–কেন? তাপসী অল্প একটু হাসে–অসময়ে এ রকম মাথা ধরলে ও ভারি চটে যায়।
–কেন, ওর তো এ রকম মাথাধরা দেখা অভ্যাস আছে!
–তাহলে দেখা যাদের অভ্যাস নেই, তাদেরই চটা উচিত, এই আপনার অভিমত?
–আমার কোন মতামত নেই। অসুখের ওপর তো হাত চলে না।
–আপনি খুব উদার! তীক্ষ্ণ শোনায় তাপসীর কণ্ঠস্বর–আর ধরুন যদি অসুখটা ইচ্ছাকৃত হয়? তাহলেও রাগ হবে না আপনার?
–তাতেও না। কিরীটীর স্বরে আকস্মিক বিস্ময়ের আভাস নাই, যেন জানা কথা, এইভাবেই। বলে–সেটা তো হবে আরও হাতের বাইরের ব্যাপার।
–ওঃ, কিছুতেই তাহলে যায় আসে না আপনার?
–এসব কথা এত তাড়াতাড়ি বলা শক্ত।
–থাক বলতে হবে না। উঃ, বাড়ী গিয়ে শুতে পেলে বাঁচি!
এবারও কিরীটী নিরুত্তর। উত্তর দেয় বাড়ীর দরজায় নামাইয়া দিয়া–আপনার কষ্টের কারণ হলাম বলে দুঃখিত। কি আর করা যাবে–পৃথিবীতে নির্বোধ লোক তো কিছু কিছু থাকবেই। যাক, শুয়ে পড়ুনগে তাড়াতাড়ি।
–মা শুতে দিলে তো!
তাপসীর চোখে যেন কৌতুকের আভাস, কিছু আগে যে রীতিমত বিরক্তি প্রকাশ করিয়াছে বোঝা যায় না।
–মা শুতে দেবেন না! তার মানে?
–তার মানে, অসময়ে বাইরে থেকে এসে শুয়েছি দেখলে ডাক্তার না ডেকে ছাড়বেন না।
–তা ডাক্তার আপনার জন্যে ডাকাই উচিত।
–কেন? ব্রেনের চিকিৎসা করাতে?
–ধরুন তাই। সত্যি আপনি কেন যে এমন খাপছাড়া তাই ভাবি। বেশ থাকেন, হঠাৎ কি যে হয়!
–একেবারে সাধারণ হওয়াই কি ভালো?
–আমার তো তাই ভালো মনে হয়। আশপাশের লোকেরা একটু নির্ভয়ে পথ চলে।
–ভয় করবারই বা দরকার কি?
–কি জানি, হয়তো বোকামি!
–নিজেকে বোকা ভাবতেও বোধ হয় খুব ভালো লাগে আপনার?
–লাগে না? তবে বোকামি ধরা পড়লে স্বীকার করতে বাধে না। আচ্ছা চলি।
–যাচ্ছেন? ওঃ, নমস্কার। অবশ্য ফিরে যেতে যেতে ছবিটা ফুরিয়ে যাবে।
–ছবির জন্যেই মরে যাচ্ছি, এই আপনার মনে হয়?
–বাঃ, মনে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এত তাড়াতাড়ি পালাবার আর কি কারণ থাকতে পারে তবে?
–বেশ। করব না তাড়াতাড়ি, ছোট সাহেবকে ফিরিয়ে আনার টাইমে গেলেই হল।
হাতের ঘড়িটা একবার হাত উল্টাইয়া দেখিয়া লয় কিরীটী।
‘ছোট সাহেব’ অর্থে সিদ্ধার্থ।
–বাবলু রাস্তা হারিয়ে ফেলবে না নিশ্চয়!
–রাস্তা হারিয়ে কেউ ফেলে না, তবু ভদ্রতা বলে একটা জিনিস আছে তো?
–আছে বৈকি। আপনার কাছে তো আবার শুধু ওই একটা জিনিসই আছে। বিদ্রুপে তীক্ষ্ণ স্বর।
কিরীটী স্পষ্ট সোজাসুজি একবার চাহিয়া দেখে তাপসীর চোখের দিকে। কি চায় তাপসী? কোন উত্তর? কোন প্রশ্ন? কেন ওর স্বভাবে এমন অসঙ্গতি? এক মিনিট চুপ থাকিয়া বলে–এর উত্তর আছে আমার কাছে, কিন্তু আজ হয় না।
–কেন, ক্ষতি কি?
