বুলুবাবু তো দীর্ঘকাল সাগরের ওপার হইতে চলিয়া আসিয়া এতদিনে কলিকাতায় কি যেন কাজে লাগিয়াছে। কিন্তু লাগিলেই বা কি? না বৌ, না ঘর-সংসার। বাউণ্ডুলে লক্ষ্মীছাড়ার মত থাকে ফ্ল্যাটে, খায় হোটেলে, অবসর সময়ে হাওয়া-গাড়ীখানাকে বাহন করিয়া গায়ে হাওয়া লাগাইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। তাহার কাছে আর রাজলক্ষ্মী যাইবেনই বা কোন্ মুখে? একেই তো কলিকাতার নামে গা জ্বলিয়া যায় রাজলক্ষ্মীর–ওই নিজেই সে মাঝে মাঝে আসিয়া যে পিসিকে দেখা দিয়া যায় সেই ঢের!
কতকাল হইল মারা গিয়াছেন কান্তি মুখুজ্জে। তবু এখনো মামার কথা উঠিলে অনেক সময়েই রাগিয়া যা-তা বলিয়া বসেন রাজলক্ষ্মী। ভীমরতি ধরিয়াছিল মামার, তাই একমাত্র নাতিটা, সৃষ্টিধর–বংশধর, তাহাকে লইয়া পুতুল খেলিয়া গিয়াছেন। ছেলেও তেমনি জেদী একগুয়ে, তা নয়তো সেই ‘বেয়াকার’ বিবাহটাকে সত্য বলিয়া আঁকড়াইয়া বসিয়া আছে! এতদিনে একটা বিবাহ করিলে দুইটা ছেলে-মেয়ে হইয়া ঘর আলো করিত। পাত্রীরই কি অভাব? আর বুলুর মত ছেলের? যে বৌ বাঁচিয়া আছে কি মরিয়া গিয়াছে তার নাই ঠিক, ইচ্ছা করিয়া যে সকল সম্পর্ক ধুইয়া মুছিয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া দিয়াছে, সেই বৌয়ের আশায় চিরজীবনটা কাটাইয়া দিবার মতলব নাকি, তাই বা কে জানে? অথচ আশাই বা কিসের? নিজেও তো মুখে আনে না, চেষ্টা করিয়া খোঁজ করা দূরে থাক।
বলিয়া বলিয়া এবং বিবাহের স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করিয়া যখন রাজলক্ষ্মী চুপ করিয়াছেন, তখন হঠাৎ একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে বুলু আসিয়া হাজির।
রাজলক্ষ্মী পূজার ঘরের সলিতা পাকাইতেছিলেন এবং উৎকর্ণ হইয়া কি যেন শুনিতেছিলেন। মোটরের হর্ন শুনিতে পাওয়া গেল! বুলু ভিন্ন আর কে মোটরে চড়িয়া আসিবে এই অজ পাড়াগাঁয়ে? ট্রেনে চড়িতে ভালোবাসে না সে, টানা মোটরেই আসে কলিকাতা হইতে।
অনুমান মিথ্যা নয়, বুলুই বটে।–পিসিমা এলাম! একমুখ হাসি লইয়া সাড়ম্বরে এক প্রণাম।
–এসো বাবা আমার সোনামণি। তবু ভালো যে বুড়ী পিসিকে মনে পড়ল।
–বাঃ, মনে পড়ত না বুঝি! আসা হয় না এই যা। আজ এলাম তোমাকে নেমন্তন্ন করতে।
–আমাকে নেমন্তন্ন? রাজলক্ষ্মী অবাক হইয়া তাকান।
–হ্যাঁ গো পিসিবুড়ী। বৌ বরণ করবে না?
রাজলক্ষ্মী কৌতূহল দমন করিয়া নিস্পৃহ স্বরে বলে–এত ভাগ্যি আর আমার হয়েছে। বৌ বরণ!
