-না নানি, বাপ-মা ভাই-বোন কেউ নেই আমার। নানি!
হঠাৎ যেন কোথা হইতে এক ঝলক মমতা আসিয়া হেমপ্রভার হৃদয়ে আছড়াইয়া পড়ে।…কেউ কোথাও নাই? আহা! তাই অমন স্নেহ-কাঙাল মুখ! জোর করিয়াও বিদ্বেষ আনা যায় না। মুখেও সেই ‘আহা’ শব্দ উচ্চারিত হয়–কেউ নেই! আহা! বাড়ী কোথায় ভাই তোমার?
–এই পাশের গ্রামে।
তাপসী ততক্ষণে সরিতে সরিতে দালানের ওদিকে গিয়া প্রায় দেওয়ালের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। তবু কথাটা শুনিয়া চমকিয়া যায়।…পাশের গ্রামে! কই একথা তো কোনোদিন জানা ছিল না! কিন্তু থাকিবেই বা কেন? তাপসী কি কোনোদিন জানিতে চাহিয়াছে, কিরীটীর ঘর-বাড়ী কোথায়? অনাগ্রহ দেখাইতে গিয়া ভদ্রতাবোধও থাকে নাই সব সময়। মা-বাপ যে নাই, সেটুকুই শুধু আলাপ-আলোচনার ফাঁকে জানা হইয়া গিয়াছে মাত্র।
হেমপ্রভা চমকান না, বরং প্রসন্নমুখে বলেন–তাই বুঝি? তাই ভাবছি কোথায় যেন দেখেছি। পাশের গ্রামের তো–ছেলেবেলায় কোনো সূত্রে দেখে থাকব!
–দেখেছেন অবশ্যই। নেহাত ক্ষীণ হলেও যোগসূত্র একটা রয়েছে যখন। বঙ্কিম ওষ্ঠাধরের ভঙ্গিমায় তেমনি বাঁকা হাসি। বিদ্রুপের নয়, কৌতুকের।
হাসিতেছে অমিতাভও। তাহার চাপাহাসির আভায় উজ্জ্বল মুখের পানে চাহিয়া দেখিয়া কেমন যেন বোকা বনিয়া যায় তাপসী।
কি ব্যাপার! যোগসূত্র যাহা আছে তাহাতে নানির সঙ্গে সম্বন্ধ কি আর ঘটা করিয়া বলিয়া বেড়াইবার মতই কথা কি সেটা? তবে? অমিতাভর মুখে যেন কি একটা ষড়যন্ত্রের রহস্য আঁকা। এরা এখানে আসিয়াছে কিসের ফন্দি আঁটিয়া–সেই বিবাহ ব্যাপারটাই আবার কোনোপ্রকারে বাধাইতে চায় নাকি? কিন্তু অভী–
হেমপ্রভা আপন মনেই উত্তর দেন–যোগসূত্র! সে কি? বুঝতে পারছি না তো! কে ভাই তুমি? বাবার নাম কি তোমার?
–বাবার নাম ছিল কনক মুখোপাধ্যায়। কিন্তু সে বললে কি চিনতে পারবেন আপনি? দাদুর নামটাই বরং জানতে পারেন!
–দাদু! কে তোমার দাদু বলো তো? এ অঞ্চলের পুরনো কালের সকলের নামই তো চিনতাম–তবে অনেকদিন দেশছাড়া–ভুলেও যাচ্ছি–
তাপসী অমন করিয়া তাকাইয়া আছে কেন? সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়াই উত্তরটা শুনিতে চায় নাকি–কি বলিবে কিরীটী? কি বলিতেছে?
–ভুলে যাবেন না দোহাই আপনার। আপনি সুদ্ধ ভুলে গেলেই সর্বনাশ! দাদুর নাম ছিল স্বৰ্গত কান্তিচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।…আমি বুলু।
কি চমৎকার হাসিমাখা মুখে কথাটা উচ্চারণ করিল! জিভে বাধিল না–গলায় আটকাইয়া গেল না। অনায়াস-লীলায় কিরীটী উচ্চারণ করিল–আমি বুলু!…এটা কি একটা বিশ্বাস করিবার মত কথা? পরিহাস করিবার আর ভাষা পাইল না?…নাকি অমিতাভর সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া নানিকে ঠকাইতে আসিয়াছে? অমিতাভ আবার কবে ওর বন্ধু হইল? তাপসী চলিয়া আসার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীটা উল্টাইয়া গিয়াছিল নাকি? নানিকে ঠকাইয়া ও কি তাপসীকে গ্রাস করিতে চায়? তাপসীকে ও ভাবিয়াছে কি?
