সত্যই শুকনো শুকনো মুখ, এলোমেলো উসকোখুসকো চুল, চোখের নীচে কালির রেখা। বিপদের সংবাদ বহিয়া আনার মতই চেহারাটা বটে।
কিন্তু এমন কি বিপদ ঘটিতে পারে যে তাপসীকে আসিতে হয় সে সংবাদ বহন করিয়া? তবে কি চিত্রলেখাও মণীন্দ্রর পথ অনুসরণ করিল?
অসম্ভব কি? হেমপ্রভার মত এত বড় দুর্ভাগিনী জগতে আর কে আছে, যথাসময়ে মরিয়াও মুখরক্ষা করিতে পারে না?
–তাপসী! তুই! চৌকিটার উপরই বসিয়া পড়েন হেমপ্রভা।
তাপসী মৃদু হাসিয়া বলে–আমি নয়, আমার ভূত। সারাদিন বুঝি গঙ্গার ঘাটেই থাকো তুমি?
–থাকি বৈকি। ভাবি রোজ দেখতে দেখতে যদি দৈবাৎ মা-গঙ্গার দয়া হয় কোনোদিন। কিন্তু তুই হঠাৎ এরকম করে চলে এলি কেন তাই বল্ আমায়। এ যে বিশ্বাস হচ্ছে না। বুঝতে পারছি না আমি–আনন্দ করব না আতঙ্কিত হয়ে বসে থাকব!
তাপসী স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হাসির সঙ্গে বলে–সে কি গো নানি, কতদিন পরে দেখলে কোথায় আনন্দে অধীর হয়ে উঠবে, তা নয় ভেবেচিন্তে অঙ্ক কষে ঠিক করবে, কি করা কর্তব্য?
যাক, ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ কিছু নাই তবে! ঈষৎ ধাতস্থ হইয়া হেমপ্রভা বলেন—’আনন্দ’ কথার বানান ভুলে গেছি তাপস। তুই হঠাৎ এরকম একলা একবস্ত্রে এভাবে চলে এলি কেন না শুনে সুস্থির হতে পাচ্ছিনে।
–এমনি। তোমায় দেখতে ইচ্ছা হল, ভাবলাম কোন্ দিন কাশীলাভ করবে, দেখাই হবে আর। তা–
–ও কথা আর যাকে বোঝাবি বোঝাগে যা, আমায় বোঝাতে আসিস নি তাপস। আমার মন কেবল কু’ গাইছে। কি হয়েছে বল্! শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে–
–কি মুশকিল! তাপসী যেন বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলে–বুড়ী হলেই কি ভীমরতি হতে হয় গোয় একটা মানুষ সারারাত ট্রেনে চড়ে, খিদেয় তেষ্টায় কাতর হয়ে এসে পড়ল–তাকে কেন এসেছিস’ কি জন্যে এসেছিস’ এই নিয়ে কেবল জেরার ওপর জেরা! থাকতে না দাও তো। বলল, চলেই যাই!
–বালাই ষাট–দুগগা দুগগা! আমি যে দিবানিশি এই আশাটুকু বুকে নিয়েই দিন কাটাচ্ছি। এখনো–একবার তোদের চাঁদমুখগুলি দেখব। কিন্তু এমন আচমকা হঠাৎ এলি, ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। বল সবাই ভালো আছে তো?
–আছে আছে।
–কিন্তু তোকে তো ভালো দেখছি না। হেমপ্রভা সন্দিগ্ধভাবে বলেন–তুই আছিস কেমন?
–খুব ভালো। তোমায় যে এখনো প্রণাম করাই হয়নি গো–গাড়ীর কাপড়ে ছোঁবো নাকি?
