হেমপ্রভা আর্তপ্রশ্ন করিয়াছিলেন–আর এই যে তুই ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলি বর খুঁজতে, সেই বরকে পেয়ে ছাড়বি? এমন করে ফিরিয়ে দিলে ওকি আর কখনো সাধতে আসবে?
হৃদয়ের সমস্ত শক্তিকে একত্র করিয়া মুখের হাসি বজায় রাখিয়াছিল তাপসী–তা কি করব বলো নানি? সকলের কি বর জোটে? আমার অদৃষ্টে বরের বদলে শাপ!
হেমপ্রভা কপালে ঘা মারিয়া বলিয়াছিলেন–এ কি সর্বনাশা বুদ্ধি তোর মাথায় খেলছে তাপস? ভগবান নিজে হাতে করে এত বড় সৌভাগ্য বয়ে এনে দিচ্ছেন, তুই এতটুকু ছুতোয় অবহেলা করে ফেলে দিবি সে সৌভাগ্য? অভিমানটাই এত বড় হল?
–অভিমান কিসের? শুধুই মান, নানি? মা বসুমতী যে আজকাল বুড়ো হয়ে কালা হয়ে গেছেন, ডেকে মরে গেলেও তো বেচারা মেয়েদের মানসম্রম বাঁচাতে দ্বিধা হয়ে কোল দেবেন না! তা নইলে তো পরীক্ষার জ্বালায় পাতালে প্রবেশ করেই বাঁচতাম!
.
অগত্যাই রাগ করিয়া উঠিয়া গিয়াছেন হেমপ্রভা। ওদিকে রাগ জানাইতে জলস্পর্শ না। করিয়াই চলিয়া গিয়াছে অমিতাভ। আর–আর নাকি ম্লান হাসি হাসিয়া বিদায় লইয়াছে বুলু।
তাপসী রহিয়া গিয়াছে একা। তাপসীকে যেন একযোগে ত্যাগ করিয়া গিয়াছে সকলে।
তবে কি তাপসীর ভুল? প্রচণ্ড যে দুইটো সমস্যার জট তাপসীর জীবনকে জটিল করিয়া তুলিয়াছিল, এত সহজে সে জট খুলিয়া যাওয়ায় ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ হওয়াই উচিত ছিল তার? সকল দ্বন্দ্বের অবসানে কাম্য প্রিয়তমকে লাভ করিয়া কৃতার্থচিত্তে দশের একজন হইয়া বেড়াইতে পারিলেই স্বাভাবিক হইত?
না, তা হয় না। সুখের বদলে সম্মান বিকাইয়া দেওয়া যায় না। সুখ বিদায় হোক–সম্মান থাক জীবনে।
হেমপ্রভা আর কাশী ফিরিয়া যাইবার গোছগাছ করিতেছেন। মিথ্যা আর এখানে বসিয়া থাকিয়া লাভ কি! উঁচু মাথাটা তো হেঁট হইয়াই ছিল, তবু কি বিধাতার আশা মেটে নাই? মাটির সঙ্গে মিশাইয়া ছাড়িলেন? যাক, আর কেন? রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে অনেক পরামর্শ করিয়া অনেক আশা লইয়া দেশে আসিয়াছিলেন, সব আশায় ছাই দিয়াছে তাপসী নিজে!
এতদিনে হুঁশ হইতেছে হেমপ্রভার, তাপসী চিত্রলেখারই মেয়ে! দেখিতে যতই নিরীহ হোক, জিদে মার চাইতে একবিন্দুও খাটো নয়! যাক, হেমপ্রভার বিধিলিপি এই। তাপসীর ‘ভাল’ করিবার ভাগ্য তাহার নয়।
রাজলক্ষ্মীকে মুখ দেখাইবার মুখ আর নাই। দুই-দুইবার শুভদিন দেখিয়া গাড়ী পাঠাইয়াছিল রাজলক্ষ্মী বৌ লইয়া যাইত, শূন্য ফিরিয়া গিয়াছে সে গাড়ী।
তাপসীর নাকি স্বামীর ঘরে ‘বৌ’ হইয়া ঘর করিবার স্পৃহা আর নাই! কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়া চাকরি করিবে সে!
আরও থাকিবেন হেমপ্রভা? গলায় দড়ি দিবার বয়স নাই, তাই বাঁচিয়া থাকা? যাত্রার আগের দিন একবার…হয়তো শেষবারের মতই বল্লভজীর মন্দিরে যাইবার ব্যবস্থা করিতেছিলেন হেমপ্রভা। গাড়ীর কথা বলা আছে, মালী ফুল ও মালা লইয়া আসিলেই হয়। বেলা হইয়া যাইতেছে বলিয়া ঘরবার করিতেছেন, হঠাৎ চাহিয়া দেখেন তাপসী আসিতেছে ছোট একটা ডালায় ফুল লইয়া, অর্থাৎ ভোর হইতে বাগানেই ছিল সে!
