মনকে সে ঠিক করিয়াছে। তাই অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বলে–না।
–কিন্তু সে কথা যে আমায় বলতেই হবে, না বলে উপায় নেই। না বলতে পেয়ে–
–কি আশ্চর্য, আপনার দরকার আছে বলেই সকলের দরকার হবে, তার মানে কি? আপনার কথা হয়তো আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়! তেমনি মুখ ফিরাইয়াই কথা বলে তাপসী।
কিরীটী কি প্রতিজ্ঞা করিয়াছে কোন অপমানেই টলিবে না? তা নয়তো এত অবহেলার পরেও এমন ব্যগ্রভাবে কথা কয়?”তুমি বুঝতে পারছ না তাপসী, শোনবার প্রয়োজন হয়তো তোমারও আছে। আরো আগেই বলা উচিত ছিল আমার, শুধু গুছিয়ে বলতে পারার ক্ষমতার অভাবেই পারিনিসাহস করিনি। কিন্তু এভাবে আর পারছি না আমি।
আর তাপসীই যেন পারিতেছে! প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে করিতে কত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে বেচারা, কে তাহার হিসাব রাখিতেছে? কে সন্ধান লইতেছে সে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হৃদয়ের?
কিরীটীকে দেখিবার আগে কী স্নিগ্ধ শান্তি ছিল জীবনে! সুখ না থাক–একটা ছায়াচ্ছন্ন শান্তি, নিশ্চিন্ত বিষাদ! অকালবৈধব্যের মত ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটা সকরুণ নির্লিপ্ততা! তখন এমন রারি ঘুম হরণ করিয়া নিঃশব্দ প্রেতের মত অতীত আসিয়া বর্তমানের উপর ছায়া ফেলিত না, ছদ্মবেশী শয়তানের মত ভবিষ্যৎ আসিয়া লোভ দেখাইত না!
কিরীটীকে দেখিবামাত্র মনের সেই স্থির প্রশান্তি এমন বিপর্যস্ত হইয়া গেল কেন? এই চব্বিশ বৎসর বয়সের মধ্যে কখনো কি কোন পুরুষকেই চোখে দেখে নাই তাপসী? চিত্রলেখারও তো এইটিই নূতন প্রচেষ্টা নয়। মেয়ের জন্য পাত্রের আমদানি তো অনেকদিন হইতেই করিতেছেন। তাছাড়া বাইরের জগতে ঘুরিয়া বেড়াইতে গেলে কত মানুষের সংস্পর্শে আসিতে হয়। তবু
ব্যর্থ যৌবনের কত বসন্তই তো অনায়াসে পার হইয়া গেল। আর কিরীটীর কণ্ঠস্বর শুনিলেই কেন শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় আসিয়া জমা হয়? মুখ দেখিলে কেন সমস্ত ভুল হইয়া যায়?
বন্ধুর বেশে এ পরম শত্রু!
কিরীটীর আবার না পারিবার আছে কি? নিজের সঙ্গে এমন যুদ্ধ করিতে হয় তাহাকে? বড় জোর আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব, তার বেশী নয়। নিজের হাতে নিজের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিবার যে যন্ত্রণা, সে যন্ত্রণার ধারণা কি কিরীটীর আছে?
হঠাৎ কেমন রুক্ষ শোনায় তাপসীর গলার স্বর। আমি পারছি না আর! দয়া করে রেহাই দিন আমায়!
–দয়া? রেহাই? আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না তাপসী!
–বুঝতেও হবে না কষ্ট করে! এইটুকু জেনে রাখুন আপনার সংস্রব আমার অসহ্য!
না, কিরীটীও আহত হয় তবে! ছাইয়ের মত সাদা দেখায় কেন তাহার মুখটা?
–জানলাম। এদিকটা সত্যিই ভেবে দেখিনি কোনদিন। নিছক ভদ্রতা রক্ষার দায়ে তরে কি দুর্ভোগই ভুগতে হয়েছে তোমাকে, আর তারই সুযোগে এতদিন অনর্থক বিরক্ত করে এসেছি আমি! যাক নির্বোধ লোক তো থাকবেই পৃথিবীতে, কি বলো? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে–যা বলবার ছিল সেটা বলে ফেলিনি! বললে হয়তো শুধু নির্বোধই বলতে না, পাগল বলতে!-আচ্ছা চলি।
সত্যই চলিয়া গেল।
তাপসীর মুখের কথাটাই সত্য বলিয়া জানিয়া গেল তবে? কিন্তু এ কি শুধু কথা? তীক্ষ্ণ তীর নয় কি? তীক্ষ্ণ আর বিষাক্ত?
