সৌন্দর্যের খ্যাতি তাপসীর শৈশবাবধিই আছে বটে, কিন্তু এমন অপূর্ব তো কোনদিন দেখেন নাই! বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী কি হেমপ্রভার দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইলেন নাকি? বৈশাখের ভোরের সদ্যফোঁটা মল্লিকা ফুলের লাবণ্য চুরি করিয়া আনিয়া চুপিচুপি কে কখন মাখাইয়া দিয়া গেল তাপসীর মুখে-চোখে?
এই মেয়েকে চিত্রলেখা বিবিয়ানা ফ্যাশনে শার্ট পায়জামা আর খটখটে জুতা পরাইয়া রাখে! আসিয়া দেখুক একবার! আর একটা কথা ভাবিয়া মৃদু একটা নিঃশ্বাস পড়ে হেমপ্রভার, এই মেয়েকে ওর সাহেব বাপ-মা হয়তো পঁচিশ বছর পর্যন্ত আইবুড়ো রাখিয়া দিবে-পর্বতপ্রমাণ শুকনো পুঁথির বোঝা চাপাইয়া।
কিন্তু এমনটি না হইলে ‘কনে’?
মনে মনে ইহার পাশে একটি সুকুমার কিশোর মূর্তি কল্পনা করিয়া, আনন্দে বেদনায় হেমপ্রভার দুই চোখ সজল হইয়া আসে।
তাপসী ছেলেমানুষ হইলেও এই মুগ্ধদৃষ্টি চিনিতে ভুল করে না, তার লজ্জা ঢাকিতে আরও ছেলেমানুষী সুরে তাড়াতাড়ি বলে-সন্ধ্যেবেলা আবার যাবো নানি, এখন চলো–আমি এত কষ্ট করে সাজলাম!…এত বড় শাড়ীটা কি করে পরেছি বলো তো নানি? হুঁ বাবা, ভেতরে এত টা পাট করে নিয়েছি। ঠিক হয়েছে না?
–খুব ঠিক হয়েছে! হেমপ্রভা দুষ্ট হাসি হাসিয়া বলেন–আমিই হাঁ করে চেয়ে আছি, এরপরে দেখছি নাতজামাই আমার দণ্ডে দণ্ডে মূৰ্ছা যাবে।
সভ্য বধূমাতার অসাক্ষাতে এরকম দুই-একটা সভ্যতা-বহির্ভূত পরিচিত পরিহাস করিতে পাইয়া বাঁচেন হেমপ্রভা।
তাপসীও অবশ্য বকিতে ছাড়ে না–যাও, ভারি অসভ্য–বলিয়া পিতামহীর আরও কাছে সরিয়া আসিয়া দাঁড়ায়।
হেমপ্রভা নাতনীর চিবুক তুলিয়া ধরিয়া আদরের সুরে বলেন–তুই তো বললি যাও’, কিন্তু আমি শুধু তাকিয়ে দেখি আমার এই রাধিকা ঠাকরুণটির জন্যে গোকুলে বসে কোন্ কালাচাঁদ তপস্যা করছে?
–ইস ‘কালাচাঁদ’ বই কি–বলিয়া ছুটিয়া পালায় তাপসী।
হেমপ্রভা স্নেহমুগ্ধ দৃষ্টি মেলিয়া চাহিয়া থাকেন।
বৌমা মেয়েটিকে যত খুকী বানাইয়া রাখিতে চান তত খুকী তাই বলিয়া নাই। এই তো–ঠাট্টাটি তো দিব্য বুঝিয়াছে, উত্তর দিতেও পিছপা নয়। না বুঝিবেই বা কেন, অমন বয়সে যে হেমপ্রভার দুই বৎসর বিবাহ হইয়া গিয়াছে। সুদূর অতীতের বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতির ভাণ্ডার হইতে দুই-একটা কথা স্মরণ করিয়া কৌতুকের আভায় প্রৌঢ়া হেমপ্রভার নীরস মুখও সরস দেখায়।
–নানি নানি, দিদিটার কাণ্ড দেখেছ? মিলিটারী ধরনের খাকী সুট পরিয়া বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গীতে আসিয়া দাঁড়ায় অমিতাভ। অমিতাভর উচিত ছিল তাপসীর দাদা হইয়া জন্মানো। কিন্তু দৈবক্রমে বৎসরখানেক পরে জন্মানোর খেসারৎ-স্বরূপ বাধ্য হইয়া তাপসীকেই ‘দিদি’ বলিতে হয় বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই–আর সব বিষয়ে এই ছিচকাঁদুনে মেয়েটাকে নিতান্ত অপোগণ্ডের সামিলই মনে করে সে।
হেমপ্রভা হাসিয়া বলেন–কি কাণ্ড গো মশাই?
