–চমকার ভাগ্যটি আমার বটে! চিত্রলেখা উল্টানো দুই হাতের সাহায্যে ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া অমিতাভর পরিত্যক্ত চেয়ারটা টানিয়া বসিয়া পড়িয়া বলেসতীনের ছেলেমেয়েকে প্রতিপালন করলেও বোধহয় এর থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়া যেত তাদের কাছ থেকে।
.
ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাইলেও চিত্রলেখা অনুষ্ঠানের ত্রুটিমাত্র রাখিল না। এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন সৌষ্ঠবসম্পন্ন ভাবে কাজ করা যে একমাত্র চিত্রলেখার পক্ষেই সম্ভব সে কথা তাহার পরম শত্রুতেও অস্বীকার করিতে পারিবে না।
সম্ভব হইয়াছে কি আর অমনি? সমস্ত জীবনটাই চিত্রলেখা উৎসর্গ করিয়া দিয়াছে কাহার পায়ে? ওই সভ্যতা-সৌষ্ঠবের পায়েই নয় কি?
প্রতিনিয়ত পারিপার্শ্বিক সমস্ত প্রতিকূলতার সহিত সংগ্রাম করিতে করিতে ক্ষত-বিক্ষত হইয়াছে, স্বামী-সন্তান সকলের সহিত বিরোধ করিয়া আসিয়াছে, নিজে মুহূর্তের জন্য বিশ্রামের শান্তি উপভোগ করিতে পায় নাই, তবু হাল ছাড়ে নাই। তাই না আজ দশের একজন হইয়া সমাজে বিচরণ করিতেছে। তবু তো ছেলেদের মানুষ করিয়া তুলিবার জন্য কতই পরিকল্পনা ছিল, কিছুই প্রায় সফল হয় নাই, উপযুক্ত অর্থের অভাবে অনেক উচ্চ আদর্শকে খর্ব করিতে হইয়াছে।
হায়, ছেলেমেয়েরা চিত্রলেখার সে আত্মত্যাগের মর্ম কোনদিন বুঝিল না। কাহাদের জন্য চিত্রলেখার এই সংগ্রাম, এই সাধনা? কি নিরুপায় অবস্থার মাঝখানে ভাসাইয়া দিয়া স্বামী চলিয়া গেলেন, একদিনের জন্য কি সে অবস্থার আঁচ তাহাদের গায়ে লাগিতে দিয়াছে চিত্রলেখা? একা অসহায়া নারী সমস্ত দায়িত্ব বহন করিয়া লগি ঠেলিতে ঠেলিতে মাঝদরিয়া হইতে তীরের কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছিয়াছে আজ। কিন্তু বেচারা চিত্রলেখার ভাগ্যে যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর! ছেলেমেয়েরা এমন ভাব দেখায় যেন চিত্রলেখা আজীবন তাহাদের অনিষ্ট করিয়াই আসিতেছে! যেন সেই বুড়ী ঠাকুরমার কাছ হইতে গোবর-গঙ্গাজলের দীক্ষায় দীক্ষিত হইয়া জীবন কাটাইতে পারিলেই তাহাদের ছিল ভালো! কী নিষ্ফল জীবন চিত্রলেখার!
তবু তোকই ওদের হিতচেষ্টা হইতে নিবৃত্ত হইতে পারে না। বেবির কাছ হইতে শত লাঞ্ছনা গঞ্জনা খাইয়াও বেবির জন্যই অসাধ্য সাধনের সাধনা করিয়া মরিতেছে। তাহাকে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত না দেখা পর্যন্ত মরিয়াও যে শান্তি হইবে না চিত্রলেখার।
এই যে আজকের ব্যাপারটা, এর জন্য কত কাঠখড় পোড়াইতে হইয়াছে, হইতেছে এবং হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে–কে তাহার হিসাব রাখে? এর জন্য কতদিন কতদিকে যে কৃচ্ছসাধন করিতে হইবে! ইচ্ছামত অর্থব্যয় করিবার সামর্থ্যও যদি থাকিত আজ!
