হেমপ্রভা গম্ভীরভাবে বলেন–তা অনেকদিন। কেন বল তো জানতে চাইছ?
–চাইছি আমার বিশেষ দরকারে মা। আচ্ছা আপনার দেশ কোথায়?
কৌতূহলী হেমপ্রভা এবার ঝোলামাল লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলেন–ঘাট ছেড়ে ছায়ার দিকে চলল তো বাছা, দেখি তুমি কে?
দুইজনেই ছায়ার দিকে সরিয়া যান। ভদ্রমহিলা এবারে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলেন নিজের পরিচয় দেবার মতন না হলেও দেব বৈকি মা, তবু আমার প্রশ্নের উত্তরটা আগে দিন।
হেমপ্রভা অতি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অপরিচিতার আপাদমস্তক দেখিয়া লইয়া সংক্ষেপে বলেন–দেশ আমার বর্ধমান জেলায়।
–গ্রামের নাম? সাগ্রহ স্বর ধ্বনিত হয় ভদ্রমহিলার কণ্ঠে।
–কুসুমপুর। কেন বল তো? চিনতে তো পারছি না কই!
–আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি মা। বিশ্বনাথ মুখ রেখেছেন মনে হচ্ছে। পরিচয় দিলে চিনবেন নিশ্চয়ই। আমি স্বর্গীয় কান্তি মুখুজ্জে মশায়ের ভাগ্নী, বুলুর পিসিমা। চেনেন তো কান্তি মুখুজ্জেকে?
‘চিনি না আবার’! একথা বলিতে ইচ্ছা হইলেও রসনায় যেন শব্দ যোগায় না হেমপ্রভার। এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হইয়া যান তিনি। সত্যই কি তবে ভগবান প্রত্যক্ষ আছেন? এই ঘোর কলিতেও? অন্তরের যথার্থ ব্যাকুলতা লইয়া যা কিছু প্রার্থনা করা যায়, হাতে তুলিয়া দেন তিনি? নাকি হেমপ্রভাকে ছলনা করিতে, ব্যঙ্গ করিতে বুলুর পিসির ছদ্মবেশ ধরিয়া সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন? এখনই আবার মিলাইয়া যাইবে এই মায়ামূর্তি?
বাকশক্তিকে ফিরাইয়া আনিয়া হেমপ্রভা যা বলেন, তাতে কিন্তু অন্তরের এই উচ্ছ্বসিত ব্যাকুলতা ধরা পড়ে না, নিস্পৃহ স্বরে বলেন-আমাকে তো চিনেছ, বলল দিকি কি সূত্রে আমার সঙ্গে পরিচয়?
রাজলক্ষ্মীর হেমপ্রভার মত আপন হৃদয়যন্ত্রের উপর এত নিয়ন্ত্রণ নাই, তাই অর্ধরুদ্ধ উচ্ছ্বসিত স্বরে বলেন–সেকথা আর জিজ্ঞেস করে লজ্জা দেবেন না মা। আপনার কাছে মস্ত অপরাধী আমরা। তবু বলি দশচক্রে ভগবান ভূত। অনেকবার অনেক মিনতি করে লোক পাঠিয়ে পাঠিয়ে হতাশ হয়ে তবেই না চুপ করে গিয়েছি মা! ঘরের লক্ষ্মী ঘরে না এলে কি ঘর মানায়? তা আমারই হতভাগ্যির দোষ, কোনো সাধই মিটল না!
