.
অতএব ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’!
তাপসীর যাওয়া ছাড়া গতি কি? মান খোয়াইয়া মায়ের কাছে তো সত্যি ফিরিয়া যাওয়া যায় না–বিনা সাধ্য-সাধনায়–এমন কি বিনা আত্মানে!
অথচ চিত্রলেখার মনোভাব অনমনীয়।
তবে যাইবার গোছ করিতে করিতে এক সময় সে চুপি চুপি বলিয়া নেয়–দেখ নানি, দেশে গিয়ে আমি যে যার-তার বাড়ীতে থাকতে যাব, তা মনেও কোরো না, বুঝলে? তোমার বরের সেই যে একটা সেকেলে পুরনো ‘পেল্লায়’ বাড়ী আছে, তারই এককোণে থাকতে দিও!
হেমপ্রভা হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–ইস্ তাই বৈকি! কেন, আমার বরের বাড়ী তোকে থাকতে দেব কেন রে? নিজের বরের বাড়ী সামলাগে যা! ·
–দরকার নেই নানি, বাজে জিনিস সামলে। নিজেকে সামলাতে পারলেই বাঁচি এখন আমি। পরিহাসচ্ছলে বলিলেও কথাটায় দুঃখময় সত্যের করুণ সুরটুকু ধরা পড়িয়া যায়। সত্যই তো–নিজেকে সামলানোই কি সোজা? এই দীর্ঘকাল যাবৎ নিজেকে সামলাইয়া চলিতে চলিতে যে কাহিল হইয়া গেল বেচারা!
.
ট্রেনে ‘ধকধক’ শব্দের সঙ্গে সুর মিলাইয়া তাপসীর হৃৎপিণ্ডটাও যেন ‘ধকধক করিতে থাকে। কি করিতে যাইতেছে সে? খেলাঘরের সেই বিবাহটাকে ঝালাইয়া লইয়া অপরিচিত বরের ঘর করিতে যাইতেছে–বিনা আমন্ত্রণে, বিনা আহ্বানে!
তাছাড়া কি? ভিতরে ভিতরে তেমনি একটা আকাঙ্ক্ষাই কি লুকাইয়া নাই?
কিন্তু রাজলক্ষ্মীর আমন্ত্রণটাই কি চরম? লুব্ধ ভিক্ষুকের মত সেইটুকু সুযোগ লইয়া কৃতার্থমুখে দাঁড়াইতে হইবে সেই উদাসীন–হয়তো বা আত্মম্ভরী লোকটার কাছে? শেষ পর্যন্ত তাহার একটু করুণা লাভ করিয়াই ধন্য থাকিতে হইবে হয়তো! কে বলিতে পারে তার কি মতিগতি? রাজলক্ষ্মীর কথাবার্তায় খুব বেশী আস্থা তাহার উপর রাখা চলে না! নেহাতই সাদামাটা বোকাসোকা মানুষ!
তবে? তাপসী এখন করিবে কি? সেই অজ্ঞাতস্বভাব লোকটার করুণার উপর জুলুম করিয়া, অথবা আইনের দাবি লইয়া নিজের ঠাঁই করিয়া লইতে হইবে তাহাকে? ফকির সেই সিংহাসনে বসিয়া থাকিবে দশের একজন সাজিয়া? গহনা কাপড়ের ঝিলিক মারিয়া চরিয়া বেড়াইবে সমাজের মাঠে? অস্বীকৃত সম্বন্ধের জের টানিয়া নির্লজ্জের মত ভিক্ষাপাত্র হাতে ধরিয়া কোন্ মুখে গিয়া দাঁড়াইবে তাপসী? বলিবে কি সে?
কি বলিবেন চিত্রলেখা? কি বলিবে ভাইয়েরা?
আত্মসম্মান-জ্ঞানটা ভারি টনটনে ছিল না তাপসীর।
আর–
আর একখানি মুখ? সেই কি একেবারে উড়াইয়া দেওয়া চলে? অজন্তার ছাঁদে গঠিত সেই ওষ্ঠাধরের ঈষৎ বাঁকা রেখায় যে বাঁকা হাসির ব্যঞ্জনা দেখা দিবে, তার তিক্ততা কল্পনাতেও সহ্য করিবার ক্ষমতা আছে কি তাপসীর?…ভাবিতে গেলেই বুকের ভেতরটা কেমন একটা যন্ত্রণায় মোচড় দিয়া ওঠে। কিরীটীর সঙ্গে সকল সম্বন্ধ ঘুচাইয়া ফেলিতে হইবে–এই কথাটা যতবারই মনে মনে উচ্চারণ করিতে চেষ্টা করে তাপসী, নিজেকে ভারি অসহায় লাগে!
