রাগ দেখাইয়া অভুক্ত অমিতাভও ফিরতি ট্রেনে ফিরিয়া গেল। দিদির ব্যবহার চিরদিনই তাহার কাছে বিরক্তিকর প্রহেলিকা। আগে অবশ্য নিজেই সে কিরীটীকে দুইচক্ষে দেখিতে পারিত না, কিন্তু সে তো পরিচয় জানা ছিল না বলিয়াই! এখন সব দিকেই যখন এত সুব্যবস্থা দেখা গেল, তখনই কিনা বাঁকিয়া বসিল দিদি! খামখেয়ালের কি একটা সীমা থাকা উচিত নয়? দিব্য তো প্রেমে পড়িয়াছিলে বাবা, এখন সত্যকার স্বামী জানিয়াই সে সব উবিয়া গেল? ঈশ্বর জানেন–সেই বিবাহ-প্রস্তাবের দিন তলে তলে কি মারাত্মক ঝগড়াঝাটি হইয়াছিল, তা নয় তো কখনো সেই আসর হইতে নিরুদ্দেশ হয় মানুষ?
তাপসীর নিরুদ্দেশ হওয়ার পর, পাটনা হইতে ঘুরিয়া আসিয়া কিরীটী যেদিন কেবলমাত্র অমিতাভর কাছেই আপন পরিচয় ব্যক্ত করিয়া ক্ষমা চাহিল, সেইদিন হইতে তাহাকে এত বেশী ভালবাসিতে শুরু করিয়াছে অমিতাভ যে ভালবাসাটা প্রায় পূজার পর্যায়ে উঠিয়াছে।… এ হেন ব্যক্তি, অমিতাভ যাহাকে দেবতার কাছাকাছি তুলিয়াছে, তাহাকে কিনা স্রেফ অপমান করিয়া তাড়াইয়া দিল দিদি! ‘পাকা দেখা’র দিন বাড়ী ছাড়িয়া পালানোর স্বপক্ষে তবু একটা যুক্তি আছে, কিন্তু এ যে না-হোক অপমান!… অপমান ছাড়া আর কি! কাহারও সঙ্গে দেখা করিতে আপত্তি জানানোই তো অপমান করা!
.
প্রকাণ্ড বাড়ীর নিতান্ত নির্জন একটি কোণ বাছিয়া স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া ছিল তাপসী।
স্তম্ভিত বৈকি। নিজের ব্যবহারে, কিরীটীর ব্যবহারে–বোধ করি স্বয়ং বিধাতাপুরুষের। ব্যবহারেও স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছে সে। তাপসীকে গড়িয়া জগতে পাঠানোর পর তাপসী সম্বন্ধে এত সচেতন কেন তিনি? ভুলিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন না–অবিরত তাহাকে পিটিয়া পিটিয়া আর কোনভাবে গড়িতে চান? আচ্ছা-সাবিত্রীর দেশের মেয়েদের গঠনকার্যটা কি তিনি ইট কাঠ দিয়া করেন? রক্ত-মাংস থাকে না? হৃদয়’ বলিয়া কোনো বস্তু থাকিবার আইন তাহাদের। নাই? সেই অন্যায় আইন অমান্য করে নাই কেন তাপসী? কেন হৃদয়ের অনুশাসন মানিয়া যা খুশী করে নাই এতদিন?
মন ভাসিয়া যায় অন্য স্রোতে।…চিরদিনের স্বপ্নময় ‘বুলু’ই কিনা মিস্টার মুখার্জি।–এত কাণ্ডের পরও ঠিক যেন বিশ্বাস হয় না!..আচ্ছা, কোন্ নামটা মানায় তাহাকে? ‘কিরীটী’ না ‘বুলু’? বুলু বুলু বুলু! তাপসীর আবাল্যের ধ্যানের মন্ত্র। কিরীটীর মূর্তিটা কিছুদিনের জন্য তাহার বুদ্ধিটাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু নাম?…নাঃ, নামটাকে কোনোদিন প্রাধান্য দেয় নাই তাপসী। “মিস্টার মুখার্জি” ছাড়া আর যে কোন সংজ্ঞা আছে তাহার, সে কথা মনেই পড়ে ই কোনোদিন। কিরীটী নামটা কবে কখন প্রাণে সাড়া জাগাইয়াছে! সে নামটা ছিল কেবল পরিচয় মাত্র! সত্য ছিল মানুষটা!