বাল্যের শিক্ষা আজও বিস্মৃত হয় নাই দেখা গেল। অভিভূত হেমপ্রভা এতক্ষণে দুই বাহু, বাড়াইয়া বুকে জড়াইয়া ধরেন তাহার চির আদরের আদরিণীকে। অভী বাবলু যতই মূল্যবান হোক, তবু তাপসীর মূল্য আলাদা।
সংসারের প্রথম শিশু। মণীন্দ্রর প্রথম সন্তান। কমলার উপস্থিতির কথা আর স্মরণ থাকে না, চির-অবিচলিত হেমপ্রভা কাঁদিয়া ভাসাইয়া দেন।
কে জানে তাপসীর চোখের খবর কি! পিতামহীর বুকের আড়ালে ঢাকা পড়িয়াছে বলিয়াই হয়তো লোকচক্ষে মান-সম্রমটা বজায় রহিল।
স্নানাহারের পর হেমপ্রভা আবার তাহাকে লইয়া পড়েন। তাপসীর এই আসাটা যে কেবলমাত্র নানির কাশীপ্রাপ্তি হইবার ভয়ে দর্শনলাভের আশায় ছুটিয়া আসা নয়, সেটুকু বুঝিবার ক্ষমতা বিলক্ষণ আছে তাহার।
কিন্তু তাপসী কেবলই হাসিয়া উড়ায়। বলে–ভালো বিপদ হয়েছে দেখছি, এমন জানলে আসতাম না! নাবালক ছিলাম, একা আসবার সাহস হত না। এখন সাবালক হয়েছি, তাই এলাম একবার।
হেমপ্রভা হাসিয়া বলেন–হঠাৎ সাবালক হয়ে উঠলি কিসের জোরে? তোর মা’র কবল থেকে কারুর সাবালক হওয়া সোজা ক্ষমতা নয়!
–মাকে তুমি বড় চিনে ফেলেছ নানি, তাই না? সত্যিই অনেক ক্ষমতার দরকার–তাই তো পালিয়ে এলাম।
–সেই কথাটাই ব–”পালিয়ে এলি’! আচ্ছা এখন আর পীড়াপীড়ি করব না, সময়ে শুনব। তোদের আর সব খবর শুনি। অভী, বাবলু কতদূর কি পড়ল-টড়ল এতদিনে? তুই কি করছিস? সরকার মশায়ের চিঠিতে ভাসা-ভাসা একটা খবর কদাচ কখনো পাই মাত্র। হেমপ্রভার কেমন একটা ধারণা হয়–তাপসী বড় হইয়া বুদ্ধি-বিবেচনার অধিকারিণী হইয়া, এতদিনে নিজের জীবনের একটা সুব্যবস্থার চেষ্টায় হেমপ্রভার কাছে আসিয়াছে, সেই তাহার বিবাহ অভিনয়ের নায়কের তত্ত্ব লইতে।
গুরু রক্ষা করিয়াছেন যে চিত্রলেখা আক্রোশের বশে আর একটা বিবাহ দেবার চেষ্টা করে নাই! যতই হোক হিন্দুর মেয়ে তো! কিন্তু সত্যিই যদি প্রশ্ন করে তাপসী, কি সদুত্তর দিবেন হেমপ্রভা? বুলুর সন্ধান লইবার চেষ্টা কয়েকবারই তো করিয়াছিলেন তিনি, কিন্তু যোগাড় করিতে পারিয়াছেন কই? প্রত্যেকবারই সরকার মশাই লিখিয়াছেন–”শুনিতে পাওয়া যায় ছেলেটি লেখাপড়া শিখিবার জন্য বিলাতে গিয়াছে।
বিলাতে পড়িতে গেলে কতকাল লাগে? কি সে পড়া? ইদানীং আর চেষ্টা করেন নাই হেমপ্রভা। কি বা প্রয়োজন–তাহার দ্বারা আর কাহারও কিছু হইবার আশা যখন নাই! চিত্রলেখার ইচ্ছা হয় খোঁজখবর লইয়া মেয়ে পাঠাইবে। ইচ্ছা না হয়–তাপসীর ভাগ্য। অনেক ভাবিয়া ভাবিয়া নিজেকে ‘নিমিত্তের ভাগী’ মনে করাটাও ছাড়িয়া দিয়াছিলেন তিনি। আজ সহসা তাপসীকে দেখিয়া অপরাধ-বোধটা নূতন করিয়া মাথা চাড়া দেয়। দোষ যাহারই হোক, এমন মেয়েটা মাটি হইয়া গেল!
কি কুক্ষণেই নাম রেখেছিলেন “তাপসী”! তপস্যা করিয়াই জীবন যাইবে! নিজের সংস্কারের দৃষ্টি দিয়াই বিচার করেন হেমপ্রভা। এছাড়া আর কিছু হওয়া সম্ভব, সে চিন্তাও আসে না। বহুযুগসঞ্চিত পুরুষানুক্রমিক সংস্কার। যে সংস্কারের শাসনে লোকে বালবিধবাকে অনায়াসে মানিয়া লয়। পতি-পরিত্যক্তার ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়া নিশ্চিন্ত থাকে।