অনেক রাত্রে হেমপ্রভা উপরে আসিয়া তাপসীকে ছাদে আবিষ্কার করিয়া অবাক হইয়া যান–এখনও ঘুমোসনি তুই? এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিস?
–ঘুম আসছে না নানি।
–হেমপ্রভা মনে মনে হাসিয়া ওঠেন। না আসাই তো উচিত! এই কি ঘুমের বয়স না ঘুমের রাত্রি! তবু তো মরুভূমির মত জীবন তাপসীর।
ছায়াচ্ছন্ন স্নিগ্নশীতল জীবনেও কি বিরহের রাত্রে ঘুম আসে চোখে? এই ছাদে এমনি শিথিল ভঙ্গীতে হেমপ্রভাও কি দাঁড়াইয়া থাকেন নাই কোনদিন? পরনে নীলাম্বরী-খোঁপায় ফুলের মালা-চোখে প্রতীক্ষার ক্লান্তি আর মুখে অভিমানভার। উৎকর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন–ঘোড়ার খুরের শব্দের আশায় কান পাতিয়া। ঘোড়ায় চড়া ছিল ব্রজেন্দ্রর একমাত্র শখ।
মাথার উপরকার ওই নক্ষত্রের দল আজকের হেমপ্রভাকে দেখিয়া বিশ্বাস করিবে এ কথা-না একযোগে হাসিয়া উঠিবে!
কিন্তু থাক, আজকের সমস্যা হেমপ্রভার নয়–তাপসীর।
যার জীবনের কোন পরিচিত পদধ্বনি নাই।
.
–ঘুম সহজে আসবে না, নতুন জায়গা কিনা। চল্ শুয়ে শুয়ে গল্প করিগে। তোর মা’র আশা করি না, অভী সিধু যদি আসত তো বেশ হত! জীবনের পালা চোকাবার আগে একবার শেষ সাধ মিটিয়ে নিতাম!
হেমপ্রভার জীবনের পালা চুকিবার সময় হইয়াছে কিনা ভগবান জানেন, কিন্তু সাধ মিটাইবার দায়টা পোহাইবার ভার ভদ্রলোক স্বয়ং লইয়াছেন দেখা গেল।
পরদিনই দরজার গোড়ায় ছোটখাটো ঝকঝকে একখানি মোটরগাড়ী আসিয়া হাজির।
সরকার মশাই যে তোক পাঠাইয়া সংবাদ দিয়াছিলেন, সেকথা হেমপ্রভার জানা ছিল না। তিনি অবাক হইয়া যান।
অভী আসিয়াছে! সত্য না স্বপ্ন?
একা নয়–গাড়ীর মালিক এক বন্ধুকে লইয়া। ঠিক সমবয়সী বন্ধু নয়, তবে অসমবয়সী হইলেও মাঝে মাঝে বন্ধু হওয়া যায় বৈকি।
–নানি নানি, দেখছ তো তোমার টানে ছুটে এলাম।
–ওমা, আমার ভাগ্যি। গুরুদেব আমার মনের কথা কানে শুনেছেন। কে খবর দিলে? সরকার মশাই নিশ্চয়? একবার চাঁদমুখগুলি দেখবার জন্যে যে কি উতলা হচ্ছিলাম! সিধু আসেনি বুঝি?
–না, মা’র শরীর ভালো নয়, দু’জনে এলাম না। অবশ্য এক হিসেবে দু’জনেই এসেছি, সঙ্গে একটি বন্ধুলোক আছেন–বলতে পারি না তিনি আবার কার টানে এসেছেন! বলিয়া অমিতাভ দিদির দিকে একটা বাঁকা দৃষ্টি হানে–শ্লেষের নয়, কৌতুকের।
ধক করিয়া ওঠে তাপসীর বুকটা। কে আসিয়াছে সঙ্গে? তাই কি সম্ভব? না না, অমিতাভ যে দু’চক্ষের বিষ দেখে তাহাকে! নিজে সঙ্গে করিয়া আনিবে? পাল কি তাপসী? কিন্তু কে?
