যদি কিরীটীর দিক হইতে সাহসের প্রাবল্য থাকিত, তাপসী কি খুঁটি আঁকড়াইয়া টিকিয়া থাকিতে পারিত? কে জানে, কোনোদিন তো এমন স্পষ্ট করিয়া মনকে প্রশ্ন করিয়া দেখে নাই। সভয়ে পাশ কাটাইয়া চলিতে চেষ্টা করিয়াছে মাত্র।
অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করিতে করিতে হঠাৎ এক সময়ে যেন কঠিন হইয়া ওঠে তাপসী। প্রশ্নে প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করিয়া তোলে নিজেকেই। কেন, কেনই বা সে চিরকাল এমন বঞ্চিত হইয়া থাকিবে? পাপের ভয়ে? না সেই খেলাঘরের বরের আশায়?
দু’টোই সমান অর্থহীন। যে কাজের জন্য সে নিজে এক বিন্দু দায়ী নয়, তাহার পাপ-পুণ্যের ফল ভুগিয়া মরিবার দায় কেন তাহার?…বোকামি? স্রেফ বোকামি–আশাহীন আনন্দহীন প্রেমস্পর্শহীন নিরর্থক জীবনটা জনশূন্য ঘরে নিরর্থক জ্বলিয়া যাওয়া মোমবাতির মত কেবলমাত্র জ্বলিয়া জ্বলিয়া নিঃশেষ হইতে থাকিবে?
প্রতিনিয়ত নিজেকে চাবুক মারিয়া মারিয়া ধর্ম বজায় রাখাই কি নারীধর্ম? চাবুক শুধু নিজেকে মারা নয়–আরো একখানি আগ্রহোম্মুখ প্রসাদ-ভিক্ষু হৃদয়কেও যে চাবুক মারিয়া ফিরাইতে হইতেছে!..বুলু বুলু! কোথায় সেই অপরিণতবয়স্ক বালক? সে কি আজও বাঁচিয়া আছে? স্বামীত্বের দাবী লইয়া কোন দিন কি উপস্থিত হইবে তাপসীর কাছে? স্বামী বলিয়া গ্রহণ করিতে পারা যায় এমন যোগ্যতা অর্জন করিয়াছে কি? তাপসী কি তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইবে?
কিন্তু তাপসীর সহায় কে? মা প্রতিকূল, অভী নিতান্তই বিমুখ। বাবলু তো বালক মাত্র। তবে কে? নানি? নানিই তো তাহার জীবনের শনি।…নয়তো কি? মনে মনে সেই শনিকে উদ্দেশ করিয়াই প্রশ্নে জর্জর করিতে থাকে তাপসী।…কেন? কেন? অমন উদাসীন নিশ্চিন্ততায় কাশীবাস করিবারই বা প্রয়োজন কি ছিল তোমার? যে জট পাকাইয়া রাখিয়াছ, তাহার গ্রন্থি খুলিবার দায়িত্ব কি কিছুই নাই তোমার? একবার কি কুসুমপুরে যাওয়া যায় না? কাশীর মায়া কাটাইয়া দেশে আসিয়া একবার খোঁজখবর লওয়া উচিত ছিল না কি? তাপসীর ইহকাল পরকাল খাইয়া চিত্রলেখার উপর অভিমান করিয়া দিব্য আরামে বসিয়া আছ, বিকার মাত্র নাই?
নানির সঙ্গে একবার নিজেই যদি দেশে যাইতে পাইত তাপসী! খুঁজিয়া দেখিত–দেবমন্দিরের সেই উদার প্রাঙ্গণে সেই স্থলকমলের মত আরক্তিম দুখানি পায়ের ছাপ আজও আছে কিনা?
ধ্যেৎ! এ কি পাগলের মত ভাবনা শুরু করিয়া দিয়াছে তাপসী! বাঁচিয়াই যদি থাকে, সেই অগাধ ঐশ্বর্যের মালিক এখনো গৃহিণীশূন্য গৃহে নীরস জীবনযাপন করিতেছে নাকি? পাগল! তাও আবার পাড়াগাঁয়ের ছেলে! কলিকাতার হোস্টেলে থাকিয়া পড়ালেখা করিবার কথা ছিল। বলিয়াই যে করিয়াছে–তাহারই বা নিশ্চয়তা কি? অল্প বয়সে অনেক পয়সা হাতে পড়ায় কুসঙ্গে পড়িয়া বিগড়াইয়া বসিয়া আছে কিনা কে বলিতে পারে?
