–তাই তো! আর নিজে যে মা নেই বলে যত ইচ্ছে সাজছিস! দেখিস বলে দেব মাকে।
ভিতরে ভিতরে সে আতঙ্ক থাকিলেও তাপসী মুখে সাহস প্রকাশ করিয়া বলে–বেশ বলে দিস। কি বলবি শুনি? মেয়েরা যেন শাড়ী পরে না, গয়না পরে না!
–তোর মত তা বলে কেউ ফুলের গয়না পরে না। এ!
অভিমানী তাপসী বেলফুলের মালাগাছটি গলা হইতে খুলিয়া ফেলিতে উদ্যত হইতেই হেমপ্রভা ধরিয়া ফেলেন–দূর পাগলী মেয়ে! ওর কথায় আবার রাগ? বেশ দেখাচ্ছে। চলো এবেলাই যাই বল্লভজীর মন্দিরে। বোশেখী পূর্ণিমা, আজ সারাদিনই গোবিন্দ দর্শনের দিন। কই, সিধু কই?
–ও তো এখনো প্যান্টে বোম লাগাচ্ছে। বুঝলে নানি, মোটেই পারে না ও। কি মজা করে জানো? ভুল ভুল ঘরে বোতাম লাগায় আর টানাটানি করে ঘেমে ওঠে।
–তা ওদের সব চাকর-বাকরে পরিয়ে দেওয়া অভ্যেস, তুই পরিয়ে দিলি নি কেন?
–আমি? আমাকে গায়ে হাত দিতে দিলে তো? আবার বলে কিনা–সর্দারি করতে আসিস না দিদি। অভীর শুনে শুনে শিখেছে, বুঝলে? নিজে এদিকে মস্ত সর্দার হয়ে উঠেছেন বাবু–বলিয়া হাসিতে থাকে তাপসী।
হেমপ্রভা ডাক দেন–সিধুবাবু, আপনার হলো? আসুন শিগগীর, আর বেলা হলে রোদ উঠে যাবে–গরম হবে।
তিন নাতি-নাতনীকে লইয়া বল্লভজীর মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হন হেমপ্রভা। কলিকাতায় ভালো মডেলের দামী গাড়ি থাকিলেও, এখানে হেমপ্রভার বাহন একটি পক্ষীরাজ সম্বলিত পালকি গাড়ি। কর্তার আমলে জুড়ি-গাড়ি ছিল, এখন প্রয়োজনও হয় না–পোষায়ও না।
.
বল্লভজীর মন্দির নূতন।
পাশের গ্রামের জমিদার কান্তি মুখুজ্জের প্রতিষ্ঠিত নূতন বিগ্রহ ‘রাইবল্লভে’র মন্দির। কান্তি মুখুজ্জের পয়সা শুধু জমিদারিতেই নয়–সেটা প্রায় গৌণ ব্যাপার, আসল পয়সা তার কোলিয়ারির।
দেশের লোকে বলে–টাকার গদি পাতিয়া শুইবার মত টাকা নাকি আছে কান্তি মুখুজ্জের। কান্তি মুখুজ্জে নিজে অবশ্য বৈষ্ণবজনোচিত বিনয়ে কথাটা হাসিয়া উড়াইয়া দেন, কিন্তু সদ্ব্যয়ের মাত্রাটা বাড়াইয়া চলেন।
হেমপ্রভাবাহিনী মন্দিরের কাছে আসিয়া দেখেন সমারোহের ব্যাপার। শুধু বৈশাখী পূর্ণিমা নয়–মন্দির-প্রতিষ্ঠার সাংবাৎসরিক উৎসব হিসাবেও বটে রীতিমত ধুমধাম পড়িয়া গিয়াছে। নাটমন্দিরে নহবৎ বসিয়াছে, কীর্তন মণ্ডপে’ ‘চব্বিশপ্রহর’ শুরু হইয়াছে। নৈবেদ্যের ঘরে জনতিনেক বর্ষীয়সী বিধবা রাশীকৃত ফল ও বঁটি লইয়া বাগাইয়া বসিয়াছেন, ফল ফুল ধূপধুনার সম্মিলিত সৌরভে বৈশাখের সকালের স্নিগ্ধ বাতাস যেন থরথর করিতেছে।
এসব অভিজ্ঞতা চিত্রলেখার ছেলেমেয়েদের থাকিবার কথা নয়, মুগ্ধ বিস্ময়ে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে তাপসী উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় চুপি চুপি বলে কী সুন্দর নানি! রোজ রোজ আসো না কেন এখানে?
