–ভাগ্যটা তো আমার নেহাতই দুর্জন মা, নতুন করে আর কি বদলাবে তুমি?
যদিও তাপসী পরিহাসের ছলেই আপন ভাগ্যের নিন্দা করে, তবু মনে হয় ব্যঙ্গের আড়ালে কোথায় যেন রহিয়াছে হতাশার সুর।
চিত্রলেখার মাতৃহৃদয় কাঁপিয়া ওঠে। মুখরা হউক, রুক্ষমেজাজী হউক, তবু মা। এই যে আজ দশ-বারো বৎসর যাবৎ লড়িয়া আসিতেছে চিত্রলেখা-মেয়ের সেই পুতুল খেলার বিয়েটা নাকচ করিয়া ফেলিবার চেষ্টায়, সে কার জন্য? মেয়েটা সুখী হোক, সংসার করুক, জীবনকে উপভোগ করিবার পথ খুঁজিয়া পাক–এই না উদ্দেশ্য?
বিগলিত স্বরে বলে–ভাগ্য কেন খারাপ হবে? কখনই না। মানুষের অবিবেচনার ফলে যে দুর্ভাগ্য, সে দুর্ভাগ্যকে কেন স্বীকার করে নেব আমরা? আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি বেবি, এত লেখাপড়া শিখে তুমি এখনো এত কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছ?
তাপসী হাসিয়া ফেলিয়া বলে, সেটা খুব মিথ্যে নয় মা, তোমার মতন অত সংস্কারমুক্ত হতে পারিনি এখন, ভবিষ্যতে যদি পারি দেখা যাবে।
পূর্বতন সেই ‘বিবাহ’ নামক খেলাটার নাম আর স্পষ্ট করিয়া কেহই উল্লেখ করে না, শুধু কথার যুদ্ধ চলে। চিত্রলেখা মেয়ের বিদ্রুপে জ্বলিয়া উঠিয়া বলে–এই যদি তোমার উচ্চ আদর্শ হয়, তাহলে ও ছেলেটাকে টাঙিয়ে রেখে ফ্লার্ট করবার তো কোন মানে দেখি না!
–মা ছি!
চিত্রলেখা কথাটা বলিয়া ফেলিয়া মনে মনে একটু যে কুণ্ঠিত হয় নাই তা নয়, কিন্তু সেটা প্রকাশ করাও সম্মানজনক নয়, তাই আরো জেদের সঙ্গে বলিয়া বসে নিশ্চয়ই তো, নিজের ব্যবহার নিজে বোঝবার মত বুদ্ধি তোমার হয়নি এটা বলবে না অবশ্যই! কিসের আশায় সে যখন তখন এসে দোরে ধর্না দেয়-রাশ রাশ টাকা খরচা করে? এতদিনে অনায়াসে জবাব দিতে পারতে তুমি–দেওয়া উচিত ছিল।
তাপসী বিরক্তি-গম্ভীরস্বরে বলে–কে কিসের আশায় কি করছে, তার জন্যে আমি দায়ী হতে যাব কি দুঃখে? আর জবাবের কথা যদি বলল, মিছিমিছি গায়ে পড়ে জবাব দিতে যাব কেন? প্রশ্ন যদি আসে, জবাব দিতে দেরি হবে না তা দেখো।
মেয়ের এ হেন কথা শুনিয়া চিত্রলেখা ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিবে এটা কিছু বিচিত্র নয়। দীর্ঘকাল যাবৎ যে আশাতরুর মূলে জলসিঞ্চন করিয়া অসিতেছে–মেয়ে যদি এক কথায় তার মূলে কুঠারাঘাত করিয়া বসে, মনের অবস্থা কেমন হয়?
