অর্থাৎ মাকে দিদিকে সে আজকাল ঘৃণা করিতেই আরম্ভ করিয়াছে।
তাপসীকে উত্তেজিত হইতে বড় একটা দেখা যায় না, মা’র সঙ্গে কথা কয় এত ঠাণ্ডা মাথায় যে চিত্রলেখাই জ্বলিয়া যায়। কিন্তু অমিতাভর কথায় বড় বেশী উত্তেজিত দেখায় তাহাকে। উত্তেজনার মুখে তর্কের খাতিরে হয়তো বা নিজের মতবিরুদ্ধ কথাই বলে। কিংবা মতবিরুদ্ধ নয়ও–নিজের মনের আসল চেহারা নিজেরই জানা নাই তাহার, উত্তেজনার মুখে প্রকাশ হইয়া পড়ে। বলে–তাই যদি হয়, সেটা কি খুবই সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড হবে তুমি মনে করো অভি? এতই যখন বুঝতে শিখেছ–এটুকুও বোঝা উচিত ছিল-তোমার ভাষায়–’মতলব নিয়ে ঘোরাঘুরি করাটা’ অসম্ভব কিছুই নয়, অস্বাভাবিক নয়।
–হতো না–যদি বাড়ীর সকলের জীবনটাও ঠিক স্বাভাবিক হতো! বলিয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়ায় অমিতাভ।
.
সন্দেহের অবকাশ আর থাকে না। বোঝা যায় চিত্রলেখার শিক্ষা সকল ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হইয়াছে। অতি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ অমিতাভর চিত্তবৃত্তিও শিকড় গাড়িয়া বসিয়া আছে পিতামহীর আমলের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার বনভূমিতে। তাপসীর সেই খেলাঘরের বিবাহটাকে ‘খেলা’ বলিয়া উড়াইয়া দিবার সাহস বা ইচ্ছা তাহারও নাই। তাই তাপসীর প্রণয়লাভেছু কিরীটীকে দেখিলে আপাদমস্তক জ্বলিয়া যায় তাহার, আর যদিও তাপসী ‘বড়ত্বের’ দাবী রাখে, তবু ‘দাদাগিরি’ ভাবটা বরাবর অমিতাভ ফলাইয়া আসিয়াছে বলিয়াই নিজের বিরক্তি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করিতে দ্বিধা করে না।
কিন্তু তাপসীই বা হঠাৎ এত জোর পাইল কোথায়? নিজের বিষয়ে সাহস করিয়া বলিবার মত জোর? অমিতাভর কাছে তো চিরদিনই কাঁদিয়া পরাজয় মানিয়া আসিয়াছে সে। অথচ যা বলে চিত্রলেখা শুনিলে অবাক বনিয়া যাইত।–স্বাভাবিক নয় বলে যে তাকে স্বাভাবিক করে নেবার চেষ্টামাত্র না করে ভাসিয়ে দিতে হবে, জীবন জিনিসটা কি এতই সস্তা অভী?
–তা বেশ তো, জীবনটা দামী করে ভোলো না! অমিতাভর সুরে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ, বরং মা’র মনে একটা সান্ত্বনা থাকবে যে একজনও মানুষ হল! তবে এও জেনো, এ বাড়ীর ভাত বেশী দিন বরখাস্ত করা আমার পক্ষে শক্ত।
–কি বাজে বাজে বকছিস দাদা? সিদ্ধার্থ কথাবার্তার সুর লঘু করিয়া আনিতে চেষ্টা করে।
অমিতাভ কিছু বলিবার আগেই রঙ্গস্থলে আসিয়া হাজির হয় চিত্রলেখা। মনে হয় যেন আগাগোড়া বর্মাবৃত অবস্থায় সাঁজোয়া গাড়ীতে চড়িয়া একেবারেই ফিল্ডে নামিয়াছে সে। রণং দেহি’র সুরেই বলে–দেখ বেবি, অভী তুমিও রয়েছ ভালই–আমি আজ সন্ধ্যায় একটা পার্টি দিতে চাই। মিস্টার মুখার্জি হবেন তার প্রধান অতিথি। বেবির এনগেজমেন্টটা আজ পাঁচজনের সামনে পাকাপাকি করিয়ে নিয়ে তবে আমার কাজ। এভাবে বেশীদিন সমাজের সকলের আলোচনার বস্তু হয়ে থাকা আমার রুচিবিরুদ্ধ।
চিত্রলেখার কপাল জোর, এইমাত্র অমিতাভর সঙ্গে ঝগড়ায় জিতিতে গিয়া এরকম কথা বলিয়া বসিয়াছে তাপসী, এখন অমিতাভর সামনেই বা মার কথার প্রতিবাদ করে কোন মুখে!
