হেমপ্রভা বাধা দিয়া উদাসস্বরে বললেন–আমার ছেলে। সে দেখছে বৈকি, সেখানে বসে সবই দেখতে পাচ্ছে! হয়তো এতদিনে তার অপরাধী মাকে ক্ষমাও করেছে!
রাজলক্ষ্মী থতমত খাইয়া বলেন–কেন? তিনি কি—
হেমপ্রভা মাথা নাড়েন, এক যুগ হয়ে গেল। কেউ কারোর কোন খবরই তো রাখি না। আজ বিশ্বনাথ হঠাৎ তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন তাই। দেখি তার কি ইচ্ছে!
মান খোয়াইয়া বলেন না–এইবার তবে তোমাদের বৌ লইয়া যাও তোমরা। শুধু কথা ফেলিয়া রাজলক্ষ্মীর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেন।
রাজলক্ষ্মী হাঁ হাঁ করিয়া ওঠেন–আর কি বিশ্বনাথের ইচ্ছে বুঝতে ভুল করি! এবার আর কোনো বাধা শুনব না, আমার বুলুর হাতে পড়লে কোনো মেয়ে অসুখী হবে না এই ভরসাতেই জোর করে বলছি।
হেমপ্রভা মালাগাছটি কপালে ঠেকাইয়া মৃদু হাসির সঙ্গে বলেন–আমার নাতনী তো তার যুগ্যি নাও হতে পারে বাছা। কিছুই তো জানো না তুমি।
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া ওঠেন, যেন ভারি একটা রহস্য করিয়াছেন হেমপ্রভা।
অতঃপর অনেক জ্ঞাতব্য এবং অজ্ঞাতব্য বিষয়ের আলোচনা হয়, শুধু তাপসী যে কাশীতেই হেমপ্রভার নিকট রহিয়াছে, সেটুকু সুকৌশলে চাপিয়া যান হেমপ্রভা। কেবল বলেন–চলো না, আমার বাড়ী এই তো কাছে। এবেলা আমার কাছেই দুটো দানাপানির ব্যবস্থা হোক।
রাজলক্ষ্মী সামান্য অনুরোধেই রাজী হইয়া যান। হেমপ্রভার সঙ্গে সম্বন্ধ বজায় রাখার গরজ যেন তাহারই বেশী। ‘দানাপানি’ ব্যতীতও রাজলক্ষ্মীর জন্য যে ‘তৃষ্ণার জল’ তোলা রহিয়াছে হেমপ্রভার ঘরে, সেকথা কি স্বপ্নেও ভাবিয়াছিলেন রাজলক্ষ্মী?
.
নানির সঙ্গে একটি বিধবা ভদ্রমহিলাকে আসিতে দেখিয়া তাপসী নিজে হইতে তেমন গ্রাহ্য করে নাই। এমন তো মাঝে মাঝে আসে কেউ কেউ। ঘরের ভিতর হইতে বাহির হইবার বা অপরের সঙ্গে ভদ্রতা রক্ষা করিয়া কথা কহিবার ইচ্ছাও করে না। অজানিত ব্যক্তির সেই চিঠিখানার অজ্ঞাত বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আকাশপাতাল কল্পনা করিতে করিতে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে বেচারা।
স্বাভাবিক দৃষ্টি লইয়া ঘরে ঢুকিলে ছেঁড়া চিঠির কুচিগুলা হেমপ্রভার দৃষ্টি এড়াইত না নিশ্চয়ই, কিন্তু বিশেষ ব্যস্ততা লইয়া ঘরে ঢোকেন তিনি, তাই লক্ষ্য করেন না।
-তাপসী শোন, একজন এখানে খাবে আজ। হ্যাঁ, এ বেলাই। একটু আয় দিকি আমার সঙ্গে –কুটনোবাটনা করে দিবি।
তাপসী অবাক হইয়া বলে–আমি? আমার হাতে খাবে তোমরা?
–ওমা কথা শোনো মেয়ের! তোর হাতে খাবো কিরে? সর্বদা আ-কাঁচা কাপড়ে থাকিস–তাই ছুঁইছুঁই করি, হাতে খাব না কেন? হাড়িদের বৌ নাকি তুই? নে চল্ দিকি, সেই সিল্কের কাপড়টা পরে–
উচ্ছ্বসিত আনন্দের ভাবটা নাতনীর কাছে আর লুকাইতে পারেন না হেমপ্রভা।
তাপসী বিস্মিত দৃষ্টিতে একবার তাকাইয়া দেখিয়া বলে–কে এসেছে নানি, খুব যে খুশী দেখছি! তোমার কোনো বন্ধু না আত্মীয় কেউ?
