হেমপ্রভা আহত অপ্রতিভ ভাবে বলেন-জানি দিদি, বুঝি তোর ওপর সবাই অবিচার করেছে। দারুণ অভিমানে পালিয়ে এসেছিলাম, কর্তব্য ঠিক করতে পারিনি। মণি যখন চলে গেল, তখন আমারই উচিত ছিল যেমন করে তোক তোর আখেরের ব্যবস্থা করা। দেরি হয়ে গেছে, তবু পাপের প্রায়শ্চিত্ত এবার করব আমি। একেবারে তোকে নিয়েই যাব কুসুমপুর। কেউ না থাক, কান্তি মুখুজ্জের প্রতিষ্ঠিত ‘রাইবল্লভের’ মন্দির তো আছেই, সেখানে গিয়ে খোঁজ করব। দেখি সে ছোঁড়া কি করে অবহেলা করে তোকে! শুনেছিলাম বিলেত-মিলেত গেছে নাকি? ভগবান জানেন, মেম বিয়ে করে বসে আছে কিনা! তাহলেও আমি সহজে ছাড়ব না।
তাপসী মৃদু হাসির সঙ্গে বলে–মানুষ তো অমর নয় নানি। তোমার দেওয়া শাস্তিভোগ করতে আসামী টিকে থাকলে তো!
হেমপ্রভা শিহরিয়া ওঠেন। ঠিক এই ধরনের একটা আশঙ্কা কি তাহার নিজেরই নাই? ভাল করিয়া তলাইয়া দেখিলে হয়তো এত নিস্পৃহ হইয়া থাকিবার কারণও তাহাই। কুমারীর মত আছে থাক–কেঁচো খুঁড়িতে গিয়া কি শেষটা সাপ বাহির করিয়া বসিবেন! কিন্তু এ অবস্থাও আর সহনীয় নয়। যা থাকে কপালে, দেশে একবার যাইবেনই তিনি এবার। আর যাই হোক– পিসশাশুড়ী বুড়ীটা নিশ্চয়ই ঠিক খাড়া আছে। বিধবা মেয়েমানুষের কাঠপ্রাণ, ও আর যাইবার নয়। কিছু সুরাহা যদি নাই হয়–আচ্ছা করিয়া একবার দশকথা শুনাইয়া দেওয়ার সুযোগ না হয় তোক।
কেন? দোষ কি শুধু এ পক্ষেরই? কান্তি মুখুজ্জের অবিমৃষ্যকারিতাই কি তাপসীর জীবনটা মাটি করিয়া দিবার যথার্থ কারণ নয়? সে ভুল শোধরানোর চেষ্টা করা উচিত ছিল তাহাদেরই।
রাজলক্ষ্মী যে চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই, সেটা না হেমপ্রভা, না তাপসী কাহারও জানা নাই।
যাই হোক–ভিতরে ভিতরে যত আশঙ্কাই থাক, মুখে দমেন না হেমপ্রভা। যাই যাই করিয়া ওঠেন–অলুক্ষুণে কথা মুখে আনিসনে তাপস। দুর্গা দুর্গা। মেম মায়ের কাছে এই শিক্ষাটাই হয়েছে বুঝি! যা নয় তাই মুখে আনা! মনে রাখিস সাবিত্রীর দেশের মেয়ে তুই। যমের বাবার সাধ্যি হবে না তোর আশার জিনিস কেড়ে নিতে!
তাপসী অবিশ্বাসের হাসি হাসে। হাতের খামখানা খুলিয়া দেখিবার আগ্রহও যেন শিথিল হইয়া যায়। সাবিত্রীর দেশের মেয়ে সে? তাই তো! এ কথাটা এত স্পষ্ট করিয়া কেউ তো কোনোদিন বলিয়া দেয় নাই!
খামখানা হাতের মধ্যে নিপীড়িত হইতে থাকে। না পড়িয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিবার মত মনের জোর থাকিতে পারে না তাপসীর? সাবিত্রীর দেশের মেয়ে হইয়াও না?
গঙ্গাস্নানের দেরি হইয়া যায় দেখিয়া হেমপ্রভা তখনকার মত আর চিঠির বিষয়বস্তু দেখিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন না, ঝোলামাল লইয়া বাহির হইয়া যান।
আর তাপসী? চিঠিখানার বিষয়বস্তু জানিবার প্রয়োজন কি তাহারও নাই আর?
