প্রোপোজ!
তাপসী হঠাৎ হাসিয়া ফেলে–ঠিক আন্দাজ করেছ দেখছি।
চিত্রলেখা ঈষৎ সন্দিগ্ধভাবে বলে–সত্যি বলছিস তো? কিভাবে মানে ঠিক কি বললে বল দিকি?
–বাবলুকে জিজ্ঞেস করো না, ছিলই তো কাছে!
যেন বাবলুকে সাক্ষী রাখিয়া মনের কথা ব্যক্ত করিয়াছে কিরীটী! শোনো কথা!
–বাবলু তো এই এল, তার মুখেই শুনলাম যে তুমি আগে চলে এসেছ। ডিরেক্ট বাড়ীই চলে এসেছিলে, না ময়দানের দিকে একটু ঘুরে-টুরে
চিত্রলেখার কথার ছাঁদে যেন কেমন একটা স্কুল লোলুপতা–যেন কথার পাচে ফেলিয়া মেয়ের কাছ হইতে কী একটা গোপন তথ্য জানিয়া লইতে চায়।
–পাগলামি কোরো না বেশী! বিছানা হইতে নামিয়া পড়িয়া টেবিলের ধারে আসিয়া একটা বই টানিয়া লইয়া বসে তাপসী।
–হোপলেস! বিরক্ত হইয়া প্রস্থান করে চিত্রলেখা। হায়! চিত্রলেখার মত নির্লজ্জ কি আর কেউ আছে জগতে? এখনও সে মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবিতে যায়, ভালো করিতে চেষ্টা করে? বাবলুকে প্রশ্ন করিবার রুচিও থাকে না, যা খুশি করুক সব।
মা চলিয়া যাইতেই ঘরের আলো নিভাইয়া দিয়া আবার শুইয়া পড়ে তাপসী। মাথা ধরাটা মিথ্যাই বা বলা চলে কি করিয়া? মাথার মধ্যে যেন ছিঁড়িয়া পড়িতেছে।-সত্যিই বটে, কতদিন আর এভাবে চালানো যাইবে? নিজের মনের চেহারা স্পষ্ট করিয়া দেখিতে ভয় করে আজকাল। এই দুরন্ত আকর্ষণকে কতদিন আর ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে তাপসী? কোন মন্ত্রের জোরে? কোন্ দেবতার দোহাই দিয়া? সেই প্রচণ্ড আকর্ষণের সংস্রব ত্যাগ করিবার প্রবল সংকল্প প্রতিদিনই কত সহজে ভাঙিয়া পড়ে–অথচ–না না, কিছুতেই না, সে অসম্ভব! সম্পূর্ণ অসম্ভব!
চিত্রলেখার সহজ হিসাবের সঙ্গে তাপসীর হিসাব মেলানো সম্ভব নয়।
৩. ভাবা গিয়াছিল কিরীটী
ভাবা গিয়াছিল কিরীটী আর সহজে আসিবে না। যতই হোক মান-মর্যাদা বলিয়া একটা জিনিস তো আছে মানুষের! কিন্তু দু’জনের ধারণা উল্টাইয়া দিয়া পরদিনই নিতান্ত নির্লজ্জের মত আসিয়া হাজির হইল লোকটা। কি না, তাপসীর খোঁজ লইতে আসিয়াছে। তাপসীর মাথা ব্যথার চিন্তায় বোধকরি সারারাত ঘুমই হয় নাই তাহার। দৈবক্রমে আসামাত্রই তাপসীর দেখা পাওয়ায় প্রসন্ন হাসির আলোয় যেন ঝকমক করিয়া ওঠে কিরীটী, শরতের সোনালী সকালের সঙ্গে ওর মুখের হাসিটা ভারি মানানসই।–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!
পিঠের আঁচলটা টানিয়া হাতের উপর জড়াইয়া লইতে লইতে তাপসীও হাসিমুখে বলে– হঠাৎ ঈশ্বরের উপর এত অনুগ্রহ?
–তার অশেষ করুণার জন্যে। আশা করিনি, এসেই এভাবে আপনার দেখা পাওয়া যাবে, মানে ইয়ে–এমন সুস্থভাবে। হঠাৎ প্রকাশিত আবেগের ভাষাটাকে মোড় ঘুরাইয়া একটু সরল করিয়া লয় কিরীটী। যেন ধন্যবাদটা যদি ঈশ্বরের পাওনাই হয় তো সে কেবল তাপসীকে শারীরিক সুস্থ রাখার দরুন।
তাপসী মনে মনে হাসিয়া লইয়া বলে–তবে কি আশা করেছিলেন, মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছি, ডাক্তার-বদ্যিতে বাড়ী ভরে গেছে, যায় যায় অবস্থা!
–আঃ, কি যে বলেন! আপনাকে এক এক সময় ভারি বকতে ইচ্ছে করে সত্যি!
তাপসী হাসিয়া ফেলিয়া বলে–বকুন!
–বকব? নাঃ, এরকম ‘আপনি আজ্ঞে’ করে বকে সুখ হয় না।
–তবে নয় ‘তুই-তোকারি’ই করুন।
–হঠাৎ একেবারে ডবল প্রমোশন? অতটা কি পেরে উঠব? মাঝামাঝি একটা রফা করতে আপত্তি কি?
আপত্তি? আপত্তি আবার কোথায়? দূরত্বের সকল ব্যবধান ঘুচাইয়া সমস্ত হৃদয় যে ঝাপাইয়া পড়িতে চায় ওই উন্মুখ হৃদয়ের দরজায়। কিন্তু না না, তুমি’ সম্বোধনের নিকট-আবেষ্টনের মধ্যে তাপসী আপনাকে রক্ষা করিবে কিসের জোরে? আগুন লইয়া এই ভয়াবহ খেলায় হার মানিতে হয় যদি? কিরীটীকে দেখিলে নিজেকে বাঁধিয়া রাখা যে কত কঠিন সে কথা তো নিজের কাছে আর অজানা নাই আজ। গতরাত্রের কত প্রতিজ্ঞা কত সংকল্প কোথায় ভাসিয়া গেল এই খুশীতে ঝলমল মুখোনি দেখার সঙ্গে সঙ্গে। তবে? বরং কঠিন ব্যবহারের নিষ্ঠুর আঘাতে দূরে সরাইয়া রাখা সম্ভব, কিন্তু সম্প্রীতির সরসতার মধ্যে নয়।
হায় ঈশ্বর! তাপসী করিবে কি? অতীতের দুঃস্বপ্ন ভুলিয়া, কাল্পনিক অপরাধের বিভীষিকা ভুলিয়া শরতের এই নরম সোনালী আলোর মত নিজেকে সমর্পণ করিয়া দিবে? ন্যায়-অন্যায়ের বিচারই যদি করিতে হয়–এই আগ্রহে উন্মুখ হৃদয়টিকে ফিরাইয়া দেওয়াই কি ন্যায়? ওই হাস্যোজ্জ্বল মুখোনি স্নান করিয়া দেওয়াই কি সুবিচার? নিজের হৃদয় শতধা হোক, হয়তো সহ্য করা যায়, কিন্তু কিরীটী? কিরীটীকে ফিরাইয়া দিবার জোর যে আজ আর কোথাও খুঁজিয়া পাইতেছে না তাপসী! দূর অতীতের একখানি বিস্মৃত মুখ স্মরণ করিবার প্রাণপণ ব্যর্থ চেষ্টায় নয়, নয় নীতিধর্মের খুঁটি আঁকড়াইয়া থাকিবার প্রাণান্ত চেষ্টায়।
সকালের খোলা আলোয় মুখের লেখা পাঠ করা শক্ত নয়। ‘তুমি’ বলিতে চাওয়ার আবদারে তাপসীর মুখের আলোছায়ার খেলা কিরীটীর চোখে ধরা পড়ে সহজেই। তবু কি ভাবিয়া তুমিই বলে সে! ম্লান গম্ভীর মুখে বলে–আপত্তি আছে বুঝলাম, তবু মানলাম না তোমার আপত্তি! একটা কথা তোমাকে আমার জানাবার আছে তাপসী, শোনবার সময় হবে আজ?
কথা যে কি, সে কথা কি বুঝতে বাকি আছে তাপসীর? চিত্রলেখার বড় আকাঙ্ক্ষার সেই কথা! কিন্তু তাপসীর? তাপসীর সে কথা শুনিবার সময় কোথায়? আজ নয়, কাল নয়, কোনোদিনই নয়।