এক যুগ আগের দেখা সেই ফুলের মত মুখোনি এক-আধবার মনে পড়িয়া মনটা একটু কেমন করিয়া ওঠে, কিন্তু জোর করিয়া রাগ আনিয়া সে স্মৃতিটুকু চাপা দেন রাজলক্ষ্মী। হুঁ, সেই “গ্যাড-ম্যাড” মেয়ে এতদিনে একটা সাহেব-সুবোকে বিবাহ করিয়া বসিয়া আছে কিনা তাহার ঠিক কি! রুচি-ভক্তি থাকিলে আর এতকালেও একটা খোঁজ করে না!
বেশ করিবে বুলু–আবার বিবাহ করিবে।
জমিদারের বিবাহের উপযুক্ত সমারোহের আয়োজন করিতে থাকেন রাজলক্ষ্মী। দশ-বারোটা ঝিয়ের যোগাড় হয়–যাহারা রাতদিন থাকিয়া খাঁটিবে। বামুন-চাকরের অর্ডার হয় ডজন-দুই। বর্ধমানে বায়না যায় নহবৎ বাজনার। গহনা-কাপড়ের ফ্যাশান বুঝিতে সরকার মশাইয়ের কলিকাতা-ঘর করিতে জুতো হেঁড়ে। এদিকে বস্তা বস্তা মুড়ি-চিড়া-মুড়কি তৈরির ধুম লাগে, মণখানেক ডালের বড়ি পড়ে, সুপারি কাটানো, সলিতা পাকানো-প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কাজের সীমাসংখ্যা নাই। গ্রামসুদ্ধ নিমন্ত্রণ হইবে নিঃসন্দেহ, সন্দেশের ছাঁদা’ দিবেন সরায় করিয়া–না হাঁড়ি ভর্তি করিয়া, এই লইয়া নায়েব মশায়ের সঙ্গে রীতিমত বাগ-বিতণ্ডাই হইয়া যায়।
নিত্য নূতন ফর্দ তৈয়ারী করিতে করিতে সরকার মশায় আর নায়েব মশায় নাজেহাল হইয়া ওঠেন।
ক্রমশ সবই সারা হইয়া আসে। কেবলমাত্র যখন শুধু সামিয়ানা খাটানো আর ভিয়েনের উনান পাতা বাকি–তখন হঠাৎ বজ্রাঘাতের মত বুলুর একখানি চিঠি আসিয়া রাজলক্ষ্মীর সমস্ত আয়োজন লণ্ডভণ্ড করিয়া দেয়। বুলু লিখিয়াছে–
পিসিমা, মনে হচ্ছে বৌ জিনিসটা বোধ হয় আমার ধাতে সইবার নয়। কাজে-কাজেই তোমারও কপালে নেই।…অফিসের কাজে পাটনায় যাচ্ছি, ঘুরে এসে তোমার কাছে যাব। প্রণাম নাও।
বুলু
.
কাশীবাস করিলে নাকি পরমায়ু বাড়ে।
কাশীর গঙ্গার ঘাটে কাশীবাসিনী বৃদ্ধা বিধবার মরশুম দেখিলে খুব বেশী অবিশ্বাসও করা চলে না কথাটা। এই অসংখ্য বৃদ্ধার দলের মধ্যে আর একটি সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া হেমপ্রভা আজও বাঁচিয়া আছেন। ছোটখাটো কৃশ দেহটি আরও একটু কৃশ হইয়াছে, চোখের দৃষ্টিটা নিষ্প্রভ হইয়াছে মাত্র, তাছাড়া প্রায় ঠিকই আছেন।
বাড়ীতে আশ্রিত পোষ্যের সংখ্যা বাড়িয়াছে বৈ কমে নাই। এই নতুন পাতানো সংসারের ভার চাপাইয়াছেন একটি পাতানো মেয়েরই ঘাড়ে। যেমন ভালোমানুষ, তেমনি পরিশ্রমী মেয়ে এই কমলা ।
নিত্যকার মত আজও হেমপ্রভা সকালবেলা হরিনামের মালাটি হাতে দশাশ্বমেধ ঘাটের নির্দিষ্ট আসরটিতে আসিয়া বসিয়াছেন। একটু পরেই কমলা হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত।
-–কি রে, কি হয়েছে?
কমলা হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলে–মাসীমা, শীগগির বাড়ী চলুন, একটি মেয়ে এসে আপনাকে খুঁজছে!
হেমপ্রভা অবাক হইয়া বলেন–আমাকে খুঁজছে? কেমনধারা মেয়ে?