বুলু কে? বুলুর সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ কি? স্বামীত্বের দাবিতে বুলু আসিয়া অধিকার করিয়া লইবে তাহাকে?
‘স্বামী’ শব্দটার মোহই কি তবে বুদ্ধিবৃত্তিকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে তাপসীর? এই শব্দের মোহ আজ যে শক্তি যোগাইতেছে, সে কি চিরদিন যোগাইতে পারিবে? মোহ যখন মূর্তি ধরিয়া দেখা দিবে? মোহকে মনে মনে লালন করা এক, আর মূর্তিকে সহ্য করা আর। প্রায় জীবনব্যাপী সংগ্রাম সত্ত্বেও যে তাপসী হৃদয়ধর্মের কাছে পরাজিত হইয়াছে, একথা তো অস্বীকার করিয়া লাভ নাই! কিরীটীই যে আজ তাহার একান্ত প্রিয় প্রিয়তম, দূরে সরিয়া আসিয়া বড় স্পষ্ট হইয়াই ধরা পড়িয়া গিয়াছে সেইটা!
দুইটা বুড়ীর প্রভাবে পড়িয়া এ কোন্ পথে পা বাড়াইতে বসিয়াছে সে?
–ট্রেনের ধকলে বৌমার মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে, একটু জল খাও না মা! রাজলক্ষ্মী কাশী হইতে সংগৃহীত পেঁড়া ও চমচম বাহির করিতে বসেন।
ট্রেনে তৃষ্ণা তাহারও পায়, কিন্তু বিধবার অত ক্ষুধা-তৃষ্ণার ধার ধারিলে চলে না!
তাপসী প্রতিবাদের ভঙ্গিতে হেমপ্রভার দিকে তাকায়–ভাবটা যেন এত আত্মীয়তা বরদাস্ত হয় না বাপু!
হেমপ্রভা নাতনীকে চোখ টেপেন, অর্থাৎ করুক গে না বাপু, কি আর ফোস্কা পড়বে তোমার গায়ে?
রাজলক্ষ্মীর চোখে এসব ভাববিনিময় ধরা পড়ে না। তিনি সহ চিত্তে খাবার গুছাইতে গুছাইতে বলেন–বুলু আমার পেঁড়ার ভারি ভক্ত, বলে–চারটি বালি-ধুলো মিশানো হলেও জিনিসটা কিন্তু বেশ পিসিমা! নইলে এই তো বর্ধমানের সীতাভোগ মিহিদানা–ছোঁয়ও না!
বিরক্তি সত্ত্বেও হঠাৎ ভারি হাসি পায় তাপসীর। কারণে অকারণে বুলুর প্রসঙ্গের অবতারণা না করিলে যেন চলে না বুড়ীর! ওঁর বুলুর পছন্দ-অপছন্দ, রুচি-অরুচির সমস্ত তালিকা মুখস্থ করাইয়া যেন তৈরি করিয়া ফেলিতে চান তাপসীকে!
বুড়ী, তোমার আশায় ছাই!..আসলে কাহারও ঘর করিবার জন্য সৃষ্ট হয় নাই তাপসী। আপন হৃদয় লইয়া একপাশে পড়িয়া থাকাই তাহার বিধিলিপি। এতদিন স্বামী’ নামক যে দুরতিক্রম্য বাধাটাকে স্বীকার করিয়া লইয়া আপনাকে প্রিয়তমের কাছে নিঃশেষে সঁপিয়া দিবার। উদগ্র কামনাকে ঠেকাইয়া আসিয়াছে, সেই স্বামীর যখন সন্ধান মিলিল, দেখা যাইতেছে তাহার হাতে সঁপিয়া দিবার মত কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। হয়তো বা নিজেরই অজ্ঞাতসারে বেনামী ডাকে নিলাম হইয়া গিয়াছে তাপসী।