–আত্মীয় বন্ধু সবই। ভগবান বুঝি মুখ রাখলেন। যাক, তুই আর দেরি করিসনে, আমি যাচ্ছি–ওমা, ঘরভর্তি এত কাগজ ছড়ালে কে? কি এ?
–চিঠি।
–চিঠি! ও, সেই চিঠিখানা বুঝি? ছিঁড়েছিস কেন? কার চিঠি ছিল?
–জানি না।
–জানি না কি কথা! দেখিস নি?
–না।
হেমপ্রভা একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া নাতনীর কাছে আগাইয়া আসেন। তাহার মাথার উপর একটা হাত রাখিয়া আর্দ্রস্বরে বলেন–আমি জানতাম তাপস, ছোট হবার মত কাজ তুই করবি না। আশীর্বাদ করছি তোর দুঃখের দিন এইবার শেষ হোক। আমার সঙ্গে যে এসেছে, বিশ্বনাথ তাকে আজ হাতে তুলে দিয়েছেন। বুলুর পিসি হয় ও–তোর পিসশাশুড়ী। চমকে উঠিসনি, কিচ্ছুটি বলতে হবে না তোকে, শুধু গিয়ে প্রণাম করবি। খাঁটি সোনা বুলু আমার, এখনও তোরই পথ চেয়ে বসে আছে, কোনো ভয় নেই!
.
তাপসী আসিয়া প্রণাম করিয়া দাঁড়াইতেই একেবারের জন্য চমকাইয়া উঠিয়াই যেন স্তব্ধ হইয়া যান রাজলক্ষ্মী।
এই তাপসী? বুলুর বৌ? স্বপ্নের কল্পনাও হার মানে যে! এই বৌ হইতে বঞ্চিত হইয়া আছে বুল? বুলুর মত স্বামীকে লাভ করিয়া ধন্য হইতে পাইল না বলিয়া অপরিচিতা বধুর ভাগ্যেরই নিন্দা করিয়া আসিয়াছেন এতদিন! চিন্তার হাওয়াটা এবারে বিপরীতমুখী বহে।
উঃ, নির্দয়তার মধ্যেও কী অনন্ত দয়া ভগবানের! বুলুর সম্প্রতিকার বিবাহটা ফস্কাইয়া না গিয়া যদি সত্যই ঘটিয়া যাইত! কী সর্বনাশই হইত!!
এ বৌকে রাজলক্ষ্মী কোথায় রাখিবেন? বুকে না মাথায়? না, এবারে আর বোকামি করিবেন না বাবা, আঁচলে বাঁধিয়া লইয়া গিয়া তবে আর কাজ!!
হেমপ্রভার হাতে-পায়ে ধরিতে হয় তাও রাজী। দোষ কি? সম্পর্কে গুরুজন তো! মানের জন্য প্রাণ যাক–অত কুসংস্কার নাই রাজলক্ষ্মীর!
হেমপ্রভাকে অবশ্য হাতে-পায়ে ধরিতে হয় না, নিজেই তো হাত ধুইয়া বসিয়াছিলেন ভদ্রমহিলা। কাশীবাস’ করিবার সাধুসঙ্কল্প অবলীলাক্রমে বিসর্জন দিয়া রাজলক্ষ্মীও যেমন মহোৎসাহে দেশে ফেরার তোড়জোড় করেন, হেমপ্রভাও তেমনি আগ্রহেই দীর্ঘকালব্যাপী কাশীবাসে অভ্যস্ত জীবনকে আপাতত ত্যাগ করিয়া দেশে ফিরিবার ব্যবস্থা করিতে থাকেন।
মন জিনিসটা এমন, একবার ছুটিলে আর ধরিয়া রাখা শক্ত। চিরদিনের প্রিয় আবাসস্থল স্বামীর ভিটার ছবিখানি মনে ফুটিয়া ওঠা পর্যন্ত হেমপ্রভার আর এক ঘণ্টাও দেরি সহে না। কেবলমাত্র তাপসীর হিতার্থেই নয়, নিজের প্রীত্যর্থেও যাওয়ার ইচ্ছাটা এত প্রবল হয়।… হায়, কি মিথ্যা অভিমানেই তিনি সেই পুণ্যভূমিকে ত্যাগ করিয়া বসিয়া আছেন! এ অভিমানের মর্ম বুঝিল কে?…না, শেষ জীবনে একবার গিয়া এতদিনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিয়া আসিবেন হেমপ্রভা।