আড়চোখে একবার মেয়ের দিকে তাকাইয়া লয় চিত্রলেখা–না, কোনো প্রতিবাদ আসিল না। ভাগ্যিস! খুব ঝোঁপ বুঝিয়া কোপ মারা হইয়াছে! হুঁ বাবা, এইবার ধরা পড়িয়া গিয়াছ! যতই হোক, চিত্রলেখার বুদ্ধির কাছে তোদের বুদ্ধির গুমর!
অবশ্য বিধাতাপুরুষও এবার চিত্রলেখার সহায় হইয়াছেন। বেবির গতরাত্রের নাহোক ‘মাথাধরা’র পর ভোরবেলাই কিরীটীর হন্যে হইয়া ছুটিয়া আসা এবং তখন দিব্য সপ্রতিভ বেবির তাহার সঙ্গে সপ্ৰেম হাস্যপরিহাসের দৃশ্যটা দোতলার জানালা হইতে যা-ই চোখে পড়িয়াছিল তাহার, তাই না এত সাহস!
যা ভাবিয়াছিল সে তাছাড়া কিছুই নয় বাপু, বুঝিতে বাকি নাই তাহার। কালকের কিছু একটা বেয়াদবির জন্যই অপরাধী ব্যক্তিটি সকাল না হইতেই ছুটিয়া আসিয়াছিল মার্জনা ভিক্ষা করিতে।
আসিবেই তো–মেয়েদের চিনিতে যে এখনো অনেক দেরি আছে তাহার। শুধু তাহার কেন, গোটা পুরুষ জাতটারই। কিন্তু চিত্রলেখা তো আর পুরুষ নয় যে জানিতে বাকি থাকিবে তাহার-বেয়াদবিটাই পছন্দ করে মেয়েরা। বরং প্রার্থিত বেয়াদবির অভাব দেখিলেই অসহিষ্ণু নারীপ্রকৃতি খাপছাড়া ভাবে বিগড়াইয়া যায়। কিন্তু এমন মূল্যবান তথ্যটা তো আর ভাবী জামাতাকে শিখাইয়া দিবার বিষয় নয়, দিবার হইলে এতদিনে কিরীটীর ব্যাপারের সুরাহা হইয়া যাইত।
অমিতাভ মার দিকে ও বোনের দিকে এক সেকেন্ড তাকাইয়া লইয়া বলে–পার্টি দেবে– সেটা তোমার বিজনেস, তাতে আমাদের অনুমতির দরকার হবে না নিশ্চয়ই?
–অনুমতির দরকার হবে, এখনো এতটা দুর্ভাগ্য হয়নি বলেই বিশ্বাস, তবে কিছুটা সাহায্যের দাবি রাখি। আমি এখন যাদের যাদের বলবার বলতে বেরোচ্ছি–ঘুরে এসে নিমন্ত্রিতদের একটা লিস্ট তোমায় দেব, তুমি কয়েকটা জিনিস আমায় এনে দেবে, আর নিউমার্কেট থেকে কিছু ফুল। খাবার-টাবার সম্বন্ধে আমি নিজেই সমস্ত ব্যবস্থা করব, তোমাদের কোনো ভার দিতে চাই না।
–গাড়ী ঘুরিয়ে নিউমার্কেট থেকে ওই সামান্য জিনিস ক’টা আর ফুলও তুমি অনায়াসেই আনতে পার মা, ওর জন্যে আর আমাকে ভার দিয়ে খেলো হবে কেন? তাছাড়া আমি আজ বাড়ী থাকছি না–বলিয়া অমিতাভ ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া যায়।