–‘হুঁ’ নয়গো পিসিমা, সত্যি। তোমার কষ্ট আর দেখতে পারছি না বাপু।
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–আমার কষ্টের ভাবনায় তো ঘুম হচ্ছে না তোর! তা যাক, ব্যাপারটা কি? সোন্দর মেয়ে-টেয়ে দেখেছিস বুঝি কোথাও? আহা, ভগবান সুমতি দিন।
–থামো পিসিমা, ভগবানের নাম আর কোরো না আমার সামনে। সেই ভদ্রলোকের দুর্মতির ফলে এই এত জ্বালা মানুষের, আবার তিনিই দেবেন সুমতি! তবেই হয়েছে! সত্যি কথা বললে তো বিশ্বাস করবে না তোমরা। বলছি তোমার কষ্ট দেখে একদিন প্রতিজ্ঞা করে বেরলাম বৌ এনে দেব তোমায়–তারপর এখন এই–বরণ করার খাটুনি তোমার।
–আহা, ওই খাটুনির ভয়েই হাতে পায়ে খিল ধরছে! কিন্তু মেয়ে কেমন তাই বল!
–আগে থেকে বলব কেন? বাঃ, তুমি দেখে বুঝবে পরে।
–তা বেশ, ঘর-টর কেমন খবর নিয়েছিস? সেই তাদের মতন ছোটলোক চামার না হয়।
–চামার-কামার বুঝি না বাপু, তোমার কাছে ধরে এনে দেব, তারপর দেখো।
রাজলক্ষ্মী আবার হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–বাবাঃ, ছেলের মন হয়েছে তো একেবারে মিলিটারী! আমি না হয় একেবারে দুধে-আলতার পাথরেই দেখলাম, কিন্তু ভটচায্যি মশাই, নায়েব মশাই–এঁদের তো একবার পাঠাতে হবে। পাত্রী আশীর্বাদ করা চাই। তাছাড়া বিয়ের হাঙ্গামা কি সোজা? কথায় বলে, লাখ কথা নইলে বিয়ে হয় না! সেবারে এক কথায় বিয়ে দিয়ে মামা তো যা নয় তাই করে গেছেন! আর আমি না দেখে, না শুনে বিয়ে দিচ্ছি না বাপু।
–তবেই হয়েছে! বুলু হতাশার ভান করিয়া বলে–তুমি আমার পাকা খুঁটিটি কাঁচাবে দেখছি! আচ্ছা বাপু, তোমার যা মনে হয় সব কোরো, কিন্তু তার আগে যদি হঠাৎ বৌ এনে হাজির করি, তাড়িয়ে দেবে না তো?
রাজলক্ষ্মী রাগিয়া উঠিয়া বলেন–হ্যাঁ, তাই তো! আমি তোর পাকা খুঁটি কাঁচাবো, বৌ আনলে তাড়িয়ে দেব–খুব বিশ্বাস রাখিস তো আমার ওপর! আমি বলে সাত দেবতার দোর ধরে, সিন্নি মেনে, হরির লুঠ মেনে বেড়াচ্ছি–কি করে তুই ঘরবাসী হবি! তাহলে নিশ্চয় এক বেটি মেম-ফেম বিয়ে করবি ঠিক করেছিস, তাই অত ভয়!
–নির্ভয় হও পিসিমা, সে সব কিছু নয়। যেখানে যা মানত করেছ সব শোধ কোরো বসে। বসে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, তুমি বৌ দেখে অখুশী হবে না। আচ্ছা এবারে কলকাতায় গিয়ে তোমাকে সব বিশদ খবর দিয়ে চিঠি দের, তারপর পাঠিয়ে তোমার নায়েব আর ভট্টচার্য, পাইক আর পেয়াদা।
.
অতঃপর রাজলক্ষ্মী দেবী তোড়জোড় করিয়া বিবাহের উদ্যোগ-আয়োজন করিয়া দেন আর মনে মনে হাসেন। হুঃ বাবা, পিসির কষ্টের জন্যে তো বুক ফাটিতেছে তোমার! আরে বাবা, যতই হোক বেটাছেলে, ভরা বয়েস, কত দিন আর বিধবা মেয়েমানুষের মত হেলায়ফেলায় জীবনটা কাটাইয়া দিবে! তবু যাই খুব ভালো ছেলে আমার বুলু, তাই অতদিন বিলেত ঘুরিয়া আসিয়াও গঙ্গাজলে ধোয়া মনটি। চাঁদের গায়ে কলঙ্ক আছে তো বুলুর গায়ে নেই। আর কিছু নয়–কলিকাতায় তো মেয়ে-পুরুষের মেশামেশি আছে, কোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব হইয়াছে। নিশ্চয়।