–রোজ? কি করে আসব দিদি, মহাপাপী যে! তা নইলে শেষকালটা তো এইখানেই পড়ে থাকবার কথা আমার। কলকাতায় গিয়ে–
–নানি! নানি! পিছন হইতে সিদ্ধার্থর আনন্দোচ্ছ্বসিত কণ্ঠ বাজিয়া ওঠে–ওই ওদিকে ইয়া বড় একটা কি রয়েছে দেখবে এসো! একটা বুড়ো ভদ্দরলোক বললে– ‘রথ’। রথ কি হয় নানি?
–রথে চড়ে ঠাকুর মাসীর বাড়ি বেড়াতে যান।…কই তুমি ঠাকুরপ্রণাম করলে না?
–ওই যাঃ! ভুলে গিয়েছি বলিয়া প্রায় মিলিটারী কায়দায় দুই হাত কপালে ঠেকাইয়াই সিদ্ধার্থ চঞ্চল স্বরে বলে–বোকার মত খালি ঠাকুর দেখছিস দাদা? রথটা দেখবি চল না! সত্যিকার ঘোড়ার মত ইয়া ইয়া দু’টো ঘোড়া রয়েছে আবার!
এরপর আর অমিতাভকে ঠেকানো শক্ত।
অগত্যা হেমপ্রভাকেও যাইতে হয়।
তাপসী অবশ্য এসব শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তে নিবিষ্ট ভাবে ঠাকুরের দিকে চাহিয়া থাকিবার চেষ্টা করিতেছিল–কিন্তু ‘সত্যিকার ঘোড়া’র আকার বিশিষ্ট কাঠের ঘোড়ার সংবাদে হৃদয়স্পন্দন সুস্থির রাখা কি সহজ কথা?
মন্দিরের পিছনে প্রকাণ্ড চত্বরে নানাবিধ মূর্তিধারিণী “রাসের সখী” ও সুউচ্চ রথখানা পড়িয়া আছে। প্রয়োজনের সময় নূতন করিয়া চাকচিক্য সম্পাদন করিতেই হইবে বলিয়া বোধ হয় সারা বৎসর আর বিশেষ যত্নের প্রয়োজন অনুভব করে না কেউ।
ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিতে দেখিতে এবং ‘এত বড় পুতুল গড়িল কে’…‘রথের সিঁড়িগুলা কোন্ কাজে লাগে’…ঠাকুর নিজেই সিঁড়ি উঠিতে পারেন কিনা প্রভৃতি প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হেমপ্রভা যখন ফিরিতেছেন, তখন সামনেই হঠাৎ একটা গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেল—’কান্তি মুখুজ্জে’! কান্তি মুখুজ্জে’! পূজা-উপচার সঙ্গে লইয়া নিজেই মন্দিরে আসিয়াছেন।
জমিদার তো বটেই, তাছাড়া মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা, কাজেই কীর্তনানন্দে বিভোর বৈষ্ণব ভক্তরা হইতে শুরু করিয়া পূজারী, সেবক-সেবিকা, সাধারণ দর্শকবৃন্দ পর্যন্ত কিছুটা ত্রস্ত হইয়া পড়ে।
বরাবর নাম শুনিয়া আসিয়াছেন–কখনো চাক্ষুষ পরিচয় নাই। হেমপ্রভা গায়ের সিল্কের চাদরটা আরও ভালোভাবে জড়াইয়া লইয়া নাতি-নাতনীদের পিছন দিকে সরিয়া যান, কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। উপচার-বাহক ভৃত্যটাকে চোখের ইঙ্গিতে সরাইয়া দিয়া কান্তি মুখুজ্জে নিজে আগাইয়া আসিয়া বলেন–কি খোকা, চলে যাচ্ছ যে? প্রসাদ নেবে না?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি অবশ্য সিদ্ধার্থ। দাদার সামনে প্রতিপত্তি দেখাইবার সুযোগ সে ছাড়ে না। রীতিমত পরিচিতের ভঙ্গীতে কাছে সরিয়া আসিয়া গম্ভীরভাবে বলে–প্রসাদ আমাদের বাড়িতেও অনেক আছে। এদের সব রথটা দেখিয়ে আনলাম, এই যে আমার দাদা দিদি আর নানি।…আচ্ছা। ওই মিস্ত্রীটা কোথায় থাকে?