তাপসী ম্লান হাসির সঙ্গে বলে–আমার অবস্থায় যদি পড়তে, দেখতাম তোমারই বা কত বুদ্ধি খুলত!
–বুঝেছি। অনেক যন্ত্রণা না পেলে এমন কাজ করতে না তুমি। শুনব, সব শুনব রাত্তিরে। কিন্তু এখুনি তো একখানা তার করে দিতে হয় কলকাতায়।
–বা রে, বেশ তো! আমি বলে কত কষ্ট করে লুকিয়ে পালিয়ে এলাম, এখনই তাড়াতাড়ি বলে পাঠাব-টু! আমি এখানে লুকিয়েছি!
হেমপ্রভা হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–আচ্ছা তোকে বলতে হবে না, আমিই কাউকে দিয়ে অভীর নামে তার পাঠিয়ে দিচ্ছি। মেয়েমানুষ জাত যে বড় সর্বনেশে পরাধীন জাত। রাগ করে বাড়ী ছেড়ে পালাবার স্বাধীনতাই কি আছে তার? ঘরে পরে সকলে সন্দেহ করবে। কেউ বিশ্বাস করবে না একলা পালিয়ে এসেছিস। আমার কাছে এসে পড়েছিস এই মস্ত রক্ষে, যত তাড়াতাড়ি খবর দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।…যাই দেখি রাজেন বাড়ী আছে কিনা!
.
রাত্রে বিছানায় শুইয়া দুইজনেরই প্রায় জাগিয়া রাত ভোর হইয়া যায়। খুঁটিয়া খুঁটিয়া নানা প্রশ্নের সাহায্যে অনেক তথ্যই আবিষ্কার করেন হেমপ্রভা। মনটা যে খুব প্রসন্ন থাকে, এমন বলা যায় না। নিজের অবস্থা এবং ঘটনার বর্ণনা করিতে মিস্টার মুখার্জি নামধারী ব্যক্তিটির সম্বন্ধে যতই অগাধ উদাসীনতা দেখাক তাপসী, যতই মায়ের “সেই পরম অমূল্য রত্নটি” বলিয়া উল্লেখ করুক, তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালিনী পিতামহীর দৃষ্টির সামনে তাহার প্রকৃত মনের চেহারা ধরা পড়িতে দেরি হয় না। এই পলায়ন তাহার তবে মায়ের জবরদস্তির কাছে অসহায় হইয়া নয়, আপন হৃদয়ের কাছেই অসহায়তা! মুখোমুখি সত্যের সন্মুখ হইতে আত্মরক্ষায় অক্ষম হৃদয় লইয়া ভীরু পলায়নে অপ্রসন্ন হইলেও একেবারে ধিক্কার দিতে পারেন না।
আরো কঠিন আরো দৃঢ় হইলেই অবশ্য ভাল ছিল, কিন্তু এই শোভাসম্পদময়ী ধরণীতে, জগতের যাবতীয় ভোগের উপকরণের মাঝখানে বসিয়া এই অপরূপ রূপযৌবনের ডালিখানি অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করিয়া দেবী’ বনিয়া থাকা কি এতই সহজ! বাল-বিধবার তবু তো কৃচ্ছসাধন বরাদ্দ!
কয়েক দিন কাটে।
.
