চিত্রলেখা মেয়ের গমনপথের পানে যে দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকেন, তাহার সংজ্ঞা পাওয়া ভার। ক্রোধ? ক্ষোভ? ঘৃণা? অবিশ্বাস? না হতাশা?–মেয়েকে বুঝিতে না পারার হতাশা! বারান্দায় গিয়া উঁকিঝুঁকি মারিবার এনার্জি আর থাকে না চিত্রলেখার। বসিয়া বসিয়া এক সময় শুনিতে পান–মোটর বাহির হইয়া গেল। অমিতাভ যায় নাই, কণ্ঠস্বর পাওয়া যাইতেছে বাড়ীতে।
মিস্টার মুখার্জি বা কিরীটীকে যে অমিতাভ বিশেষ সুচক্ষে দেখে না, তা তাহার এড়াইয়া যাওয়ার ভঙ্গীতেই ধরা পড়ে। নিতান্তই অনুরোধে না পড়িলে কিরীটীর সঙ্গে কোথাও যাইতে চাহে না।
কিন্তু কেন?
.
ভালো লাগে না–ভালো লাগে না কিছুই ভালো লাগে না। ভালো লাগিবার সহস্র উপকরণ চারিদিকে থরে থরে সাজানো থাকা সত্ত্বেও যেন একটা ভালো না লাগা’র” তীক্ষ্ণ কাঁটা অহরহ বিধিয়া থাকে মনের ভিতর। কোনমতেই দূর করা যায় না সেই অদৃশ্য শত্রুকে। চলিতে, ফিরিতে, খাইতে, শুইতে এই কাটা যেন প্রতিনিয়ত স্মরণ করাইয়া দেয়–”তুমি অস্বাভাবিক, তুমি অদ্ভুত, তুমি সৃষ্টিছাড়া! সব কিছুতেই খুশী হইয়া উঠিবার অধিকারী তুমি নও, জন্মলগ্নের ক্রুর পরিহাসে সে যোগ্যতা তুমি হারাইয়াছ!”
খুশী হইতে গিয়াও তাই খুশী হইতে পারে না তাপসী, ঠিক অন্তরঙ্গ হইতে পারে না কাহারও কাছে। পারে না ঠিকমত সহজ হইতে। হাসিতে গিয়া থামিয়া পড়ে, ভালোবাসিতে গিয়া ফিরিয়া আসে। অনেক সময় তাই ব্যবহারটা তাহার সামঞ্জস্যহীন উল্টাপাল্টা, অন্যের কাছে দুর্বোধ্য।
অন্যের কথা দূরে থাক, চিত্রলেখা মা হইয়াও আজ পর্যন্ত চিনিতে পারিলেন না তাহাকে, পারিলেন না খুশী করিতে। বাজার উজাড় করিয়া উপহার সামগ্রী দিয়া নয়, হৃদয় উজাড় করিয়া ভালোবাসা দিয়াও নয়।
তাছাড়া কিরীটীর কথাই ধরো, তাপসীকে এতটুকু খুশী করিতে পাইলে যে বেচারা ধন্য হইয়া যায়, সে কথা তো আর এখন গোপন নাই! চেষ্টারও ত্রুটি রাখে নাই, কিন্তু পারিল কই! তাপসীর পায়ের কাছে প্রাণটা ঢালিয়া দিলে, বড় জোর আনন্দ-প্রকাশের প্রসাদ বিতরণ করিতে পারে তাপসী, খুশী হইতে পারে না।
কিরীটী হয়তো ভাবে নিজের ত্রুটি, কিন্তু তাপসী তো জানে ত্রুটি কার। ভালোবাসা পাইয়া খুশী হইবার, ধন্য করিয়া ধন্য হইবার সৌভাগ্য তাপসীর নয়। শিশু তাপসীকে খুঁটি করিয়া যাহারা ইচ্ছামত খেলা করিয়া গিয়াছে, তাহাদের উপর ক্রোধে ক্ষোভে মাঝে মাঝে যেন হাত পা ছুঁড়িয়া কাঁদিতে ইচ্ছা হয় তাপসীর। কিন্তু ইচ্ছাটা তো আর কার্যে পরিণত করা চলে না, তাই আগাগোড়া ব্যবহারই তাহার সঙ্গতিহীন দুর্বোধ্য। চিত্রলেখার মত যদি খেলাটাকে খেলার মতই ঝাড়িয়া ফেলিয়া সহজ হইতে পারিত তবে হয়তো বাঁচিয়া যাইত। কিন্তু পারিল কই? পারে না। বলিয়া কিরীটীর সঙ্গে পাশাপাশি বসিয়া সিনেমা দেখিতে দেখিতে মাথার যন্ত্রণায় এত বেশী কাতর হইতে হয় তাহাকে যে হল’-এর ভিতর বসিয়া থাকা অসম্ভব হয়।
