–খুঁজুক না, ক্ষতি কি? এই মুহূর্তটি নষ্ট হয়ে গেলে হয়তো আমিও খুঁজে পাব না আমার সাহসকে!
–এত ভয় কিসের?
–ভয়? ঠিক ভয় নয়, তবে ভরসার অভাব বলতে পারো। প্রতিদিন প্রস্তুত হয়ে আসি বলব বলে, কিন্তু ফিরে যাই। তবে আজ নিতান্ত প্রতিজ্ঞা করেই এসেছি…ওকি! তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
–না, কিচ্ছু না। কিন্তু আমি বলি কি–এতদিন যদি না বলেই কেটেছে, তবে আজও থাক।
–কিন্তু কেন? মেনে নাও না নাও–শুনতে তো তোমার ক্ষতি নেই তাপসী!
–ক্ষতি? হঠাৎ তাপসী কেমন অদ্ভুতভাবে হাসিয়া ওঠে–আমার ক্ষতি করার ভারটা স্বয়ং বিধাতাপুরুষ নিজের ঘাড়েই নিয়ে রেখেছেন–মানুষের জন্যে আর বাকি রাখেননি কিছু! তবু থাক।
–তবে থাক, হয়তো আজও সময় হয়নি। কিন্তু শুনতে পারলে বোধহয় ভালোই হত। কিংবা কি জানি, শোনাতে গেলে এটুকু সৌভাগ্যও আমার বজায় থাকবে কিনা! আচ্ছা থাক, আজকের গোলমালটা কেটেই যাক, চলো ভেতরে চলল।
–যাচ্ছি, আপনি যান।
.
এদিকে সত্যই তখন তাপসীকে ডাকাডাকি পড়িয়া গিয়াছে। অতিথি অভ্যাগত সকলেই যে তাপসীকে দেখিতে উৎসুক। চিত্রলেখা কিরীটীকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়াই সহর্যে বলিয়া ওঠে–এই যে এসে গেছ তুমি! বেবির সঙ্গে দেখা হয়েছে?
–হ্যাঁ, ওই যে বাগানের ওদিকটায় দেখলাম যে–
চিত্রলেখা মনে মনে হাসিয়া ভাবে–আহা মরে যাই, ইনোসেন্ট’ একবারে! নিভৃতে দেখা করিবার সুযোগ সৃষ্টি করিতে পূর্বাহ্নেই বাগানে গিয়া বসিয়া আছেন মেয়ে, এটুকু যেন চিত্রলেখা ধরিতে পারিবে না! দেখ দেখি–একটা অর্থহীন কুসংস্কারকে সার সত্য বলিয়া ধরিয়া লইয়া এই আগ্রহ-ব্যাকুল হৃদয়কে দাবাইয়া রাখিয়া কী বৃথা কষ্টই পাইয়াছ এতদিন! যাক, শেষ অবধি যে সুমতি হইল এই ঢের!
স্নেহমধুর কণ্ঠে গগদ ভঙ্গী আনিয়া চিত্রলেখা কিরীটীকে অনুযোগ করে–দেখে চলে এলে যে বড়! ডেকে আনতে হয় না?
–এখুনি আসবেন বোধ হয়।
–বোধ হয়? বাঃ, বেশ ছেলে তো বাপু! আজকের দিনে সে বেচারাকে ‘বোধ হয়’-এর উপর ছেড়ে দিয়ে চলে আসা কিন্তু উচিত হয়নি তোমার। এদিকে সকলে ওর জন্যে ব্যস্ত হচ্ছে। খাওয়ার আগে গান গাইবার, আর খাওয়ার পর গীটার বাজিয়ে শোনাবার প্রোগ্রাম রয়েছে–এদিকে মেয়ে নিরুদ্দেশ! বদ্ধ পাগল একটা! এবার থেকে বাপু আমি নিশ্চিন্ত, ওর পাগলামি সারাবার ভার তোমার!
