লিলি ছুটিয়া আসিয়া বলে–এই বেবি, তোর বর কখন আসবে তাই ব! সত্যি বলতে, ওই জন্যই এলাম আরো!
তাপসী হাসিয়া বলে–ও কি, বরং বলো ‘জামাতা বাবাজী’! মাসী হও না তুমি আমার?
–ছেড়ে দে ওকথা। সত্যি বল না রে?
–কি করে জানব? এলেই দেখতে পাবে।
–ইস্, উনি জানেন না আবার! বলবি না তাই বল!…এই শাড়ীখানা কত দিয়ে কিনলি রে? ফাইন শাড়ীখানা!
তাপসী হাসিয়া বলে–আমি কোথায় কিনলাম, মা তো–মায়েরই পছন্দ।
–মা! মাই গড! এখনো তোর শাড়ী-ব্লাউজ বড়দি পছন্দ করে দেন? আছিস কোথায়? বরটিকে পছন্দ করার ভারটা নিজের ভাগে রেখেছিস কিছু, না সেও মা যা করবেন!
–নিশ্চয় তো, আমি ও নিয়ে মাথা ঘামাইনে।
–ইস্, ইনোসেন্ট গার্ল একেবারে! তবু যদি না সেদিন বড়দির মুখে শুনতাম, রুমাল মুখে– চাপিয়া খুক খুক’ করিয়া হাসিতে থাকে লিলি।
তাপসী সহসা গম্ভীর হইয়া বলে–কি শুনলে?
–এই–সে বেচারা প্রেমে সাঁতার-পাথার খাচ্ছে একেবারে, আর তুমি—
হঠাৎ যেন চকিতে শিহরিয়া ওঠে তাপসী–এই এই, রুমালে লেগে যায়নি তো?
হতচকিত লিলি বলে–লেগে যাবে? কি লেগে যাবে?
–রং! তোমার কোটিংটা বোধ হয় কাঁচা রয়েছে এখনো!
কথাটা মিথ্যা নয়, লিলিকে দেখিলে একটি সদ্য-রং করা কাঁচামাটির পুতুল বলিয়াই মনে হয়।
লিলি পরিহাসপ্রিয় বটে, কিন্তু নিজে পরিহাস করা এক, আর অপরের পরিহাস পরিপাক করা আর। তাই মুখ ফুলাইয়া উত্তর দেয়–কি করব বলল, তোমার মতন খাঁটি পাকা রং নিয়ে তো জন্মাইনি ভাই, আমাদের কাঁচা রং মাখা ভিন্ন উপায় কি!
তাপসী তাড়াতাড়ি বলে–আচ্ছা রোসো, কাঁচা-পাকার তর্ক এসে করব, একবার নীচের তলা থেকে ঘুরে আসি। মা একটা কাজ বলেছিলেন, দারুণ ভুলে গেছি।মাসীর হাত এড়াইবার এই সহজ কৌশলটা আবিষ্কার করিয়া বাঁচিয়া যায় যেন। এই ধরনের পচা পুরনো সস্তা রসিকতাগুলো সহ্য করা যে তাপসীর পক্ষে কত বিরক্তিকর, সে কথা কে বুঝিবে? নিতান্তই নাকি পরিহাসের উত্তরে হাস্য-পরিহাস না করিলে অভদ্রতা হয়, তাই নিজেরও তাহাতে যোগ দেওয়া। যাহা বলিতে হইয়াছে, তাহার জন্যই যেন তিক্ত হইয়া ওঠে মনটা।
দূর ছাই, এদের কবলমুক্ত হইয়া কোথাও সরিয়া পড়াই ভালো। বাগানের মধ্যে প্রিয় পরিচিত সেই জায়গাটিতে বরং বসা যাক খানিক একদা মণীন্দ্র যে জায়গাটিতে একটা সিমেন্টের বেদী গাঁথাইয়া রাখিয়াছিলেন, মাঝে মাঝে আসিয়া বসিবার জন্য। জায়গাটা তাপসীর একান্ত প্রিয়। আসিয়া বসিলেই যেন বাবার উপস্থিতি অনুভব করা যায়।
.
তাপসী চলিয়া গেলে লিলি রাগে ফুলিতে থাকে। বাস্তবিক, কাঁচা রং-এর উল্লেখে কোন মেয়েই বা অপমানের জ্বালায় ছটফট না করে! সত্যি বলিতে কি, তাপসীর উপর একটা আকর্ষণ অনুভব করিলেও, ওই যে ওর কেমন একটা স্বাতপ্রিয় আভিজাত্যের ভাব আছে, ওইটাই লিলির হাড়পিত্ত জ্বালাইয়া দেয়!