হেমপ্রভা যে কলিকাতার কোন খবরই প্রায় রাখেন না, সেই হইতে নির্বাসিত জীবনযাপন করিতেছেন, সে ধারণা নাই রাজলক্ষ্মীর, থাকিবার কথাও নয়।
–ভাগ্যের দোষ বৈকি বাছা, বিধাতার বিধান রদ করবে কে! তা ভাইপোর আবার বিয়ে দিলে কোথায়? আপন মান বাঁচাইতে হেমপ্রভা এইরকম বাঁকা পথে প্রশ্নটা করেন।
‘আবার বিবাহ দাও নাই তো’–প্রশ্নটা বড় অপমানকর। দিলে কোথায়–এ যেন একটা নিশ্চিত ঘটনা সম্বন্ধে বাহুল্য প্রশ্ন। যেন বিবাহটা অতি সাধারণ একটা সংবাদ মাত্র। যেন ইহার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করিতেছে না হেমপ্রভার।যেন উত্তরের অপেক্ষায় রুদ্ধশ্বাস বক্ষে ইষ্টনাম জপ করিবার দরকার হয় না। যেন রাজলক্ষ্মীর ভাইপোর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু মাথাব্যথা নাই হেমপ্রভার।
এ প্রশ্নটার পরেই দেশের ধানচালের ফলন অথবা মাছ-দুধের মূল্যবৃদ্ধি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে কিছুমাত্র বিকার দেখা যাইবে না বোধ হয়।
রাজলক্ষ্মী এ চাল জানেন না। এইভাবে উৎকণ্ঠাকে দাবাইয়া নিস্পৃহতার ভান করার ‘চাল। তাই হেমপ্রভার প্রশ্নে তিনি যেন মনের আনন্দ চাপিয়া রাখিতে পারেন না। নিজেদের মহত্ত্বের পরিচয় দিবার এত বড় সুবর্ণ সুযোগ–এ কি কম কথা!
যে নিদারুণ ঘটনার জন্যই মনের দুঃখে দেশত্যাগী হইয়াছেন রাজলক্ষ্মী, পোড়ারমুখো বিধাতাকে কমপক্ষে লক্ষবার গালাগাল করিয়াছেন, সেই ঘটনাটাই এখন দেবতার আশীর্বাদ বলিয়া মনে হয়।
অতএব উচ্চাঙ্গের হাসি হাসিয়া অনায়াসেই বলিতে পারেন তিনি বিয়ে! না মা, আমার ভাইপো তেমন ছেলে নয়। মামা যা করে গেছেন, তার ওপর কলম চালানো- সে হতে পারে না। প্রায় পাকিয়া ওঠা বিবাহ’ ফলটি যে হঠাৎ রাজলক্ষ্মীর অজ্ঞাত কারণে পাকিবার পরিবর্তে খসিয়া গিয়াছে, সেটা আর প্রকাশ করেন না।
হেমপ্রভার হাতের মালা দ্রুত ঘুরিতে থাকে। গুরুদেব, মুখ রাখিয়াছ তবে! তাপসীর কাছে নূতন করিয়া অপদস্থ হইবার মত কিছুই ঘটে নাই দেখা যাইতেছে! এখন শুধু স্বভাব-চরিত্র বিদ্যা বুদ্ধি সম্বন্ধে সন্ধান নেওয়া–আছেই বা কোথায় কোনে? তবু প্রায় অবহেলাভরে বলেন–কি করছে এখন ভাইপো?
–বুলু? তা আপনার আশীর্বাদে মানুষের মতন মানুষ একটা হয়েছে। বড় দুঃখু যে মামা কিছুই দেখতে পেলেন না। কত সাধ ছিল তার, তা সে সাধ মিটত। বুলু আমার এখানে দুটো পাস করে জলপানি পেয়ে বিলেত চলে গিয়েছিল। সেখানেও কি সব ভাল ভাল পাস-টাস করে একেবারে চাকরি পেয়ে এসেছে। আটশো টাকা মাইনে। পরে আরো অনেক হবে। চাকরির নামটা বলতে পারলাম না বাপু, খুব ভাল চাকরি।
হেমপ্রভা হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–আমার চাইতে তো ঢের ছোট তুমি, অমন সেকেলে বুড়ীর মত কথা কেন গা বাছা? তা যাক, বিলেত ঘুরে এসে মেজাজটি আছে কেমন–মেম চায় না তো?
রাজলক্ষ্মী জিভ কাটেন। অমন কথা বলবেন না। বুলু কি সেই ছেলে? এখনো বাড়ী গেলেই আমার রান্নাঘরের দোরে খুরসি পিঁড়িতে বসে নারকোলনাড়, ক্ষীরের ছাঁচ চেয়ে খায়, রাইবল্লভের আরতির সময়ে গরদের ধুতি পরে চামর পাখা ঢোলায়। বললে হয়তো ভাববেন বাড়িয়ে বলছি–তবু বলব হাজারে একটা অমন ছেলে মেলে না। আপনার ছেলে ইচ্ছে করে অবহেলা করলেন, এখন দেখলে বলবেন–