এ কয়দিন আর ঠাকুমা-নাতনীতে খুব বেশী কথাবার্তা ছিল না, দুইজনেই চুপচাপ গম্ভীর। আগে হইলে হয়তো তাপসী কলহাস্যে ছুটিয়া আসিয়া বাগানের ফুলসম্ভারের উচ্ছ্বসিত বর্ণনায় মুখর হইয়া উঠিত, নয়তো হেমপ্রভাই ফুলরাণী’র সঙ্গে তুলনা করিয়া মুখর হইয়া উঠিতেন নাতনীর রূপের প্রশংসায়। আজকের মনের অবস্থা অন্য। তাই হেমপ্ৰভা শুধু চোখ তুলিয়া চাহিয়া দেখেন, আর তাপসী ধীরে ধীরে কাছে আসিয়া ম্লানহাস্যে বলে–চলো নানি, তোমার সঙ্গে গিয়ে একটু পুণ্য অর্জন করে আসি।
-তুমি কোথায় যাবে? তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করেন হেমপ্রভা।
–সেই যে কোথায় তোমার সেই ‘রাইবল্লভ’ না ‘রাধাবল্লভ’ আছেন, দেখেই আসি একবার জন্মের শোধ!
–বালাই ষাই! নিজের অজ্ঞাতসারেই অতি ব্যবহৃত এই কল্যাণমন্ত্রটুকু উচ্চারণ করিয়া হেমপ্রভা বলেন–আর তার ওপর দয়া কেন? তার তল্লাট থেকে চলেই তো যাচ্ছ মুখ ফিরিয়ে।
–কে যে কার দিক থেকে মুখ ফেরায়, কে যে কখন বিমুখ হয়, সব কি আমরা বুঝতে পারি নানি? চলো না দেখেই আসি তোমাদের দয়াল প্রভুকে!
হেমপ্রভা ঈষৎ গম্ভীর হইয়া বলেন–ব্যঙ্গ করে দেবদর্শনে যেতে নেই বাছা, তোমার আর গিয়ে কাজ নেই!
-না নানি, ঘুরেই আসি। ব্যঙ্গ তোমার প্রভুকে করছি না, করছি তার নামটাকে! কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন আর কাকে বলে!
–নিজের চোখ কানা হলেই তাকে কানা দেখে মানুষ। হেমপ্রভা রাগিয়া ওঠেন–দয়ার সাগর তিনি, যা দয়া করেছিলেন তোমায়, হিতাহিত জ্ঞানের লেশমাত্র থাকলেও এমন করে সে দয়া অবহেলা করতে না। তাই বলছি–ভক্তি-বিশ্বাস যখন নেই তখন আর কেন যাওয়া!
–তা লোকে তো সং-এর পুতুল দেখতেও যায় বাপু, তাই না হয়, খুব চটছ বুঝি?
-হুঁঃ, আমার আবার চটাচটি! তাও তোমাদের কথায়! যাকগে যাবে বলছ চলো!–তা এই মুহূর্তেই যাবে, না একখানা পরিষ্কার কাপড়জামা পরবে ছেদ্দা করে?
–পরিষ্কার কাপড়! রোসো দেখি, স্টক তত তেমন ভারী নয়! বস্তুত ঝোঁকের মাথায় একবস্ত্রে কলিকাতা ছাড়ার পর, কাশীর বাজারে কেনা খানকতক সাধারণ শাড়ীই আপাতত ভরসা তাপসীর।
হেমপ্রভার প্রাণটা ‘হায় হায়’ করিয়া ওঠে–এ যেন “লক্ষ্মী হয়ে ভিক্ষে মাগা!” রাজার ঐশ্বর্য পায়ে ঠেলিয়া এখন কিনা–উঃ, আধুনিক মেয়েদের চরণে শতকোটি প্রণাম! সর্বস্ব হারাইয়া স্বচ্ছন্দে হাসিয়া বেড়ানো কেবল আজকালকার এই সব বুনো ঘোড়ার মত মেয়েদের পক্ষেই সম্ভব! বুলুর মায়ের দরুন এক বাক্স গহনা আর সোনা ঝলসানো জমকালো একখানা বেনারসী শাড়ী পাঠাইয়া দিয়া বৌ লইতে পাঠাইয়াছিলেন রাজলক্ষ্মী, গাড়ীর সঙ্গে সেগুলাও ফেরত দিতে হইয়াছে। নূতন করিয়া সেই শোক উথলাইয়া ওঠে হেমপ্রভার।