এত কথা ভাবিতে অবশ্য কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময় লাগিয়াছে।
তাপসী প্রায় কথার পিঠেই উত্তর দেয়–অভী ডাক্তারি পড়ছে, বাবলু ঢুকেছে ইঞ্জিনিয়ারিং এ। ওদের জন্যে অনেক কিছুই তো ইচ্ছে ছিল মা’র, হল আর কই? কত খরচ লাগে!
মণীন্দ্রের অভাবটা দু’জনেরই মনে বাজে, স্পষ্ট করিয়া উচ্চারণ করিতে ইচ্ছা হয় না। মিনিট খানেক নিঃশব্দ থাকিয়া হেমপ্রভা বলেন–আর তুই-তুই কি করছিস?
–আমি? তাপসী হাসিয়া বলে–আমি স্রেফ বেকার। কলেজের কবল থেকে বেরিয়ে পর্যন্ত একটা চাকরি-বাকরিতে ঢুকে পড়বার জন্যে ছটফট করছি, মা’র শাসনে হচ্ছে না। কাজেই খাচ্ছি-দাচ্ছি, শাড়ীগয়না পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
হেমপ্রভা ভূকুঞ্চিত করিয়া বলেন–চাকরিতে ঢুকবি বলে ছটফট করছিস! চাকরি করবি তুই?
–করব না কেন, তাই বল? দোষ কি? জীবনটা তো মাঠেই মারা গেল। গেরস্তদের এত এত টাকাকড়ি খরচা করে লেখাপড়াগুলো শিখলাম, সেটাও মাঠে মারা যাবে?
নাতনীর কথায় আর একবার ধৈর্যচ্যুত হন হেমপ্রভা। পরিহাসচ্ছলে নিতান্ত অবহেলায় উচ্চারিত তাপসীর নিজের জীবনের এই মর্মান্তিক সত্যটা যেন সহসা চাবুক মারিল তাহাকে। সত্যই তো, জীবনটা মাঠে মারা যাইবার এত প্রচণ্ড দৃষ্টান্ত একালে আর কবে কে দেখিয়াছে!
অবাধ্য চোখের জলকে খানিকটা ঝরিতে দিয়া হেমপ্রভা গভীর আক্ষেপের সুরে বলেন–তা তুই বলতে পারিস বটে! কিন্তু হারে, তোর মা কি সেই হতভাগা ছোঁড়াটার খোঁজখবর কিছু করে না?
তাপসী কথাটা বলিয়া ফেলিয়া যেটুকু অপ্রতিভ হইয়াছিল, সেটুকু সামলাইয়া লইবার সুযোগ পাইয়াই যেন সকৌতুকে হাসিয়া ওঠে। হাসিয়া ফেলিয়া বলে–কেন গো, কি দুঃখে? আমার মা অমন হতভাগা লোকদের খুঁজে বেড়াবার মেয়ে নয়। খুঁজে খুঁজে যত রাজ্যের ভাগ্যবন্তদেরই এনে হাজির করছে, যদি কিছু সুরাহা হয়। আমিই একটা রাবিশ!
কথাটা মিথ্যা নয়, মেয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ার বছর হইতেই চিত্রলেখা মাঝে মাঝে এক-আধটি সম্ভাবিত পাত্র খুঁজিয়া আনিয়া মেয়ের চোখের নাগালে ধরিয়াছে। তবে তাপসীর মনের নাগাল পাইবার সৌভাগ্য কাহারও ঘটে নাই, এই যা দুঃখ। তাপসীর সহজ প্রসন্নতার কঠিন বর্মের আঘাতে লাগিয়া তাহাদের যত্নসঞ্চিত তূণের সব রকম অস্ত্রই ফিরিয়া গিয়াছে। অথচ মায়ের এই চেষ্টার জন্য মায়ের কাছে কোনদিন অনুযোগ করে নাই মেয়ে, সেইটাই তো আরও অসুবিধা। চিত্রলেখার। কথা কাটাকাটির পথে তবু যুক্তিতর্কগুলা বলিয়া লওয়া যায়। কিন্তু বেবির অদ্ভুত চাল যেন বুঝিতেই পারে না এমন ভাব। শুধু কিরীটীর বেলাতেই ঘটনার স্রোত পালটাইয়াছে আগাইয়াছে।
আত্মপ্রসাদ-প্রসন্ন চিত্রলেখা ভাবিয়া সন্তুষ্ট ছিল–যাক, এতদিনে মনের মতনটি আনিয়া সামনে ধরিয়া দিতে পারিয়াছে। মেয়ের পছন্দটি দিব্য রাজসই বটে। তাই এতদিন কাহাকেও মনে ধরে নাই। কিন্তু শেষরক্ষা হইল না।
.