কিন্তু ‘বুলু’ শব্দটা তো কেবলমাত্র একটা নাম নয়, ওটা যেন একটা ধ্বনিময় অনুভূতি–যে অনুভূতি মিশাইয়া আছে তাপসীর সমস্ত সত্তায় সমগ্র চৈতন্যে।..সেই বুলু নাকি হেমপ্রভার কাছে অকপটে স্বীকার করিয়া গিয়াছে, সেও তাপসীকে সেই বিবাহের রাত্রি হইতেই রীতিমত ভালোবাসিতে শুরু করিয়াছিল। এই দীর্ঘকাল ধরিয়া তাপসীকে পাইবার স্বপ্নই ছিল তার ধ্যান জ্ঞান ধারণা।
তবু যে কৃতি হইয়া আসিয়া এক কথায় প্রার্থনা করিয়া বসে নাই, সেটা যদিও অনেকটাই চক্ষুলজ্জা, অথবা সাহসের অভাব, তবু গ্রহণ করিবার আগে একবার পরীক্ষা করিবার লোভটুকু সংবরণ করিতে পারে নাই সে। সেই লোভেই আপন পরিচয় গোপন করিয়া এ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করিয়াছে।
অর্থাৎ তাপসীর ধারণা ভুল নয়। যাচাই!
হেমপ্রভা বলিতেছেন, অন্যায় কিছুই করে নাই বুলু। সত্যই তো–অতকাল আগের সেই কচি কিশলয়টি এতগুলো বৎসরের রৌদ্রে তাপে হিমে ঝড়ে বিবর্ণ হইয়া যায় নাই, স্নান হইয়া যায় নাই, ঠিক তেমনই আছে, এ প্রমাণ সে পাইবে কোথায়! পরীক্ষা করিয়া দেখিবার ইচ্ছাটা স্বাভাবিক বৈকি। সেই ইচ্ছার বশেই চিত্রলেখার পরিবারের কাছাকাছি আসিবার সুযোগ সৃষ্টি করিয়া লইতে হইয়াছে তাহাকে অনেক চেষ্টায়, অনেক কৌশলে।…অবশ্য চিত্রলেখার চোখে পড়িবার পর আর বেশী পরিশ্রম করিতে হয় নাই তাহাকে। অজস্র সুযোগ তিনিই সৃষ্টি করিয়া দিয়াছেন।
.
হয়তো হেমপ্রভার কথাই ঠিক।
কিন্তু সেই নিদারুণ পরীক্ষা দিতে বুক যার ছিঁড়িয়া পড়িয়াছে–তিল তিল করিয়া পিষিয়া মরিতে হইয়াছে–সে কি বলিবে? বলিবে কাজটা খুব ন্যায্য-খুব ভাল হইয়াছে বুলুর? অহরহ যে যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছে তাপসী, সে যন্ত্রণা কি চোখে পড়ে নাই তাহার? দিনের পর দিন সেই যন্ত্রণা চোখে দেখিয়াও পরীক্ষা করিবার সাধ মেটে নাই? অবশেষে যখন সেই শ্রান্ত অবসন্ন মানুষটা হাল ছাড়িয়া পলাইয়া আসিয়াছে, তখন আসিলেন হাসিমুখে অভয়বাণী শোনাইতে। বিজয়ীর মহিমায় স্বচ্ছন্দ অবহেলায় বলিতে বাধিল না মিথ্যা এতদিন যুদ্ধ করিয়া মরিয়াছ, প্রয়োজন ছিল না! প্রয়োজন ছিল না এত কষ্টের! আমিই তোমার ইষ্টদেবতা, প্রলোভনের ছদ্মবেশে পরীক্ষা করিয়াছিলাম মাত্র!
দীর্ঘ পত্রের মারফৎ সেই কথাই নাকি জানাইয়া দিয়াছিল সে–যে চিঠি কাশীর বাড়ীতে তাপসী অপঠিত অবস্থায় ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছে। কে জানে খুলিয়া পড়িলে আজকের ইতিহাস। অন্যরূপ হইত কিনা। কিন্তু এখন আর বদলানো যায় না। . কোনো কিছুতেই আর প্রয়োজন নাই তাপসীরনা যুদ্ধে, না রাজত্বে। তাই বুক ছিঁড়িয়া পড়িলেও মুখের হাসি বজায় রাখিয়া সে হেমপ্রভার কাছে ঘোষণা করিয়া দিয়াছে–কেউ আমাকে যাচিয়ে বাজিয়ে অবশেষে গ্রহণ করে কৃতার্থ করবে, ওসব বরদাস্ত করতে পারব না বাপু। তোমার আদরের কুটুম্ব এসেছে, সন্দেশ রসগোল্লা খাইয়ে আপ্যায়িত করগে, আমার অন ছাড়ো।