.
আগে খবর দেওয়া ছিল।
স্টেশনে গাড়ী আসিয়াছিল–দু’পক্ষেরই।
নিজ নিজ আস্তানায় যাইবার প্রাক্কালে আবার একপালা সম্ভাষণশেষে রাজলক্ষ্মী তাপসীকে কোলের কাছে টানিয়া লইয়া যে কথাগুলি বলেন–তাহার সারার্থ এই, এই মুহূর্তেই তাপসীকে নিজের গাড়ীতে উঠাইয়া লইয়া পলাইবার দুর্দান্ত ইচ্ছাকে দমন করিয়া নিতান্তই শুকনো মুখে ফিরিতে হইতেছে তাহাকে, কারণ ঘরের লক্ষ্মীকে তো আর তেমন করিয়া লইয়া যাওয়া যায় না! শুভদিনে শুভলগ্নে বুল নিজে যাইয়া মাথায় করিয়া বহিয়া আনিবে! বুলুকে দেশে আসিবার আদেশ করিয়া চিঠি তিনি কাশী হইতেই পোস্ট করিয়া আসিয়াছেন, রহস্য কিছুই প্রকাশ করেন নাই, শুধু জানাইয়াছেন, বিশেষ কারণে কাশীবাসের সংকল্প ত্যাগ করিয়া ফিরিয়া আসিতে হইতেছে রাজলক্ষ্মীকে, বুলু যেন অবিলম্বে একবার আসে।
এমন ছেলে, চিঠি পাওয়া মাত্র মোটর গাড়ীতেই ছুটিয়া আসিবে ঠিক, আজকালই আসিয়া পড়িবে। অতঃপর সামনেই যে শুভদিন পাওয়া যাইবে–
–আহা, ভদ্রমহিলা ভাবছেন, ওঁর সেই সোনার চাঁদ ভাইপোটির আশায় পথ চেয়ে আছি আমি! গাড়ী ছাড়িবার পর মন্তব্যটি ব্যক্ত করে তাপসী।
যুগান্ত পরে দেশের মাটিতে পা দিয়া হেমপ্রভার উৎসুক দৃষ্টি যেন পথের দুপাশের মাঠঘাট গাছপালাগুলাকেও লেহন করিতেছিল। তাপসীর কথায় অন্যমনস্কভাবে বলেন– তবে কার আশায় আছিস?
–কারুর আশাতেই নয়। দেখো তোমার বরের সেই বিরাট অট্টালিকার গহ্বর থেকে কেউ টেনে. বার করতে পারবে না আমাকে।
হেমপ্রভা সচকিত হইয়া বলেন–এখন থেকে মেজাজ বদলাসনে তাপস, ঠাট্টার কথাই বলতে বলতে সত্যি হয়ে দাঁড়ায়। কথায় বলে–”হাসতে হাসতে কপাল ব্যথা”!
–তবে কি তুমি বলতে চাও নানি, “সেখো ভাত খাবি” বললেই হ্যাংলার মত ‘‘আঁচাবো কোথায়” বলে ছুটে যাব?
–কথার দশা দেখ! ছুটে তুই যাবি কেন–সেই-ই আসবে!
–সে রকম আসার মূল্য কি নানি? পিসির অঞ্চলনিধি সুবোধ বালক পিসির আদেশ পালন করতে আসবে
–তা গুরুজনের আদেশ পালন করা বুঝি খারাপ?
–খারাপ বলছি না নানি, তবু স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কিছু বদল হওয়া উচিত। কই, এতদিনের মধ্যে একবারও কি আমার জন্যে মাথাব্যথা হয়েছে ওর? আমিই না হয় নিরুপায়, ও তো নয় নানি। তবে আমি কেন–
হঠাৎ সমস্ত কৌতুকের ভাষা রুদ্ধ করিয়া ঝরঝর করিয়া জল ঝরিয়া পড়ে ডাগর কালো দুটি চোখের কোল বাহিয়া।
.