আর কিছু নয়, রূপের গরব! তেমনি একচোখো ভগবান! রূপ দিয়াছ, দিয়াছ স্বাস্থ্যটাও কি এমন অনবদ্য দিতে হয় যে, রোগা হইতে জানে না, মোটা হইয়া পড়ে না বরাবর এক রকম! যেন একটি নিটোল পাকা ফল! রসের প্রাচুর্য আছে–আধিক্য নাই! শাঁস আছে–ভার নাই!
আর লিলি? লিলির বিধাতা শৈশবাবধি এত শাঁসালো আর রসালো করিয়া গড়িয়াছেন। লিলিকে যে আধুনিক হইবার সমস্ত উপকরণই যেন তাহার দেহে উপহাস হইয়া দাঁড়ায়। অতএব সুমধ্যমা তন্বী রূপসীদের উপর যদি সে হাড়ে-চটা হয় তো দোষ দেওয়া যায় না! তাহার উপর আবার যদি সে রূপসী একটি কন্দর্পকান্তি বর যোগাড় করিয়া ফেলে!
.
হায়, শুধু কি লিলিই জুলিতে থাকে? তাপসীর ভিতর কি দুর্দমনীয় জ্বালা, সে কথা বুঝিবার সাধ্য লিলির আছে?
নিজেকে সমস্ত কোলাহল আর সমারোহের মাঝখান হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া বাগানের একপ্রান্তে গিয়া নিজেকে যেন ছাড়িয়া দেয় তাপসী। হে ঈশ্বর, এ কি করিতে বসিয়াছে সে? অমিতাভর উপর প্রতিশোধ লইতে গিয়া নিজেকে কোন্ অধঃপাতের পথে ঠেলিয়া দিবার আয়োজন শুরু করিয়াছে?
অধঃপাত ছাড়া আর কি বলা যায়? আর ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে এতগুলো লোককে সাক্ষী রাখিয়া কিরীটীর সঙ্গে বিবাহবন্ধন পাকা করিয়া ফেলিবার দলিলে সই করিতে হইবে তাহাকে! আত্মহত্যা ছাড়া আত্মরক্ষার আর কোন উপায় থাকিবে না তাহার!
বাবা বাবা! তুমি কেন তোমার আদরের বেবির জীবনের এই জটিল জটটা না ছাড়াইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া চলিয়া গেলে? নিঃসঙ্গ তাপসীর আশ্রয় কোথায়? কে তাহাকে সত্যকার উচিত অনুচিত শিক্ষা দিবে?
যখন নিজের হৃদয়ের সঙ্গে আপস ছিল, তখন তবু সহজ ছিল। সহজ ছিল চিত্রলেখার অসঙ্গত ইচ্ছাকে হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া। আজ যে দ্বন্দ্ব বাধিয়াছে আপন হৃদয়ে, একে উড়াইয়া দেওয়া আর সহজ কই!
অমিতাভ ছেলেমানুষ হইলেও উচিত কথাই বলিয়াছিল। সত্যই তো, কি প্রয়োজন ছিল কিরীটীকে এত প্রশ্রয় দিবার? দিনের পর দিন কিসের আশা দিয়া তাহাকে প্রলুব্ধ করিয়া আসিয়াছে তাপসী? নিজের মনের–নিজের অজানিত চাপা লোভের বশেই নয় কি? সেই লোভই ভদ্রতার ছদ্মবেশে পদে পদে প্রতারিত করিয়াছে তাপসীকে। কিরীটীকে প্রত্যাখ্যান করিবার মত সাহস যোগাইতে দেয় নাই। বিদ্রোহের একটা ভান করিয়া আসিয়াছে বটে বরাবর, কিন্তু আত্মসমর্পণে উন্মুক্ত চিত্র লইয়া বিদ্রোহের অভিনয় করার কি সত্যই কোনো মানে আছে? হয়তো বা–হয়তো বা এতদিন যে বিকাইয়া যায় নাই, সে শুধু কিরীটীর ভীরুতার জন্যই–দস্যর মত লুণ্ঠন করিয়া লইবার শক্তি কিরীটীর নাই। প্রার্থীর মত অপেক্ষা করে। অসতর্ক কোনো মুহূর্তে ওর এই নিশ্চেষ্ট সম্ভ্রমের ভঙ্গী কি অসহিষ্ণু করিয়া তুলে নাই তাপসীকে?