কিরীটী মনে মনে হাসিয়া ভাবে–পাগলামি সারানোর ভার যে নেবে, সে বেচারাই যে পাগল হতে বসেছে।
অতঃপর চিত্রলেখা আমন্ত্রিতা মহিলাদের সঙ্গে কিরীটীর পরিচয় করাইয়া দিয়া প্রত্যক্ষে তাপসীর অসীম সৌভাগ্যের জন্য প্রশংসা এবং পরোক্ষে ঈর্ষা অর্জন করিতে থাকে। নিজেও বড় কম আত্মপ্রসাদ অনুভব করে না। রূপে-গুণে, বিদ্যায়-বুদ্ধিতে, অর্থে-স্বাস্থ্যে এমন অতুলনীয় জামাতা-রত্ন সংগ্রহ করা কি সোজা ব্যাপার! এই যে এতগুলি ভদ্রমহিলা সভা উজ্জ্বল করিয়া বসিয়া আছেন, ইহাদের মধ্যে কয়জন এমন রত্নের অধিকারিণী? অথবা অধিকারিণী হইবার আশা রাখেন? তাহার নিজের মেয়েটিও অবশ্য দুর্লভ রত্ন, তবু চিত্রলেখার ‘ক্যাপাসিটি’ও কম নয়।…কত কষ্টে, কত চেষ্টায়, কত যত্নে যে এই পরিস্থিতিটির সৃষ্টি করিতে হইয়াছে সে চিত্রলেখাই জানে।
পরিচয়-পর্ব শেষ হইলে চিত্রলেখা আর একবার স্নেহগদগদ কণ্ঠে বলে–নাঃ, বেবিটা দেখছি পাগল হয়ে গেছে! কি অদ্ভুত ছেলেমানুষ দেখেছ? তুমিই একবার যাও বাপু, ডেকে আনো গে। এত লাজুক মেয়ে–উঃ!
মেয়ের লজ্জার বহরে নিজেই যেন হাঁফাইতে থাকে চিত্রলেখা। তবে বেশীক্ষণ আর এই কৃত্রিম হাঁফানির প্রয়োজন হয় না, হাঁফাহাঁফি ছুটাছুটি করিবার উপযুক্ত একটা কারণ সৃষ্টি করিয়া দিয়াছে তাপসী। ডাকিতে গিয়ে আর খুঁজিয়া পাওয়া যায় না তাহাকে। বাগানে নয়, ঘরে নয়, সারা বাড়ীর কোথাও নয়। বাড়ীর খোঁজার পালা শেষ করিয়া বন্ধু-বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেকের বাড়ী এবং ক্লাব লাইব্রেরী সর্বত্র তোলপাড় করিয়া ফেলা হয়–দু’দশখানা মোটর লইয়া। একা চিত্রলেখাই নয়, গৃহস্থ আর নিমন্ত্রিত প্রত্যেকেরই ছুটাছুটি হাঁকাহাঁকির আর অন্ত থাকে না।
এমন অনাসৃষ্টি ব্যাপারের জন্য কেহই প্রস্তুত ছিল না, কাজে-কাজেই ইচ্ছামত জল্পনাকল্পনা করিতেও ত্রুটি রাখে না কেহই। পাকা দেখা’র দিন বিয়ের কনে হারাইয়া গেল, এমন মুখরোচক ব্যাপার কিছু আর সর্বদা ঘটে না, অতএব অনেক মন্তব্যই যে রসালো হইয়া উঠিবে এ আর বিচিত্র কি!
বেচারী ভাবী জামাতা কনের এমন অপ্রত্যাশিত ভাব-বিপর্যয়ে বিমূঢ়ভাবে গাড়ীখানা লইয়া বারকয়েক এদিক ওদিক করিয়া একসময়ে কোন্ ফাঁকে নিঃশব্দে চলিয়া যায়।
.
কান্তি মুখুজ্জের প্রতিষ্ঠিত “রাইবল্লভে”র বিগ্রহ ও মন্দিরের তত্ত্বাবধানের ভার শেষ পর্যন্ত রাজলক্ষ্মী দেবীর ঘাড়েই পড়িয়াছে। উপায় কি? আপনার বলিতে কে আর আছেই বা কান্তি মুখুজ্জের? অবশ্য মন্দির রক্ষার পাকা ব্যবস্থা হিসাবে–নিত্যসেবা ছাড়াও নিয়মসেবা, পালপার্বণ। ইত্যাদি বৈষ্ণব শাস্ত্রের তিনশো তেষট্টি রকম অনুষ্ঠানের জন্য সব কিছুই ব্যবস্থা আছে। পূজারী হইতে শুরু করিয়া ফুলতুলসী-যোগানদার মালীটি পর্যন্ত। তবু সবাই তো মাহিনা করা লোক, তাহাদের উপর তদারকি করিতে একজন বিনা মাহিনার লোক না থাকিলে সত্যকার সুশৃঙ্খলে । চলে কই? তাই রাজলক্ষ্মী স্বেচ্ছায় এই ভার মাথায় তুলিয়া লইয়াছেন। আর না লইয়াই বা করিতেন কি? তাঁহারও তো জীবনের একটা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে?