মণীন্দ্র অবাক হইয়া বলেন–কেন বলো তো, ওর চাবি নিয়ে কি করবে তুমি? চাল-ডাল লুকিয়ে রেখে যাবে নাকি? যা গিন্নী হয়ে উঠেছ দেখছি!
তাপসী হাসিয়া বাপের পিঠে মুখ খুঁজিয়া বলে–তাই বই কি? বাঃ! শাড়ী নেব!
–শাড়ী!
–হ্যাঁ বাবা। ওর মধ্যে মা’র ছেলেবেলার অনেক সুন্দর সুন্দর শাড়ী আছে। লাল, সবুজ, কত কি!
–থাকতে পারে, কিন্তু তুমি নিয়ে কি করবে? কাউকে দিতে চাও?
–ইস কাউকে দেব কেন? আমি পরবো।
–তুই শাড়ী পরবি? বিস্ময়ে হতবাক মণীন্দ্র শুধু ওইটুকুই বলিতে পারেন।
–পরলে কি হয়? বা রে! দেশে তো আমার বয়সের মেয়েরা শাড়ী পরে। পরে না? নানি বলেছেন–এত বড় মেয়ে শাড়ী পরলেই মানায়।
বারো বছরের মেয়ের মুখে এ হেন পাকা কথা শুনিয়া মণীন্দ্রর ভারী বিরক্তি লাগে, গম্ভীর স্বরে বলেন–তাপসী!
তাপসী ভয় পাইয়া চুপ করিয়া থাকে।
–শোনো, ওসব পাকামি ছেড়ে দাও, খবরদার যেন এ রকম কথা শুনতে না পাই। জানো, তোমাদের মা তোমাদের ওপর রাগ করে চলে গেছেন, আর তোমরা এমন সব কাজ করতে চাও যা তিনি মোটে পছন্দ করেন না!
ব্যস্, আর কিছু বলিতে হয় না। বড় বড় দুই চোখের কোল বাহিয়া যে জলের ফোঁটাগুলি ঝরিতে থাকে সেগুলি নেহাৎ ছোট নয়। চিরদিনের অভিমানী মেয়ে। চিত্রলেখা এইজন্যই আরও মেয়েকে দেখিতে পারে না। একটিমাত্র মেয়ে হইলেও নয়।
মেয়ে কোথায় চালাক-চতুর, স্মার্ট হইবে, শিশুর মত ছুটাছুটি করিবে, খেলা করিতে আসিয়া মা-বাপের গলা ধরিয়া ঝুলিয়া আদর কাড়াইবেনকল স্বরে কথা কহিবে–তা নয়, কেমন যেন জবুথবু সেকেলে সেকেলে ভাব। শিক্ষা দিতে যাও, কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিবে।
এবার অপ্রস্তুত হইবার পালা মণীর। চোখের জল বরদাস্ত করা তাঁর কর্ম নয়। চিত্রলেখার অঞ্চলপ্রান্তে নিজেকে নিঃস্বত্ব হইয়া সঁপিয়া দিবার মূল কারণও হয়তো ওই।
গম্ভীর ভাবটা পাল্টাইয়া তাড়াতাড়ি হাল্কা সুরে বলেন–এই দেখ, একদম নেহাৎ বোকা! নে বাপু যত পারিস শাড়ী নে, দুটো-চারটে একসঙ্গে পরে জগদম্বা ঠাকরুণ হয়ে বসে থাকগে যা। কিন্তু চাবি-টাবি আমি চিনি না তো!
হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছিতে মুছিতে তাপসী ভাঙা গলায় বলে–ছোট আলমারির ড্রয়ারে অনেক চাবি আছে।
–থাকে তো বার করে নাও গে, কিন্তু সাবধান, তোমার মার কাছে যেন কোনদিন এই সব শাড়ী-ফাড়ীর কথা ফাস করে বলে ফেলো না, বুঝলে? সাংঘাতিক চটে যাবেন।
তাপসী ততক্ষণে ছুটিয়াছে। কি জানি–বাবা আবার মত বদলাইয়া বসিলে?
কিন্তু দিশাহারা তাপসী কোন্টা ফেলিয়া কোষ্টা রাখিবে? শাড়ীর স্তূপের মাঝখানে বসিয়া খেই পায় না বেচারা। বর্ণ-সমারোহে চোখ যে ধাঁধিয়া যায়, এর কাছে ফ্রক, ছি!
