মণীন্দ্রর মৃত্যুর পর ছেলেমেয়েদের উপর এমন একটা কঠিন আদেশজারি করিয়া রাখিয়াছিল চিত্ৰলেখা যে তাহাদের একান্ত প্রিয় নানিকে একখানি চিঠি লেখারও উপায় ছিল না।
স্বামীর মৃত্যুর পর শাশুড়ীর সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিবার দৃঢ় সঙ্কল্প লইয়াই নূতন সাজে সংসারে নামিয়াছিল চিত্রলেখা। কেমন যেন একটা ধারণা হইয়াছিল তাহার, মণীন্দ্রর অমন আকস্মিক মৃত্যুর কারণই হইতেছেন হেমপ্রভা। তাহার সেই বিশ্রী বিদঘুঁটে কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজটার জন্যই না মাকে প্রায় বর্জন করিয়া বসিয়াছিলেন মণীন্দ্র। অবশ্য চিত্রলেখা জানিয়াছিল সেটা সাময়িক, নিতান্তই অস্থায়ী। হেমপ্রভা নিজে হইতে নির্বাসন দণ্ড গ্রহণ না করিলে পুত্র আবারও ‘মা’ বলিয়া ভক্তিতে গদগদ হইতেন।
এই একটিমাত্র উচিত কাজ করিয়াছেন হেমপ্রভা, চিত্রলেখার প্রতি এতটুকু অনুগ্রহ। কিন্তু ছেলে মায়ের প্রভাবে অত বেশী প্রভাবান্বিত ছিলেন বলিয়াই না মাতৃবিচ্ছেদ-দুঃখ অতটা বাজিয়াছিল। যেন অহোরাত্ৰ অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হইতেছিলেন। আশ্চর্য, মা বলিয়াই কি সাতখুন মাপ!
তাছাড়া বেবির ভবিষ্যৎ-চিন্তা। চিত্ৰলেখার মত মণীন্দ্রও যদি সেই বিশ্রী ঘটনাটাকে চিন্তাজগৎ হইতে ঝাড়িয়া ফেলিতেন তো ল্যাঠা চুকিয়া যাইত। তা নয়, সেইটা লইয়া অবিরত দুশ্চিন্তা। মনোকষ্টে ও চিন্তায় চিন্তায় ভিতরে ভিতরে জীর্ণ না হইলে কখনো অমন স্বাস্থ্য-সুন্দর দীর্ঘ দেহখানা মুহূর্তে কর্পূরের মত উবিয়া যায়।
সব কিছুর মূলই তো সেই হেমপ্রভা। দৈবক্রমে স্বামীর জননী বলিয়াই কি তাহার প্রতি ভক্তিতে শ্রদ্ধায় বিগলিত হইতে হইবে!
এই তো চিত্রলেখারও নিজের সন্তানরা রহিয়াছে, মায়ের উপর কার কতটা ভক্তিশ্রদ্ধা তা আর জানিতে বাকি নাই। এর উপর যদি আবার তাহাদের, চিত্রলেখার চিরশত্রু সেই বশীকরণ শক্তিশালিনী ‘নানি’র কবলে পড়িতে দেওয়া হয়, তবে আর রক্ষা আছে! অতএব কড়া শাসনের মাধ্যমে তাহাদের স্মৃতিজগৎ হইতে নানির মূর্তিটা মুছিয়া ফেলাই দরকার।
তাছাড়া যে কথাটা মনে আনিতেও ঘৃণা বোধ হয়, বেবির জীবনের সেই অবাঞ্ছিত ঘটনাটা–যেটাকে চিত্রলেখা বেমালুম অস্বীকার করিয়া ফেলিতে চায়, পিতামহীর সংস্পর্শে আসিতে দিলে সেটাকে জিয়াইয়া রাখার সহায়তা করা হইবে কিনা কে জানে! তার নিজের পছন্দের সাধের ঘটকালির অপরূপ বিবাহ, তিনি কি সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা না করিয়া ছাড়িবেন? একেই তো ওই জবুথুবু সেকেলে ধরনের মেয়ে, তাহার কানে যদি সীতা-সাবিত্রী’র আখ্যানের ছলে বিষয়মন্তর ঢালা হয়, তাহা হইলে তো চিত্রলেখার পক্ষে বিষ খাইয়া মরা ছাড়া অন্য উপায় থাকিবে না।