-এই দেখ না সক্কালবেলা কনে-বৌয়ের মত সেজে বসে আছে! এ, লাল শাড়ী আবার মানুষে পরে? মাকে কিন্তু আমি বলে দেব নানি বুঝলে, দিদিটার খালি মেয়েলীপনা! আর ওই রকম গিন্নী বুড়ীর মত জবড়জং হওয়াই ভালো নাকি? জানো নানি, মালি এত ফুল আর মালা দিয়ে গেছে, সেইগুলো দিদি এখন পরছে বসে বসে। রাম রাম!
–রাম রাম বইকি, আসল কথা দিদিকে স্বর্গের পরীর মতন দেখাচ্ছে বলে তোর হিংসে হচ্ছে, বুঝেছি।
কথাটা একেবারে মিথ্যাও নয়, হিংসা না হোক কিছুটা অস্বস্তি হয় বৈকি অমিতাভর। খাটো ফ্রক অথবা ঢিলে পায়জামা শার্ট পরা দিদি তার নিতান্ত নাগালের জিনিস। যে দিদি টফি চকোলেটের ভাগ লইয়া খুনসুড়ি করে, শব্দ প্রতিযোগিতার প্রতিশব্দ লইয়া তর্কাতর্কি করে, পড়ার জায়গায় গোলমাল করার ছুতা ধরিয়া ঝগড়া করে–সে দিদির তবু মানে আছে, কিন্তু শাড়ী-গহনা পরা চুলে ফুলের মালা লাগানো দিদিটা যেন নেহাৎ অর্থহীন, ওর মুখে যে নূতন রং সেটা অমিতাভর অচেনা, তাই উঠিতে বসিতে শাড়ী-গহনার খোঁটায় অস্থির করিয়া তোলে তাপসীকে।
গহনাগুলি অবশ্য পিতামহীর, তবে হেমপ্রভা চিরদিনই রোগা পাতলা মানুষ, আর তাপসী লাবণ্যে ঢলঢল বাড়ন্ত মেয়ে, তাই গায়ে মানাইয়া যায়। বাক্স খুলিয়া সব কিছু বাহির করিয়া দিয়েছেন হেমপ্রভা। দীর্ঘদিনের অবরোধ ভাঙিয়া অলঙ্কারগুলোও যেন মুক্তি পাইয়া বাঁচিয়াছে। এই মুক্তার শেলি আর জড়োয়ার নেকলেস, সোনার বাজুবন্ধ আর হীরার কঙ্কণ, এদের ভিতরে কি লুকানো ছিল প্রাণের সাড়া? হেমপ্রভার সোহাগমঞ্জরিত যৌবনদিনের স্পর্শ মাখানো ছিল ওদের গায়ে? তারই ছোঁয়াচ লাগিয়াছে তাপসীর ঘুমন্ত মনে?
আগেকার দিনে মেয়েদের সম্মান ছিল না–এটা কি যথার্থ? মানিনী প্রিয়াকে অলঙ্কারের উপঢৌকনে তুষ্ট করিয়া পুরুষ যে ধন্য হইত, সে কি নারীর অসম্মান? পুরুষের প্রেমের নিদর্শন বাহিয়া আনিত যে আভরণ, সে কি শৃঙ্খল?
আজকের মেয়েরা অলঙ্কার আভরণ আদায় করে কলহ করিয়া। ছি!
অমিতাভ আর একটু শানানো গলায় বলে–চুপ করে গেলে যে নানি? ভাবছ কি?
–ভাবছি? ভাবছি তোর দিদি যখন কনে বৌ সেজে বসে আছে–তখন দিদির একটা বরের দরকার তো?
–এঃ, ছি ছি ছি! শেম্ শে! দিদি, এই দিদি, শীগগির শুনে যা—
চুলে আটকানো রজনীগন্ধার গোছাটি সাবধানে ঠিক করিতে করিতে তাপসী আসিয়া দাঁড়াইল–যত ইচ্ছে চেঁচাচ্ছিস মানে? মা নেই বলে বুঝি!