জ্ঞান অবধি যে সংগ্রাম জীবনের সাথী, স্পষ্ট করিয়া আবার একবার তাহার মুখোমুখি দাঁড়াইতে হইতেছে তাপসীকে। লোভের সঙ্গে সতোর সংগ্রাম, বাস্তবের সঙ্গে সংস্কারের। তাপসী কি হার মানিবে? হৃদয়ের সমস্ত শক্তি এক মুহূর্তের জন্য আঙুলের ডগায় কেন্দ্রীভূত করিয়া খামটা একবার ছিঁড়িয়া ফেলিতে পারিলেই তো সব চুকিয়া যায়!
আচ্ছা এমনও হইতে পারে, সব সন্দেহই অমূলক–নেহাৎ কোনো বাজে লোকের চিঠি! লিলির হইতেই বা বাধা কি? বন্ধু বলিতে অবশ্য কেহই নাই তাপসীর, তবু আত্মীয়তার সূত্র ধরিয়া লিলিও তো জিজ্ঞাসা করিতে পারে–তাপসীর অমন সৃষ্টিছাড়া ভাবে পলাইয়া আসার কারণ কি?
অভীও পারে না প্রকাণ্ড এক চিঠি লিখিতে?
তাপসীর পলাইয়া আসার অর্থ জানিতে চাওয়ার অধিকার তাহারও থাকিতে পারে।
কিংবা মা?
তাপসী কিভাবে তাঁহার মুখে চুনকালি লেপিয়াছে, উঁচু মাথাটা হেঁট করিয়া দিয়াছে–সেইটাই শুনাইয়া দিবার মত উপযুক্ত ভাষা হয়তো এতদিনে সংগ্রহ করিয়াছেন তিনি।
টাইপ-মেশিনের নিপ্রাণ অক্ষরগুলো নিতান্তই নীরব দৃষ্টি মেলিয়া তাকাইয়া থাকে, কোনো উত্তর দেয় না।
বোকার মত আগেই ছিঁড়িয়া ফেলার তো মানে হয় না কিছু। তবু হঠাৎ সমস্ত শক্তি একত্রীভূত করিয়া খাম-সমেত চিঠিখানা খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ছড়াইয়া দেয় তাপসী।
না, হেমপ্রভার কাছে খেলো হইতে রাজী নয় সে। বুঝুন তিনি, কাহারও উপর কোনো মোহ নাই তাপসীর। সাবিত্রীর দেশের মেয়ে শুধু যে নিজের ‘এয়োতি রক্ষা করিতেই জানে তা নয়, আপন সম্মান রক্ষা করিতেও জানে।
৪. অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়
জগতে অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়। নিতান্ত কল্পিত গল্পের মত ঘটনাও সত্যসত্যই ঘটিতে দেখা যায় মাঝে মাঝে। দৈবাৎ হইলেও হয়। সেই দৈবাতের ব্যাপার আজ ঘটিতে দেখা গেল হেমপ্রভার জীবনে।
স্পষ্ট করিয়াই বলি। নানা চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতে দিশাহারা হেমপ্রভা যখন স্নানান্তে মালাজপের’ ছুতায় বসিয়া ইতিকর্তব্য চিন্তা করিতেছিলেন, তখন হঠাৎ একটি ভদ্রমহিলা সামনে। আসিয়া সোজাসুজি প্রশ্ন করেন–একটা কথা বলব শুনবেন? কিছু মনে না করেন তো সাহস করে বলি!
বিস্মিতা হেমপ্রভা তাকাইয়া দেখেন–বার্ধক্যের ক্ষীণদৃষ্টি এবং সোজাসুজি রৌদ্রের ঝলসানি, দুটায় মিলিয়া চোখটা কেমন ধাঁধাইয়া দেয়। চিনিতে পারেন না মানুষটা কে?
ভদ্রমহিলা আবার বলেন–মনে হচ্ছে ভুল করিনি, তবু সন্দেহ ভঞ্জন করতে শুধোচ্ছি, কাশীতে আপনি কতদিন আছেন মা?