একেই তো বাড়ী ছাড়িয়া কাশী পালানোর লজ্জায় তাপসী ছোট ভাইটিকে দেখিয়া তেমন উচ্ছ্বসিত অভ্যর্থনায় ছুটিয়া আসিতে পারে নাই, প্রসন্নমুখে শুধু নানির পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল–এখন অভীর কথায় একেবারেই মূক হইয়া যায় বেচারা।
বেশীক্ষণ চিন্তা করিতে হয় না, অভী দু’এক কথার পরই ব্যস্তভাবে বলে–আরে, ভদ্রলোককে কি গাড়ীতেই বসিয়ে রাখা হবে! যাই ডেকে আনি–দিদি, মিস্টার মুখার্জি এসেছেন –বলিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া যায়।
দিদি তো সেইখানেই জমিয়া হিম। যা আশঙ্কা তাই সত্য! কি সর্বনাশ! অভীটাই বা হঠাৎ এত বদলাইল কেমন করিয়া! কোন ধরনের ঘুষের দ্বারা অভীকে হাত করা যায়!
হেমপ্রভা সচকিত হইয়া বলেন কি বলে গেল অভী? কে এসেছে? সেই হতভাগাটা? আবার এখানেও ধাওয়া করেছে এসে? এ কি বেহায়া লোক গো! খবরদার, তুই সামনে বেরোবি না, বুঝলি?
তাপসীর কি বোধশক্তি আছে এখনও যে বুঝিবে! তাহার সমস্ত স্নায়ুশিরায় অণুপরমাণুতে যে ধ্বনিত হইতেছে শুধু একটা অবোধ্য হাহাকার! চিঠিটা না পড়িয়া ছিঁড়িয়া ফেলার চাইতেই যে দেখা না করিয়া ফিরাইয়া দেওয়া আরও কত কঠিন, সে বোধও আর নাই তাপসীর!
.
‘বেহায়া হতভাগা’টাকে সঙ্গে বহিয়া আনার জন্য মনে মনে অমিতাভর বুদ্ধিকে ধিক্কার দিতে দিতে হেমপ্রভা উঁকি মারিয়া দেখিবার জন্য সিঁড়ির কাছবরাবর যাইতে না যাইতেই অপরাধীযুগল উঠিয়া আসে উপরতলায়।
পর পর দুইটি পদধ্বনি। প্রথম পদধ্বনি তারুণ্যে উচ্ছল অকুণ্ঠ দাবীর, দ্বিতীয়টি যৌবন সংযত কুণ্ঠিত সংশয়ের।
–এই যে নানি আমার বন্ধু–এঁর গাড়ীতেই এলাম আমরা।
অমিতাভর কথার উত্তরে হেমপ্রভা বিরক্তি-তিক্ত স্বর কোনো প্রকারে সহজ করিয়া । বলেন–বেশ বেশ, নিয়ে গিয়ে বসাওগে ঘরে।
–বা রে! ঘরে বসাব মানে? তোমার সঙ্গে ভাব করবার ইচ্ছেতেই তো এখানে আসা এঁর, তাই না মিস্টার মুখার্জি?
অজন্তার ছাঁদে গঠিত ওষ্ঠাধরের ঈষৎ বাঁকা রেখায় একটি কৌতুকহাস্যের রেখা ফুটিয়া ওঠে।
হেমপ্রভা অবাক হইয়া ভাবেন, কোথায় যেন দেখিয়াছেন ছেলেটিকে। ঠিক মনে পড়ে না। কিন্তু ভারি সুকুমার মুখোনি। বিদ্বেষ রাখা কঠিন, তবু তাপসীর সঙ্গে যোগসূত্রের কল্পনায় জোর। করিয়া স্নেহকে আসিতে দেন না। নীরসকণ্ঠে বলেন-আমার সঙ্গে আবার ভাব-আলাপ! সেকেলে বুড়ী আমরা, ভদ্দর সমাজের অযোগ্য!
হো হো করিয়া হাসিয়া ওঠে অমিতাভ।
এদিকে তাপসীর অবস্থা শোচনীয়। দাঁড়াইয়া থাকাও যত অস্বস্তিকর, হঠাৎ চলিয়া যাওয়াও তার চাইতে কম অস্বস্তির নয়।
হেমপ্রভা নিতান্তই অমিতাভর মান বা মন রাখিতে কথা বলিবার জন্যই বলেন কি নাম ছেলেটির?
–কিরীটীকুমার মুখার্জি। উত্তর দেয় অমিতাভ।
-বাপ-মা আছেন তো? ক’টি ভাই-বোন তোমরা? পুনরায় এই একটি মামুলী প্রশ্ন করেন হেমপ্রভা। এবারে সরাসরি কিরীটীকেই করেন।