তাপসীর কথা শুনিয়া মিনিটখানেক গুম হইয়া যান হেমপ্রভা। বধূ সম্বন্ধে ‘যতই হোক হিন্দুর মেয়ে’ বলিয়া নিজের মনকে তিনি যতই চোখ ঠারুন, এমনি একটা আশঙ্কা কি মনে মনে ছিল তাহার? তাপসীর সিন্দুরবিহীন সীমন্ত দেখিয়া সম্প্রতি কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়াছিলেন এই যা। সিন্দুরবিহীনতাটুকু চোখে বাজিলেও, নূতন প্রলেপ যে পড়ে নাই এই ঢের। ও সংস্কারটাকে উড়াইয়া দিয়া অস্বীকার করিতে চায় করুক, বিবাহটা অস্বীকার করে নাই তো!
এই নূতন সংবাদে খানিকটা চুপ করিয়া থাকার পর তীক্ষ্ণস্বরে প্রশ্ন করেন–তা সুরাহা কিছু হল না কেন? অর্থাৎ নাতনীর মনটাও জানিতে চান।
তাপসী ভালোমানুষ বলিয়া বোকা নয়। পিতামহীর মনোভাব বুঝিতে দেরি লাগে না তাহার। মুখের হাসি সমান বজায় রাখিয়াই বলে–হলো আর কই! ভাগ্যটাই যে মন্দ! আহা বেচারা, কত চেষ্টায় কত যত্নে বাজারের সেরা মানিকটি এনে গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছিলেন, আমারই বরদাস্ত হল না। পালিয়ে প্রাণ বাঁচালাম।
ওঃ, তাই বটে! আহা-হা, এ মেয়েকেও আবার সন্দেহ করিতেছিলেন তিনি! সতী মেয়ে মায়ের অন্যায় উৎপীড়নে শেষ পর্যন্ত বাড়ী ছাড়িতে বাধ্য হইয়াছে। বাছা রে! বিগলিত স্নেহে হেমপ্রভা তাহাকে প্রায় কোলে টানিয়া লইয়া বলেন–বাছা রে! কত কষ্ট পেয়েছ, মরে যাই! জানি তো তোর মাকে, এই ভয়ই ছিল আমার। দেখছি ভগবান আবার আমাকে সংসারের পাকে জড়াতে চান। মস্ত কর্তব্যের ত্রুটি রেখে এসে নিশ্চিন্ত হয়ে তাকে ডাকতে বসলেও তো উচিত কাজ হয় না। যাকগে, তুই যে পালিয়ে এসে এখানে এসে পড়েছিস, ভালোই করেছিস। দেখি আমার দ্বারা কি হয়–
–দোহাই নানি, আর কিছু হওয়াবার চেষ্টা কোরো না তুমি। একটা কাজকর্ম খুঁজে নেওয়া। পর্যন্ত তোমার এখানে থাকতে দাও শুধু, তাহলেই হবে।
–আমার ওপর তোর বড় অবিশ্বাস, না? তা হতে অবিশ্যি পারে। কিন্তু ভুলকে শোধরাবার সুযোগও একবার দিতে হয়। চাকরির কথা মুখে আনিসনি আমার সামনে। এখন দয়া করে তোর মা আমার কাছে দুদিন থাকতে দেয়, তবে তো! থানা-পুলিস করে কেড়ে নিয়ে না যায়!
–বাঃ, মা কি করে জানবেন এখানে আছি?
হেমপ্রভা সচকিতে বলেন–একেবারে কিছুই জানিয়ে আসিসনি নাকি?
–না তো!
ছি ছি! এ কাজটা তো তোমার ভালো হয়নি তাপস। আমি বলি বুঝি মায়ের ওপর রাগ করে চলে এসেছিস। চুপি চুপি পালিয়ে এসেছিস তাহলে? বড় নির্বুদ্ধির কাজ হয়েছে।