তাপসীর সঙ্গে মুখোমুখি কোন কথাই কোনদিন হয় নাই এটা ঠিক, তবু চিত্ৰলেখার নিশ্চিত ধারণা ছিল–এতদিনে মেয়েটা নিজেকে কুমারী কন্যা বলিয়াই স্বীকার করিয়া লইয়াছে এবং মনে মনে ভবিষ্যতের রঙিন ছবি আঁকিতেছে, কিন্তু আজকের কথাবার্তাগুলো তো তেমন সুবিধাজনক নয়! শেষ পর্যন্ত এমনি গণ্ডমূর্খ হইল মেয়েটা? এত বড় জীবনটা কাটাইবার একটা অবলম্বনও কি প্রয়োজন হইবে না? বিধবা তবু স্বামীর স্মৃতি বুকে ধরিয়া–আচ্ছা বিধবা-বিয়েও তো হয়! এক যুগ আগেকার সেই ধূমকেতুর মত সর্বনেশে অপয়া ছেলেটা বাঁচিয়া আছে কিনা সন্দেহ। শোনা গিয়াছিল তিন কুলে নাকি কেহ নাই তাহার–তবে? এখনো কি আর টিকিয়া থাকা সম্ভব? টাকাকড়িগুলা পাঁচজনে ভুলাইয়া লইয়াছে, ছেলেটা হয়তো
সব চিন্তাগুলি মনের মধ্যে ভিড় করিয়া উঠিতেই দিশাহারা চিত্রলেখা ক্রুদ্ধ আর তীব্র প্রশ্ন করে–তুমি তাহলে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী হতে চাও, কেমন? তা হবে নাই বা কেন? তোমার নানি তো স্বেচ্ছাচারী হবার রাস্তা খুলেই দিয়ে গিয়েছেন। কারুর মুখাপেক্ষী তো নও! জমিদারির মালিক
নিতান্ত ক্রোধের বশেই এত বড় কটু কথাটা উচ্চারণ করে চিত্রলেখা। বস্তুত হেমপ্রভার দানপত্র অনুসারে তাপসীই সব কিছুর উত্তরাধিকারিণী হইলেও সেটা নিতান্তই অভিনয়ের মত–চিত্রলেখাই সব। তাছাড়া বুদ্ধি-বিবেচনা হইবার পর হইতেই তাপসী ক্রমাগতই এই ব্যাপারটার প্রতিবাদ করিয়া আসিতেছে, কিন্তু প্রতিকার এখনো কিছু হইয়া উঠে নাই। কিন্তু সেই কথা লইয়া যে এমন তীক্ষ্ণ খোঁচা মারিবে চিত্রলেখা, এইটাই ধারণা ছিল না তার।
মর্মাহত তাপসী কি একটা বলিতে যাইতেছিল, সেই সময় সিদ্ধার্থ আসিয়া সংবাদ দিল–মা, দিদি, মিস্টার মুখার্জি এসেছেন!
বেপরোয়া কিশোর তরুণ, তবু বলিবার ভঙ্গী দেখিয়া মনে হয় মিস্টার মুখার্জি সম্বন্ধে মনোভাবটা নেহাতই বিগলিত। দিদি অগ্রাহ্য অবহেলার ভাব দেখাইলে দিদিকে তিরস্কার করিতে ছাড়ে না।
শুধু অমিতাভকেই নিরপেক্ষ মনে হয়।
চিত্রলেখা হতাশভাবে দুই হাত উল্টাইয়া বলে–আর মিস্টার মুখার্জি।
সিদ্ধার্থ বিস্মিতভাবে বলে–কি হলো?
–কিছু নয়, তোমার দিদির সিনেমা যাওয়ার রুচি নেই।
সিদ্ধার্থ মা’র কথার উত্তরে বিরক্তভাবে বলে–বাঃ, মজা মন্দ নয়! দাদা বললে যাব না, দিদি এখন ওই বলছে, আমিই বুঝি বোকার মত যাব শুধু?
তাপসী মৃদু হাসিয়া বলে–কেন, অভীর কি হলো?
–কি আবার হবে, হয়েছে মান! মেয়েদের মত কারুর সঙ্গে যাবেন না বাবু, নিজের কি হাত-পা নেই? হাত-পা যেন আমারই নেই, তবু ভদ্রতা বলে একটা জিনিস আছে কিনা!
–নিশ্চয়ই আছে। তাপসী হাসিয়া ফেলিয়া বলে–ভদ্রতা রাখতে নিশ্চয় যাওয়া দরকার–কি বল সিদ্ধার্থবাবু? তাছাড়া মেয়েদের তো আবার নিজের হাত-পাও নেই, কারুর সঙ্গে যাওয়া ছাড়া উপায় কি? নিতান্ত স্বচ্ছন্দগতিতে সিদ্ধার্থর সঙ্গে নীচে নামিয়া যায় তাপসী। সন্দেহ নাই মিস্টার মুখার্জির উদ্দেশ্যেই।