–আহা, একেবারে যেন সরস্বতী প্রতিমের মত মেয়ে মাসীমা। দেখলে দু’দণ্ড তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। রেলে এসেছে তাই একটু শুকনো মতন
‘সরস্বতী প্রতিমার মত’ শুনিয়াই বুকটা ধড়াস করিয়া উঠিয়াছে হেমপ্রভার। কিন্তু অসম্ভব কি কখনো সম্ভব হয়?
ঝোলামালা গুছাইবার অবসরে হৃৎস্পন্দনকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনিতে আনিতে হেমপ্রভা প্রায় হাসির আভাস মুখে আনিয়া বলেন-মরালবাহন ছেড়ে রেলে চড়ে আবার কোন্ সরস্বতী এলেন? নাম-টাম বলেছে কিছু?
–না। আমি শুধাতেও সময় পাই নি। আপনার নাম করে বলল—’এই বাড়ীতে অমুক দেবী আছেন না?’–আমি শুধু একটু দাঁড়াতে বলেই ছুটে এসেছি আপনাকে খবর দিতে।
অর্থাৎ বোঝা যাইতেছে–মেয়েটিকে দেখিয়া কেন কে জানে, কমলা একটু বিচলিতই হইয়া পড়িয়াছে। অবশ্য সামান্য কারণে বিচলিত হওয়া তার প্রকৃতিও কতকটা।
কিন্তু হেমপ্রভার মত এমন অবিচল ধৈর্যই বা কয়জন মেয়েমানুষের আছে? চলিতে চলিতে শুধু একবার প্রশ্ন করেন–কত বড় মেয়ে?
–বড় মেয়ে। ঠিক ঠাহর করতে পারিনি কত বড়। বেথা হয়নি এখনো। পাস-টাস করা মেয়ের মতন লাগল।
–সঙ্গে কে আছে?
–কেউ নয়, একা। মুখটি কেমন শুকনো শুকনো, মনে হচ্ছে যেন কোনো বিপদে পড়ে–তাই তো ছুটে চলে এলাম।
–দেখি চল্। তুই যে হাঁপাচ্ছিস একেবারে! স্বাভাবিক সুরে কথা কহিবার চেষ্টা করেন হেমপ্রভা। কিন্তু হৃদয় যতই ছুটিয়া যাক, পা যেন চলিতে চায় না।
আবার কোন বিপদে পড়িয়া কে আসিল হেমপ্রভাকে স্মরণ করিতে? এক যুগ আগে আসিয়াছিল কলিকাতার বাড়ীর সরকার লালবিহারী। সেই দিন হইতেই তো গত জীবনের সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ শেষ হইয়া গিয়াছে। এই দীর্ঘকাল যাবৎ কি দুরপনেয় গ্লানি, কি দুর্বহ শোকভার একা একা বহন করিয়া আসিতেছেন তিনি, কে তাহার সন্ধান লইতেছে?
এখানের এরা জানে, কাশীবাসিনী আর পাঁচটা বিধবার মতই নিতান্ত নির্বান্ধব তিনি। অবস্থা খারাপ নয়, এই যা। কাশীর এই বাড়ীখানা নিজস্ব, তাছাড়া বর্ধমান জেলার কোন্ একটা গ্রাম হইতে যেন নিয়মিত একটা মোটাসোটা মনিঅর্ডার আসে। অবশ্য তার সবটাই প্রায় ব্যয় হয় আশ্রিত প্রতিপালনে। বিধবা বুড়ীর খরচ করিবার পথই বা কি আছে আর! নিজের বিগত জীবনের কোনো গল্পই কখনো করেন নাই কাহারও কাছে।
নিতান্ত প্রয়োজন হিসাবে নিজের জন্য যতটুকু যা রাখিয়াছিলেন, তাহারই উপস্বত্বে চলে হেমপ্রভার। দেশের বাড়ীর চিরদিনের বিশ্বাসী সরকার মশাইয়ের হাতে ভার দেওয়া আছে। তাছাড়া সব কিছু সম্পত্তির দায় তো তাহার উপরই চাপানো আছে। তাপসীর নামে দানপত্র করা বিষয়-সম্পত্তির আয়টা অনুগ্রহ করিয়া গ্রহণ করিলেও, সে সম্পত্তির দেখাশোনার কথা চিন্তাও করে না চিত্রলেখা। সরকার মশাইটি নিতান্ত সাধু ব্যক্তি বলিয়াই আজও সমস্ত যথাযথ বজায় আছে। বুক দিয়া আগলাইয়া পড়িয়া আছেন তিনি।