বরং সময় থাকিতে বিষবৃক্ষের মূলোচ্ছেদ করিয়া ফেলাই বুদ্ধির কাজ। তা বুদ্ধিটা যে একেবারে নিষ্ফল হইয়াছে, তাই বা বলা যায় কেমন করিয়া! যথেষ্টই কার্যকরী হইয়াছে বৈকি! স্নেহময় পিতার উদার প্রশ্রয়ের আশ্রয় হারাইয়া ভীত-সন্ত্রস্ত ছেলে-মেয়ে তিনটা দুর্দান্ত মায়ের কড়া শাসনে ছেলেবেলায় কোনো যোগসূত্র রাখিতে পায় নাই। হেমপ্রভার দিকটা সত্যই প্রায় বিস্মৃত হইয়া গিয়াছিল। বড় হইয়াও কেহ কখনো নূতন করিয়া যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করে নাই।
স্বাভাবিক অনুমানে হেমপ্রভা অবশ্য প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়া লইয়াছিলেন, তবু সত্যিই কি । কখনো কোনোদিন একবিন্দু অভিমান হয় নাই? তাপসী না হয় তাহার জীবনের শনিকে চিরদিনের মত বর্জন করিয়া চলুক, কিন্তু অভী? বাবলু? এই বারো বৎসরে অবশ্যই যথেষ্ট সাবালক হইয়া উঠিয়াছে তাহারা–তবে?
দেখিতে না আসুক, একখানা চিঠিও কি আসিতে পারে না? ধরো, পরীক্ষা সাফল্যের সংবাদবাহী? কিংবা বিজয়াদশমীর প্রণাম সম্বলিত?
হেমপ্রভা পাগল, তাই সুন্দর একটা মেয়ের নাম শুনিয়াই অসম্ভবের আশায় বিচলিত হইয়া পড়িয়াছেন! তাছাড়া কমলার কথা তো! বেশ কিছু বাদ দিয়া ধরিতে হয়!
কিন্তু কে আসিতে পারে? হেমপ্রভাকে খোঁজ করে, নাম বলিয়া সন্ধান চায়, এমন কাহাকেও খুঁজিয়া পান না। ঘুরিয়া ফিরিয়া সেই একজনের কথাই মনে পড়িতে থাকে। তাপসী ভিন্ন
বালাই ষাট! তাপসীই বা অমন শুকনো মুখ লইয়া একা কলিকাতা হইতে কাশী ছুটিয়া আসিবে কেন? নাঃ, তার কথা উঠিতেই পারে না!
আচ্ছা এমনও তো হইতে পারে, মায়ের সঙ্গে মনান্তর হওয়ায় অভিমান করিয়া নানির কাছে পলাইয়া আসিয়াছে। হায় কপাল! হেমপ্রভার তেমন ভাগ্যই বটে! হেমপ্রভার স্নেহের, হেমপ্রভার আশ্রয়ের যদি কোনো মূল্য থাকিত, তবে কি সেই ভয়ঙ্কর দিনে অমন করিয়া মণীন্দ্র ছেলে-মেয়ে তিনটাকে–
হঠাৎ সমস্ত চিন্তাস্রোতের উপর পাথর চাপা দিয়া দ্রুত পা চালাইতে থাকেন। অত ভাবিবার। কি আছে? নিশ্চয় সম্পূর্ণ বাজে কেউ। কুমারী মেয়ে বলিল না? হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠানের বা কোনো স্কুলের
বাড়ী ঢুকিয়াই অবশ্য নিমেষে স্থাণু হইয়া যান। মিথ্যা কল্পনা নয়, অসম্ভবই সম্ভব হইয়াছে। তাপসীই বটে। বাহিরের দিকের ঘরটায় একটা বড় চৌকি পাতা ছিল, তাহারই উপর চুপচাপ বসিয়া আছে। সঙ্গে মোটঘাটের বালাই মাত্র নাই।
তাপসী! হ্যাঁ, তাপসী বৈকি! রোদের ঝকঝকে সকাল। আলোভরা ঘর। ভুল করিবার কিছু নাই। বারো বছরের বালিকার উপর আরো বারো বছর ধরিয়া সৃষ্টিকর্তা তাহার যতই শিল্প কৌশল প্রয়োগ করিয়া থাকুন, বার্ধক্যের স্তিমিত দৃষ্টি লইয়াও হেমপ্রভার চিনিতে ভুল হয় না।