যাক আর নয়। ঘটনার প্রবাহে নিজেকে এবার ছাড়িয়া দিবে সে। দেখা যাক বিবাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের বজ্ৰ ভাঙিয়া আসিয়া তাপসীর মাথায় পড়ে কিনা। স্থানভ্রষ্ট চুলের গোছা ও শাড়ীর আঁচল গুছাইয়া উঠিয়া দাঁড়ায় তাপসী। ছাড়িয়া দিবে নিজেকে আলোর বন্যায়, উৎসবের কলস্রোতে। ছাড়িয়া দিবে নিজেকে মায়ের হাতে। ছাড়াইয়া লইবে নিজেকে বহুদিন-বর্ধিত সংস্কারের কঠিন শিলাতল হইতে।–নিঃশেষে সমর্পণ করিয়া দিবে আপনাকে প্রেমাস্পদের উন্মুক্ত বক্ষে, বলিষ্ঠ বাহুবেষ্টনের মধ্যে। সেই ভালো। তাই হোক। সেইটাই স্বাভাবিক। আজীবন বালবিধবার উদাস-ভঙ্গী আর নিস্পৃহ মন লইয়া এই শোভাসম্পদময়ী ধরণীতে টিকিয়া থাকার কোনো অর্থই হয় না।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্তর নিশ্চিন্ত মনোভাব লইয়াই যেন এবার সে উৎসব সমারোহের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করিতে যায়। হাস্যলাস্যময়ী তাপসীকে দেখিয়া অবাক হোক কিরীটী, মুগ্ধ হোক, ধন্য হইয়া যাক।
চোখ জুড়াক চিত্রলেখার। জ্বলিয়া মরুক লিলি।
অমিতাভ বুঝুক তার পছন্দ-অপছন্দকে কেয়ারও করে না তাপসী। তার প্রিয় ব্যক্তিকে অপমান করিয়া বিতাড়িত করার সাধ্য কাহারও নাই–প্রেমের মর্যাদায় তাহার আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিয়াছে তাপসী।
.
চটিটা পায়ে গলাইতেছে–পিছন হইতে ডাক পড়িল।
না চিত্রলেখার নয়, লিলির নয়, বন্ধু-বান্ধবী কাহারও নয়, নিতান্তই প্রিয় ব্যক্তিটির। যাহার চিন্তায় তাপসীর এত সুখ, এত যন্ত্রণা। যে তাপসীর দিন-রাত্রির শান্তি অপহরণ করিয়া লইয়াও তাপসীর প্রিয়তম।
যে আসিয়াছিল–পিছন হইতে কাঁধের উপর আলগোছে একটু স্পর্শ দিয়া আবেগ-মধুর কণ্ঠে ডাকিল–”তাপসী!”
তাপসী! কিরীটীর এত বড় সাহস বাড়িল কখন? তাপসীর সিদ্ধান্ত জানিয়া ফেলিল নাকি মনে মনে? অথবা চিত্রলেখার সস্নেহ প্রশ্রয়ের জের? তাপসীর কাঁধে হাত রাখিবার মত দুঃসাহস তো গত সন্ধ্যাতেও ছিল না তাহার!
কম্পিত তাপসী ঘুরিয়া দাঁড়ায়। সহজ হইবার চেষ্টায় আরও ভাঙা গলায় বলে–আপনি কখন এলেন?
–এই তো আসছি। গেটটা পার হতেই চোখে পড়ল এই নির্জন কোণে তোমার ধ্যানমগ্ন মূর্তি।…আজকের তুমি, আমার নিজস্ব আবিষ্কার তাপসী।
হায় হায়! নিজেকে যে এতক্ষণ ধরিয়া প্রস্তুত করিল তাপসী, কোথায় গেল সে সব? কোথায় সেই হাস্যেলাস্যে চপলতায় কিরীটীকে বিভ্রান্ত করিয়া ফেলিবার মত নূতন রূপ? আগের মতই অস্বচ্ছন্দ ভাবে বলে–চলুন বাড়ীর ভেতরে যাই।
–না না, থাক। কিরীটী ব্যগ্রস্বরে বলে–বাড়ী তো আছেই, থাকবেওকতকগুলো ঝঞ্জাট, গোলমাল, আর চোখ-জ্বালা আলো নিয়ে।…এমন পরিবেশের মধ্যে তোমাকে পাওয়া দুর্লভ নয়। কি?…বোসো লক্ষ্মীটি!