সকলের উপর কথা–বাঁচিয়া আছে কিনা! বাঁচিয়া থাকিলে–নিজেই কি এতদিনে একটা সন্ধান লইতে পারিত না? কিন্তু প্রয়োজনই বা কি তাহার? প্রয়োজন থাকিলে হয়তো লইত। অবশ্য প্রথমদিকে এখানের ব্যবহারটা ভদ্রজনোচিত হয় নাই, তবু শিক্ষা-দীক্ষা–যদি সব কিছু। পাইয়া থাকে– সভ্যতা-ভব্যতার একটা মূল্য আছে তো? বিবাহিতা পত্নীর পত্নীত্বকে উড়াইয়া দিয়া–
বিবাহিতা? আচ্ছা, বিবাহটা কি সত্যই শাস্ত্রসম্মত হইয়াছিল? ‘বিবাহ’ বলিয়া গণ্য করা যায় তাহাকে? বহুদিন বহুবার সেই কথাটাই ভাবিতে চেষ্টা করিয়াছে তাপসী, আজকে খোলা চোখে স্পষ্ট করিয়া ভাবিতে বসে। হয়তো যে বাধাটাকে সে দুর্লঙ্ মনে করিয়া এতদিন বিরাট একটা মূল্য দিয়া আসিতেছে, আসলে সেটা কিছুই নয়, বিরাট একটা ফাঁকি মাত্র! শখের যাত্রাদলের রাজারাণী সাজিয়া অভিনয় করার মত। সে অভিনয়ের অন্যতম অভিনেতা কোন্ কালে সেই অভিনয়-সজ্জা খুলিয়া স্বাভাবিক জীবনযাপন করিতেছে।
সেই খামখেয়ালী খেলার অভিনয়ের রাণীত্ব লইয়া, ভিখারিণীর মত নিজেই তাহার দুয়ারে গিয়া দাঁড়াইবে তাপসী? বলিবে–এই দেখ আমি তোমার জন্য দীর্ঘকাল শবরীর প্রতীক্ষা করিতেছিলাম, আজ আসিয়াছি তোমার চরণে শরণ লইয়া ধন্য হইতে!
চিনিতে না পারিয়া সে যদি হাসিয়া ওঠে? যদি পূর্ব অপমানের শোধ লইতে অপমান করিয়া তাড়াইয়া দেয়? নিজের সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রার মাঝখানে আকস্মিক উপদ্রব ভাবিয়া অবজ্ঞা করে?
তবু যাইবে নাকি তাপসী? যাইবে সতীনের ঘরে অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা করিতে?
ছি ছি!
চিত্রলেখাই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন সংসার-অভিজ্ঞ মানুষ। তাই উড়াইয়া দিবার বস্তুকে চিরদিন উড়াইয়া দিয়াই আসিতেছে। ঘরে বাহিরে কোথাও কোনোদিন সে কথাটুকু উচ্চারিত মাত্র হইতে দেয় নাই।
তাপসী মিথ্যা স্বপ্নের মোহে, মিথ্যা সংস্কারের দাসত্বে আজীবন নিজেও কষ্ট পাইল, মাকেও কম কষ্ট দিল না। চিত্রলেখার এই যে কাঙালপনা, এই যে রোষ ক্ষোভ অসহিষ্ণুতা, সব কিছুর মূল কারণই তো তাপসীর ভবিষ্যৎ সুখের আশা। হয়তো চিত্রলেখার ধারণাটা ভুল, কিন্তু সন্তানের সুখ-চিন্তায় তো ভুল নাই। তবে তাপসী সেই মাতৃহৃদয়কে অবহেলা করিবে কোন্ শ্রেয় বস্তুর আশায়?
আর–আর শুধুই কি মাতৃহৃদয়? আর একখানি উন্মুখ হৃদয়কে চাবুক মারিয়া মারিয়া দূরে সরাইয়া দিবার কঠোর যন্ত্রণা নিজের হৃদয়কেও কি অহরহ ক্ষতবিক্ষত করিয়া তুলিতেছে না?