঁচাখি হইয়া প্রত্যাখ্যান তত সহজ কি? থাক বাবা, আর ভাঙা পুতুল দেখিয়া কাজ নাই! নিজের ভাঙা ভাগ্য লইয়া তাড়াতাড়ি সরিয়া পড়াই ভাল!