.
আহারের টেবিলে গত সন্ধ্যার কথাটা পাড়িল সিদ্ধার্থ। দিদির ‘ঢং’ লইয়া দিদিকে দুই ভায়ে খানিকটা বাক্যযন্ত্রণা দেওয়ার শুভবুদ্ধির বশেই বোধ করি কথাটা পাড়িয়াছিল বেচারা, কিন্তু অমিতাভ ঘটনাটা শোনামাত্রই জ্বলিয়া উঠিয়া বলে–চলে এসে এমন কিছু বাহাদুরি হয়নি, উচিত ছিল না যাওয়া। কিন্তু সক্কালবেলাই আবার কি করতে এসেছিল ওটা? মান-অপমানের লেশ নেই?
সিদ্ধার্থ অবাক হইয়া বলে–ও কিরে দাদা, ভদ্রলোকের সম্বন্ধে হঠাৎ এরকম বেপরোয়া কথাবার্তা বলছিস যে?
–আরে যা যা, রেখে দে তোদের ভদ্রলোক! ভদ্রলোক হলে ভেতরে একটু আত্মসম্মান জ্ঞান থাকত!
সিদ্ধার্থ বরাবরই কিছুটা কিরীটীর দিকে ঘেঁষা, তাই তর্কের সুরে বলে–নেই তারই বা কি প্রমাণ পেলি হঠাৎ?
–চোখ থাকলেই দেখতে পেতিস। নেহাৎ মার আদরের অতিথি বলেই চুপচাপ থাকি, নইলে একদিন আচ্ছা করে এমন শুনিয়ে দিতাম যে ভদ্রলোককে আর এ বাড়ীর গেট পার হতে হত না!
সিদ্ধার্থর অবশ্য কিরীটীর উপর দাদার অকারণ এই তিক্তভাবের খবরটা কিছু কিছু জানা ছিল, কিন্তু এমন প্রকাশ্যে যুদ্ধ-ঘোষণায় সত্যই অবাক হইয়া যায় এবং অমিতাভর মন্তব্যটা দিদির মুখচ্ছবির উপর কতটা প্রভাব বিস্তার করিল, আড়নয়নে একবার দেখিয়া লইয়া বলে কি ব্যাপার বল্ তো দাদা? মিস্টার মুখার্জি তোর কাছে টাকা ধার করে শোধ দিতে ভুলে যাননি তো?
–যা যা, বাজে-মার্কা ইয়ার্কি করতে হবে না। আমি জানতে চাই, ও যখন-তখন এ বাড়িতে আসে কি করতে? কি দরকার ওর?
তাপসী এতক্ষণ নিরপেক্ষভাবেই মাছের কাটা বাছিতেছিল, এখন অমিতাভর কথা শেষ হইতেই সহসা আরক্তমুখে বলিয়া ওঠে–বাড়িটা আশা করি তোমার একলার নয়!
চশমার কোণ হইতে অবহেলাভরে একবার দিদির দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া অমিতাভ উত্তর দেয়–আজ্ঞে জানা আছে সে কথা, এবং সেই জন্যেই বেশী কিছু বলি না।
–ভদ্রলোক ভদ্রলোকের বাড়ীতে আসবে এতে বলবারই বা কি আছে রে বাপু তাও তো বুঝি না!
সালিশীর সুরে সিদ্ধার্থ আপন মতামত ব্যক্ত করে। কিন্তু অমিতাভ নিবৃত্ত হয় না, আরো তীক্ষ্ণস্বরে বলে–ভদ্রলোক যদি শুধু ভদ্রভাবে লোকের বাড়ী বেড়াতে আসে কিছুই বলার থাকে না, কিন্তু একটা মতলব নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে ঘৃণা করবই। শুধু তাকে নয়–যারা তাকে প্রশ্রয় দেয় তাদেরও।