এমন প্রাণ ভরিয়া দেখিবার সুযোগও তো কখনো মেলে নাই। কালেকস্মিনে চাকর-বাকরে রোদে দিয়া ঝাড়িয়া তুলিয়া রাখে, হাত দিতে গেলে মা’র কাছে বকুনি খাইতে হয়। …এত শাড়ী চিত্রলেখা পরিল কখন?… কে জানে, হয়তো সবগুলো পরাও হয় নাই, হয়তো কোনখানা একবার মাত্র অঙ্গে উঠিয়াছে। সঞ্চয়ের নেশায় শুধু যথেচ্ছ জমা করিয়াছে বসিয়া বসিয়া।
.
ছেলে-বৌ আসিল না বলিয়া সাময়িক দুঃখপ্রকাশ করিলেও একপক্ষে হেমপ্রভা যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। আসিতে আমন্ত্রণ করিলেও ‘মেমসাহেবের’ ভয়ে চিন্তারও অন্ত ছিল না, তাছাড়া নাতি-নাতনীদের এমন একাধিপত্যে পাওয়ার সুবিধাও তো হয় না কখনো।
আরো একটা কারণ হয়তো লুকানো আছে মনের মধ্যে। কলিকাতার বাড়িতে-হেমপ্রভার যেন পায়ের তলায় মাটি নাই, চিত্রলেখার সংসারে তিনি প্রায় অবাঞ্ছিত আশ্রিতের মত। অবশ্য সব দোষই চিত্রলেখার বলা চলে না, হেমপ্রভার শান্তিপ্রিয় ভীরু স্বভাবেরও দোষ আছে কতকটা। নিজের অর্থ-সামর্থ্যের জোরে রীতিমত দাপটের সঙ্গেই থাকিতে পারিতেন তিনি। পারেন না। ছেলেকে বঞ্চিত করিয়া স্বামী যে তাহাকেই সর্বেসর্বা করিয়া গিয়াছেন, এর জন্য ভিতরে ভিতরে যেন একটি অপরাধ-বোধের পীড়া আছে। হয়তো এতদিনে মণীন্দ্রর নামে দানপত্র লিখিয়া দিতেনও, যদি না চিত্রলেখার স্বভাবের পরিচয় পাইতেন।
যাই হোক কলকাতার বাড়িতে হেমপ্রভা অবান্তর গৌণ। কিন্তু এখানে হেমপ্রভার পায়ের নীচে শক্ত মাটি। শুধু পায়ের নীচে নয়, আশেপাশে অজস্র। এখানে হেমপ্রভাই সর্বেশ্বরী, শিশু হোক তবু ওদের কাছেও দেখাইয়া সুখ আছে- আত্মতৃপ্তি আছে।
ভারি খুশি হইয়াছেন হেমপ্রভা। নাতি-নাতনীদের কাছে নিজের ঐশ্বর্য দেখাইয়া যেমন একটা তৃপ্তি আছে–তেমনি দেশের লোকের কাছে এমন চাঁদের মত নাতি-নাতনীদের দেখাইতে পাওয়াও কম সুখের নয়। এবেলা-ওবেলা ভালো ভালো জামা-কাপড় পরাইয়া বেড়াইতে পাঠান তাহাদের যেখানে নিজের যাওয়া চলে সঙ্গে যান। তাপসী যে বুদ্ধি করিয়া মায়ের রঙিন শাড়ীগুলো আনিয়াছে, এর জন্যও আনন্দের অবধি নাই হেমপ্রভার। শাড়ী না পরিলে মেয়ে মানায়?
এটি তাপসীও বুঝিতে শিখিয়াছে আজকাল। তাই সকালবেলাই চওড়া জরিপাড়ের লাল টুকটুকে একখানা জর্জেট সিল্কের শাড়ী পরিয়া ভাড়ারঘরের দরজায় আসিয়া হাজির।
-নানি, নানি গো, আজকে সেই যে কোথায় মন্দির দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছিলে, যাবে?
-ওমা সে তো সন্ধ্যাবেলা, আরতি দেখতে—
বলিয়া মুখ তুলিয়া যেন অবাক হইয়া যান হেমপ্রভা।