চিত্রলেখার নিকট হইতে টেলিগ্রামেই সংক্ষিপ্ত জবাব আসিয়াছে–’ধন্যবাদ। নিশ্চিন্ত।‘ কন্যার প্রচণ্ড দুর্ব্যবহারে চিত্রলেখা কিরূপ পাষাণ বনিয়া গিয়াছেন, ভাষাটা তাহারই নিদর্শন।
তবু পিতামহীর সঙ্গে সমস্ত কাশী শহরটা প্রদক্ষিণ করিয়া এবং অসংখ্য দেবমূর্তি দর্শন করিয়া বেড়াইতে মন্দ লাগে না। অনাস্বাদিত বৈচিত্র্য। কাশীর বাজার হইতে কেনা সাদাসিধে কয়েকটা শাড়ী জামা–চিত্রলেখার কাছে যাহা একান্ত দীনবেশ, তাই পরিয়া অক্লেশে ঘুরিয়া বেড়ায় তাপসী। যে মূল্যবান নূতন রেশমী শাড়ীখানা বিবাহের ‘পাকা দেখা হিসাবে আসিবার কালে পরনে ছিল, সেখানা নিতান্ত অনাদরে দড়ির আলনায় ঝুলিয়া ধূলা খাইতে থাকে।
এত ঘোরায় অনভ্যস্ত ক্লান্ত হেমপ্রভা রাত্রে বিছানায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মড়ার মত ঘুমাইয়া পড়েন, জানিতেও পারেন না পার্শ্ববর্তিনীর কুসুম-সুকুমার হাল্কা দেহখানির মধ্যে কি উত্তাল সমুদ্র ততালপাড় করিতে থাকে, কি দুরন্ত কালবৈশাখীর ঝড় বয়! বিনিদ্র রজনীর সাক্ষ্য থাকে শুধু বিনিদ্র নক্ষত্রের দল। কোটিকল্পকাল ধরিয়া যাহারা বহুঁকোটি মানবের বিনিদ্র রজনীর হিসাব রাখিয়া আসিতেছে।
.
দিন কয়েক পরে।
গঙ্গাস্নানে যাইবার আগে হেমপ্রভা সুদৃশ্য একখানি ভারী খাম হাতে করিয়া বেজার মুখে নাতনীকে উদ্দেশ করিয়া বলেন–এই নাও, তোমার চিঠি!
ঠিকানাটা টাইপ করা, হাতের লেখা দেখিয়া বুঝিবার উপায় নাই, তবু কি একটা আশার আশঙ্কায় বুকটা থরথর করিয়া ওঠে তাপসীর, হাত বাড়াইয়া লইবার ক্ষমতা পর্যন্ত থাকে না।
–কই, খোল তো দেখি কি লিখেছে! কার চিঠি?
-বুঝতে পারছি না–বলিয়া তাপসী বন্ধ খামখানাই নাড়াচাড়া করিতে থাকে। খুলিবার লক্ষণ দেখায় না।
–খুলেই দে না–’হাতে পাঁজি মঙ্গলবারের দরকার কি? এ বোধ করি তোমার মা’র সেই অমূল্যরত্ন ‘মিস্টার মুখুজ্জে’ না কে যেন তারই হবে! আস্পদ্দাকে বলিহারি দিই বাবা, বেচারা এই দূরদূরান্তরে এসে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে, তাও নিস্তার নেই! চিঠি লিখে উৎখাত করতে এসেছে গো!.তুই খোল তো, দেখি আমি কি লিখেছে সে? কড়া করে উত্তর দিয়ে দিবি, বুঝলি? লিখবি–‘তোমার সঙ্গে কোনো সংস্রব রাখবার ইচ্ছে আমার নেই।‘
তাপসী উত্তর দেয় না, হয়তো দিতে পারেই না–ঘামে ভেজা ‘থরথর কম্পিত’ মুঠির মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া খামখানার অবস্থা শোচনীয় করিয়া তোলে।
হেমপ্রভা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার নাতনীর মুখের চেহারাটা দেখিয়া লইয়া বলেন– অবিশ্যি তোমার নিজের মন বুঝে কথা। দেহটা নিয়ে পালিয়ে আসা যায়, মন নিয়ে তো পালানো যায় না। তুমি যদি তোমার ধিঙ্গি মায়ের মতলব মত ওই ছোঁড়াকেই দুর্গা দুর্গা! থাকবলবার আমার কিছু নেই। নিজের বিবেচনায় কাজ করবার সাহসও আর নেই। যা ভাল বুঝবে করবে।
অন্যমনস্ক তাপসী বোধ করি ঠাকুমার শ্লেষটা বুঝিলেও কারণটা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে না, অসহায় অন্যমনস্ক সুরে বলে–আমার জন্যে কেউ তো কোনদিন কোনো বিবেচনাই করলে না নানি! তুমি পালিয়ে এলে কাশী, বাবা চিরদিনের মত পালালেন, পড়ে রইলাম মা’র হাতে! স্বপ্নের বর স্বপ্ন হয়েই রইল, আমি কি করি বলল তো!