মণীন্দ্রর জন্য মন-কেমন না করিয়া হিংসাই হয়। যেন সব কিছু জ্বালা-যন্ত্রণা চিত্রলেখার ঘাড়ে চাপাইয়া টেক্কা মারিয়া চলিয়া গিয়াছেন মণীন্দ্র।
আজকের ব্যাপারে চিত্রলেখার পরিশ্রমের চাইতে উদ্বেগটাই ছিল প্রবল, যে মেয়ে শেষ পর্যন্ত সহজ থাকিলে হয়! নিজের সন্তানকে চিনিতে পারা যায় না, এর চাইতে দুর্দান্ত পরিহাস আর কি আছে জগতে!
নিমন্ত্রিতের সংখ্যা বিরাট কিছু নয়। নিতান্ত বন্ধুগোষ্ঠী কয়েকজন, যাঁহাদের কাছে সবকিছু দেখাইয়া তৃপ্তি নাই। আর চিত্রলেখার সেজকাকীমার পরিবার। অনেক ভাগ্যে এ সময়টা যখন কলিকাতায় রহিয়াছেন তাহারা। দেখিবার এবং দেখাইবার এমন সুযোগ ক’বার আসে? কিরীটীর মত জামাই সংগ্রহ করা যে সেজকাকীর স্বপ্নেরও বাহিরে, এ কি আর বলিয়া বুঝাইতে হইবে? তাহার মেয়ের তো সেই রূপ! কালো হাতী’ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। তার উপর আবার নাকি বার দুই আই.এ. ফেল করিয়া নামকাটা সেপাই হইয়া বসিয়া আছে।
কন্যার সৌন্দর্য-গর্বে নূতন করিয়া যেন বুকটা দশহাত হইয়া ওঠে।
তাছাড়া বিদ্যা? টকাটক করিয়া এম.এ. পর্যন্ত পাস করিয়া ফেলিল, হোঁচট খাইল না, ধাক্কা খাইল না–শুধু একটি জিনিসের নিতান্তই অভাব, যে অভাবটা চিত্রলেখার মনে একটা গহর রাখিয়া দিয়াছে।
মডার্ন কালচারের অভাব। বেশভূষার পারিপাট্য যে নাই মেয়ের তা নয়, তবু কেমন যেন সামঞ্জস্যহীন, অসম্পূর্ণ। হয়তো দশদিন খুব বাড়াবাড়ি করিল, আবার দশদিন যেমন তেমন করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে শুরু করিল। সেই মূর্তি লইয়া বাহিরের লোকের সামনে বাহির হইতেও আপত্তি নাই। এ আর শোধরানো গেল না। তাছাড়া নাচ-গানের দিকেও আজকাল আর যাইতে চাহে না, অকৃত্রিম সাধারণ গলায় কথা বলে, কথাবার্তা কোন কিছুরই কায়দা জানে না।
অথচ সেজকাকীমার মেয়ে লিলি, সেই পাটের গাঁটের মত দেহটা লইয়া কি নাচ নাচিয়াই বেড়ায়!…কথায়-বার্তায় চাল-চলনে একেবারে কায়দা-দুরস্ত!
.
পাঁচটা বাজিতেই লিলি আসিয়া হাজির হইল। মা আসিতে পারিবেন না, তাই একাই আসিয়াছে সে। চিত্রলেখার রোষক্ষুব্ধ প্রশ্নের উত্তরে মিহি মিহি আদুরে গলায় বলে–কি করব বলুন বড়দি, মা’র যে ভীষণ মাথা ধরে উঠল, আমারই আসা সম্ভব হচ্ছিল না, নেহাৎ আপনি দুঃখিত হবেন বলেই
–অসীম দয়া তোমার এবং তোমার মা’র–কিন্তু সেজকাকা?
–বাবার তো কদিন থেকেই প্রেসার বেড়েছে।
–ওঃ! টম জিম?
–তাদের যে আজ ম্যাচ রয়েছে।
–শুনে খুশী হলাম। এরকম মণিকাঞ্চন-যোগ হওয়াটা একটু আশ্চর্য এই যা! ভারী মুখে সরিয়া যায় চিত্রলেখা অন্য অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা করিতে। যা করিবে সবই তো একা। আজ বেবি বিয়ের কনে, তাকে কিছু আর এ ভার দেওয়া চলে না।…আর কিছুই নয়, এটি সেজকাকীমার ঈর্ষার ফল! দেখিলে বুক ফাটিয়া যাইবে তো!