বাড়ী ঢুকিতেই নানা লোকের ভিড়ে, নানা কথায়, দীর্ঘ অনুপস্থিতির সুযোগে বাড়ীখানার দুর্দশার আলোচনায় হৃদয়-সমস্যা চাপা পড়িয়া যায়।
ঠাকুমা-নাতনী মহোৎসাহে গোছগাছে লাগিয়া যান। সারাদিনের গোলমালে কিছুই মনে থাকে না, মনে পড়ে রাত্রে বিছানায় যাইবার আগে।
হেমপ্রভা তখনও নীচের তলায়, সরকার মশায়ের সঙ্গে অনেক কথা অনেক আলোচনায় বিভোর। যেসব বিষয়-সম্পত্তি তাপসীর নামে দানপত্র করিয়া গিয়াছিলেন, কি তাহার ব্যবস্থা হইতেছে, আদায়পত্রের হিসাব ঠিক রাখা হয় কিনা, নাতিরা কখনও আসে কিনা, ইত্যাদি কত সহস্র প্রশ্ন।
দূরে সরিয়া গেলে মনে হয় যেন খুব ত্যাগ করিলাম, কাছে অসিলেই ধরা পড়ে–যথার্থ ত্যাগ করা কত কঠিন! চিরবিশ্বস্ত সাধুপ্রকৃতি সরকার মহাশয়কেও মাঝে মাঝে জেরা করিয়া বসিতেছেন।
তাপসীকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার জন্য সাধ্যসাধনা করা সত্ত্বেও সে ‘দায় পড়েছে। আমার, তোমার ওইসব কাগজপত্তর দেখলে গা জ্বলে যায় বাবা”–বলিয়া উপরে পলাইয়া আসিয়াছে।
পলাইয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে বাগানের দিকের এই ছোট ছাদটায়।
সেকেলে বাড়ী। মাপিয়া জুপিয়া অঙ্ক কষিয়া করা নয়, অকৃপণ দাক্ষিণ্যে যেখানে সেখানে ছাদ, বারান্দা, চাতাল ইত্যাদি গাঁথিয়া রাখিয়া গিয়াছেন কর্তারা। বাগানের দিকের এই ছাদটি ভারি চমৎকার। আসিয়া দাঁড়াইতেই এলোমেলো বাতাসের সঙ্গে একটা দূরবিস্মৃত সুগন্ধভার যেন তাপসীর সর্বাঙ্গে আসিয়া আছাড় খায়।
কি এ-কোথায় ছিল এরা–এই চাপা মুচুকুন্দ মল্লিকার দল! যাহারা একদা তাপসীর ঘুমন্ত শিশুমনকে জাগাইয়া কৈশোরের সোনার দরজার চাবি দেখাইয়া দিয়াছিল!
সেই বৈশাখী রাত।… আশ্চর্য, তাপসীর বারো বছর বয়সের পর আর কি কোনোদিন বৈশাখ মাস আসে নাই! কত সময় তো কত জায়গায় ঘুরিয়াছে, কোথাও ফোটে নাই চাপা মুচুকুন্দ মল্লিকা!…মনে পড়িয়া গেল–ফুলের মালা পরার জন্য ছোট ভাইদের কাছে লাঞ্ছনা! আর আর সেইদিনই না–সেইদিনই তো বল্লভজীর মন্দিরে গিয়াছিল তাহারা!
এই পরিবেশ আর এই গন্ধসমারোহের দৌত্যে বড় বেশী স্পষ্ট করিয়া সব মনে পড়িয়া যাইতেছে। কই এতদিন তো এমন করিয়া চোখের উপর ভাসিয়া ওঠে নাই বল্লভজীর রৌদ্রালোকিত প্রাঙ্গণের মাঝখানে সেই ফুটন্ত কমলের মত বক্তাভ দুইখানি পায়ের পাতা, বেনারসীর জোড়ের আলোয় ঝলসানো আঁচলটার ঝকঝকানি, ঈষৎ কোঁকড়ানো রেশমী কালো চুলে ঘেরা উজ্জ্বল একখানি মুখ!…মুখ নয়–মুখের আভাস। মুখটা কিছুতেই মনে পড়ে না, স্মৃতির দরজায় মাথা কুটিয়া ফেলিলেও না।…সেই পায়ের নীচে নিজেকে বিকাইয়া দেওয়া, আজ কি এতই অসম্ভব! কে জানে হয়তো এই আবেষ্টনের মধ্যে নিজেকে আটকাইয়া রাখিলে খুব অসম্ভব নয়!
কোল্টা ধর্ম? কোন্টা ন্যায়?
মাথার উপর যে নক্ষত্রের দল নীচের মানুষের প্রতি অনুকম্পার দৃষ্টি মেলিয়া চাহিয়া আছে, তাহারা কি বলিয়া দিবে তাপসীর কর্তব্য কি?