কি বলাবলি করিতেছে ওরা? এসব কথার কোনো অর্থ আছে নাকি? কি বলিতেছে?
–আমার পিসিমা রাজলক্ষ্মী দেবীর চিঠি পেয়েই অবশ্য এসেছি আমি। তবে এখানে অমিতাভই জোর করে আগে এনে হাজির করেছে। চিনি না’ বলে তাড়িয়ে-টাড়িয়ে দেবেন না তো!
ও কি মানুষ? ও কি পাষাণ? তাপসী কি এখনও সজ্ঞানে আছে? কিরীটী নামটা তবে ছদ্মনাম–নাকি সত্য? এই দীর্ঘকালের মধ্যে কই স্বামীর নামটা তো জানিয়া রাখে নাই তাপসী! আশ্চর্য! আশ্চর্য! বুলু যে একটা সত্যকার নাম হইতে পারে না, নিতান্তই আদরের ডাক, তাও খেয়াল হয় নাই কোনোদিন! তাপসী মূর্খ, তাপসী অবোধ-তাপসী বাস্তববুদ্ধিহীন স্বপ্নজগতের জীব!
কিন্তু কিরীটী? সেও কি তাপসীর মত অবোধ? নাকি জানিয়া শুনিয়া বসিয়া বসিয়া মজা দেখিয়াছে! নির্দয় আমোদে এই নিদারুণ যন্ত্রণা দিব্য উপভোগ করিয়াছে! আর তাপসী ওর এই নিষ্ঠুর আনন্দের খোরাক যোগাইয়া আসিতেছে!
কিরীটীর সমস্ত ব্যবহারটাই পূর্বপরিকল্পিত, এইটুকু মাথায় খেলিয়া যাইতেই মাথার সমস্ত রক্ত যেন আগুন হইয়া উঠে। তাপসীকে লইয়া অবিরত কেবল খেলাই চলিবে? আচ্ছা, ওর মতলবটা তবে কি ছিল–ছদ্মবেশের আড়ালে নিজেকে ঢাকিয়া তাপসীকে পরীক্ষা করা নয় তো? তরলচিত্ত তাপসী পুরুষকণ্ঠের আহ্বান মাত্রেই সাড়া দিয়া বসে কিনা তারই পরীক্ষা? হয়তো–হয়তো সে সময় এমনও ভাবিয়াছে–এই-ই স্বভাব তাপসীর, যার-তার ডাকে আপনাকে বিকাইয়া দেওয়া! ভাবিয়াছে আর মনে মনে কতই না জানি হাসিয়াছে! হয়তো আজও ধিক্কার দিতেই আসিয়াছে।
দুরন্ত অভিমানে সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তি উগ্র হইয়া উঠে। বিদ্রোহী হইয়া উঠে। এই ব্যক্তির সঙ্গে নূতন করিয়া গাঁটছড়া বাঁধিতে হইবে? কৃতার্থচিত্তে ওর চরণচিহ্নের অনুসরণ করিয়া যাইতে হইবে ওর ঘর করিতে?
অসম্ভব!
তাপসীর ধ্যানের দেবতাকে ভাঙিয়া চুরি করিল কিরীটী–’বুলু’ বিলুপ্ত হইয়া গেল। কিন্তু তাপসীকে ইচ্ছা করিলেই অধিকার করা যাইবে, একথা মনে করিবার মত ধৃষ্টতা যেন কিছুতেই না হয় ওর! আত্মপরিচয় গোপনকারী কাপুরুষের সঙ্গে তাপসীর কোনো সম্বন্ধ নাই!
হেমপ্রভার বহু সাধ্যসাধনা, অমিতাভর কাটাছটা তীক্ষ্ণ শ্লেষবাক্য, কিছুই যখন টলাইতে পারিল না তাপসীকে, “শুধু একবার দেখা করার প্রস্তাবটা পর্যন্ত অগ্রাহ্য হইয়া গেল, অগত্যাই। তখন ম্লান হাসি হাসিয়া বিদায় লইতে হইল বুলুকে।