সন্ধ্যার আভাসে আকাশে পড়িয়াছে ছায়া, মাটির বুকে গোধূলির সোনার ঢেউটা ম্লান হইয়া আসিতেছে…বাগানের এই নিভৃত কোণটিতে তো আরও তাড়াতাড়ি ঘনাইয়া আসিবে অন্ধকার…এখানে একা একা কিরীটীর সঙ্গে মুখোমুখি বসিয়া থাকিবে তাপসী? আশ্চর্য প্রস্তাব তো!
নাঃ, সমর্পণের মন্ত্র বৃথাই এতক্ষণ অভ্যাস করিয়াছে সে। অসঙ্কোচে পাশে আসিয়া বসিতে পারিতেছে কই? বসিতে পারে না, প্রতিবাদও করে না, অভিভূতের মত দাঁড়াইয়া থাকে।
হয়তো এই অসতর্ক মুহূর্তেযদি কিরীটীর বলিষ্ঠ বাহুবেষ্টনীর ভিতর ধরা পড়িতে হইত তাপসীকে সমস্ত সহজ হইয়া যাইত, মোড় ফিরিয়া যাইত তাপসীর বাকি জীবনের, কিন্তু তাহা হইল না। অত সাহস কিরীটীর নাই।
এমনই হয় মানুষের জীবনে। প্রতিনিয়ত এমনি কত সম্ভাবনাময় মুহূর্ত বৃথা নষ্ট হয়–সমস্যা মীমাংসার প্রান্তসীমায় আসিয়া ধাক্কা খাইয়া ফিরিয়া যায় জটিলতার পথে– হৃদয়াবেগের সহজ প্রকাশ আচ্ছন্ন করিয়া তোলে অকারণ কুণ্ঠার কুয়াশা।
দস্যুর মত লুঠ করিয়া লইবার সাহস সকলের থাকে না। কিরীটী তাপসীর মতই ভীরু, কুণ্ঠিত, লাজুক। তাই কাঁধের উপরকার আলগোছ স্পর্শটুকুও সরাইয়া লইয়া শুধু কণ্ঠস্বরে সমস্ত আগ্রহ ভরিয়া বলে–তাপসী শোনোপালিয়ে যেও না। আজ আমাকে কিছু বলতে দাও। যে কথা বলতে না পেরে আমার দিনরাত্রি শান্তিহীন, যে কথা বলবার জন্যে আমার সমস্ত হৃদয় অস্থির হয়ে থাকে, সাহসের অভাবে যা কোনোদিনই বলতে পারিনি, আজকের এই পরম মুহূর্তে বলতে দাও সেই কথাটি।
‘বলতে দাও!’ বলিতে দিবার প্রয়োজন আছে নাকি? তাপসী কি জানে না সেই কথাটি? সৃষ্টির আদিকাল হইতে নারীর উদ্দেশে যে কথা ধ্বনিত হইয়া আসিয়াছে পুরুষের বিহ্বল কণ্ঠে, সেই কথাটিই আর একবার ধ্বনিত হইবে নূতন ছন্দে, নূতন মহিমায়। কিন্তু নারীর কণ্ঠ ধ্বনিত হয় না বলিয়াই কি তাহার কথা অপ্রকাশিত থাকিয়া যায়? নারীর শিরায় শিরায় রক্তের উন্মাদ দোলায় ধ্বনিত হয় না সেই চিরন্তন বাণী? তার নির্বাক ভঙ্গিমায় উচ্চারিত হইতে থাকে না প্রেম নিবেদনের বিহ্বল ভাষা? উচ্চারণ করিবার প্রয়োজনই বা তবে কোথায়? দোক্ত কোমল দুখানি করতল বলিষ্ঠ তপ্ত দুই মুঠিতে চাপিয়া ধরিয়া শুধু পাশাপাশি বসিয়া থাকাই তো যথেষ্ট। বিশেষণ খুঁজিয়া খুঁজিয়া কথা সাজাইবার দুরূহ পরিশ্রম বাঁচিয়া যায়।
কিন্তু পরিশ্রম বাঁচাইবার কৌশল সকলে জানিলে তো! তাপসী এক নিমেষ চোখ তুলিয়া তাকাইয়া অস্ফুটস্বরে যা বলে–শুনিতে পাওয়া গেলে বোধ করি তার অর্থ এই দাঁড়াইত– ওদিকে হয়তো সকলে তাপসীর অনুপস্থিতিতে ব্যস্ত হইতেছে, খুঁজিতে আসিবে এখুনি, অতএব–