কিরীটী আবার কিছু বলিতে গিয়া থামিয়া যায়–অমিতাভও বেড়াইয়া ফিরিতেছে। বাঁকাচোখে দুইজনের দিকে একবার চাহিয়া টকটক করিয়া গাড়ীবারান্দার সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া যায়–কথা বলে না।
কিরীটীকে সে দেখিতে পারে না এটা অবশ্য এতদিনে ধরা পড়িয়াছে, কিন্তু এমন স্পষ্ট অবহেলা বড় একটা করে না।
–আচ্ছা ধন্যবাদ, চলি।
তাপসী নিজেও তো সর্বদা ভদ্রতার বিধি মানিয়া চলে না, তবু কি ভাইয়ের ব্যবহারে কুণ্ঠিত হইয়াছে? তা নয়তো অমন দুর্বল আর ফ্যাকাসে শোনায় কেন তার গলা?
–উত্তরটা কিন্তু শোনা হলো না আমার!
–না-হয় না হলে, ক্ষতি কি? সারা দুনিয়াটাই তো প্রশ্নে মুখর, উত্তর কোথায়?–নমস্কার। এবার সত্যই চলিয়া যায়।
.
–কি রে কি হলো? চলে এলি যে? মাথা ধরেছে নাকি? অন্ধকার ঘরে টুক করিয়া এতটুকু একটু শব্দ, পরক্ষণেই আলোর বন্যায় ভাসিয়া গেল সব। চিত্রলেখার উৎকণ্ঠিত প্রশ্নের বাকিটা যেন মেয়ের বিছানার কাছে আসিয়া আছাড় খাইল–কখন ফিরেছিস? মাথা ধরল কেন?
–মাথা ধরার আবার কেন কি? এমন কিছু তো নতুন নয় ব্যাপারটা! তাপসী উঠিয়া বসে।
–নয় তা তো বুঝলাম। কিন্তু আজ হঠাৎ সিনেমা দেখতে গিয়ে–চিত্রলেখা মেয়ের কাছে বেশ একটু ঘনিষ্ঠ হইয়া বসে–থাক না, উঠছিস কেন? বলছি–হঠাৎ এভাবে মাথা ধরা ইয়ে–কিরীটী কিছু বললে-টললে নাকি? এত মৃদু কণ্ঠস্বর চিত্রলেখার, যেন ফিসফিস করার মত শোনায়।
–বলবে আবার কি? আর মাথা ধরার সঙ্গেই বা সম্পর্ক কি তার? বিরক্তি গোপন না করিয়াই উত্তর দেয় তাপসী।
–না, মানে–তাই বলছি। ইয়ে–একটা কিছু না হলে–
–তুমি কি বলতে চাও, বলো তো স্পষ্ট করে! তীব্রস্বরে প্রশ্ন করে তাপসী।
মেয়ের স্বরের তীব্রতায় চিত্রলেখার যেন আত্মমর্যাদা ফিরিয়া আসে। স্বরের তীব্রতায় মেয়েকে কি আর হার মানাইতে পারে না সে? খুবই পারে, নেহাৎ মেয়ের উপর সহৃদয়তা দেখাইতে আসিয়াছে বলিয়াই না! কি জানি, কিরীটীর কোন ব্যবহারে মর্মাহত হইয়াই বিছানা লইয়াছে কিনা বেচারা! অবশ্য কিরীটী তেমন ছেলে নয়, কিন্তু মানুষের ধৈর্যেরও তো সীমা আছে একটা। নিজের মেয়ের মেজাজটিও তো জানিতে বাকি নাই তাহার। আর কিছু নয়–ওই যে সিঁথি-টিতি পরিয়া একটা কিম্ভুতকিমাকার বেশে সিনেমায় যাওয়া, সেই সম্বন্ধে নিশ্চয়ই কোন মন্তব্য প্রকাশ করিয়া থাকিবে। অথবা কি জানি হয়তো বা তাও নয়–বিবাহের প্রস্তাব! কিন্তু যাই হোক, আর নরম হইবে না চিত্রলেখা, তীব্রস্বরের টেক্কা দিয়া সেও বলে–কি বলতে চাই সেটুকু বোঝবার মত বুদ্ধি অবশ্যই আছে তোমার! এমন কচি খুকী নও! বলতে চাই কিরীটী আজ প্রোপোজ করেছে কিনা? নিজের আমলের ভাষাই ব্যবহার করে সে।