অমিতাভ অবশ্য আসে নাই, দিদির এলোমেলো ব্যবহার সে বরদাস্ত করিতে পারে না, কিন্তু আজকের ব্যবহারে সিদ্ধার্থও কম চটে না। সেও আর এত ছেলেমানুষ নাই যে দিদির এসব যে। “টং ছাড়া আর কিছু নয়” এটুকু বুঝিতে অক্ষম হইবে? এমন ভাল ছবিখানা দেখিতে দেখিতে মাঝখানে হঠাৎ বাড়ী ফিরিবার বায়না লইলে কেই বা না চটে? তাই মনের রাগ মনে চাপিয়া গম্ভীরভাবে বলে–সে কি মিস্টার মুখার্জি, আপনি কেন যাবেন? বরং আমিই দিদিকে নিয়ে
কিরীটী ব্যস্ত হইয়া উত্তর দেয়–না-না, আরে তুমি বোস না, আমি ওঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আবার এসে জুটছি দেখ না! যাব আর আসব–
‘তা আর নয়’–সিদ্ধার্থ মনে মনে বলে–গিয়ে আবার আপনি এখুন আসবেন! তা হলে আর ভাবনা ছিল না–ড্রইংরুমে ঘণ্টাখানেক, সিঁড়ির সামনে আধঘণ্টা, গেটের ধারে কোন না। মিনিট কুড়ি! ততক্ষণে আর একটা শো শুরু হয়ে যাবে!
যাক, মনে মনে কি না বলে লোকে! ভদ্রতাটা বজায় রাখিতে বলিতে হয়–দেখুন দিকি কী অন্যায়! মাঝখান থেকে আপনারও দেখা হল না। দিদির এই এক রোগ–মাথাধরা! যখন-তখন মাথা ধরলেই হল!
দিদিটি ততক্ষণে ‘গটগট’ করিয়া বাহির হইয়া গিয়াছেন। ব্যবহারে চক্ষুলজ্জার বালাই মাত্র নাই। অসময়ে মাথা ধরাইয়া অপরের ক্ষতির কারণ হইলে যে লোক-দেখানো কুণ্ঠার ভাবও দেখাইতে হয়, এটুকু সভ্যতার রীতিও মানিয়া চলিতে রাজী নয় যেন।
কিরীটী গাড়ীর দরজা খুলিয়া সরিয়া দাঁড়ানো পর্যন্ত একটি কথাও বলে না তাপসী। গাড়ীতে উঠিয়া জুৎ করিয়া বসার পর বলে–আপনি ছবিটা ছেড়ে না এলেও পারতেন, আমি কি আর এটুকু একলা যেতে পারতাম না?
–নিশ্চয়ই পারতেন। কিন্তু আমার একটা কর্তব্য আছে অবশ্যই।
–কর্তব্য? ওঃ!
কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় না, মনে হয় যেন উত্তর খুঁজিতেছে, কিন্তু মিনিট কয়েক পর্যন্ত কিছুই বলে না, জনবহুল পথে সাবধানে গাড়ীটি চালাইয়া যায় মাত্র।
কিছুক্ষণ কাটে–তাপসীই হঠাৎ প্রশ্ন করে–অথবা ঠিক প্রশ্নও নয়–কথা। নীরবতাকে এড়াইবার জন্য অর্থহীন কথা একটা-বাবলু খুব চটে গেল, কি বলেন!
–কেন, চটে যাবে কেন? উত্তরটা দিয়া হয়তো একবার মুখ ফিরাইয়া পার্শ্ববর্তিনীর মুখটা দেখিয়া লয়, কিংবা তার মাথা ডিঙাইয়া রাস্তার ওদিকটা–ঠিক বোঝা যায় না।