‘বলিব না’ প্রতিজ্ঞা করিয়াও শেষ অবধি থাকিতে পারে না চিত্রলেখা। মেয়েকে ডাকিয়া প্রশ্ন করে–এটা কি হয়েছে বেবি?
–কোন্টা মা? সরল সুরে প্রতিপ্রশ্ন করে তাপসী।
-এইটা, তোমার এই বিদঘুঁটে সাজটা! আবার তুমি ওই বিশ্রী গয়নাটা কপালের ওপর চড়িয়েছ? সিনেমা যাবার কথা রয়েছে না আজ?
–সিনেমা? কই?
–ন্যাকামি করিসনে বেবি, সকালবেলা ফোন করল না কিরীটী?
–ও হো হো, ভুলেই গেছলাম। যাকগে গেলেই হবে, কিন্তু সিঁথি পরলে ঢুকতে দেবে না, কি বলছ?
–বলছি আমার মাথা আর মুণ্ডু! ওই জঘন্য সাজটা সেজে যেতে লজ্জা করবে না তোর?
–কেন লজ্জা করবে? বাঃ, নানির এই সিঁথিটার দাম এখন কত জানো?
-জানি না, জানতে চাইও না। দামী হলেই সেটা বাহার হয় না সব সময়। তাহলে ওই ‘গিনি’র মালাটাই বা গলায় ঝুলিয়ে বেড়াও না কেন? ওরও তো অনেক দাম!
–ওটা আমার ভালো লাগে না তাই। ওর তো কোনো সৌন্দর্য নেই।
–আর এইটার খুব আছে, কেমন? আচ্ছা যতই সৌন্দর্য থাক, ওটা খুলে ফেল আজ, আর ওই জরির চটি!
–পাগল হয়েছ মা! কি একটু সিনেমা যাব তার জন্যে আবার নতুন করে এত কাণ্ড! যা আছি বেশ আছি।
–আচ্ছা বেবি, তুই কি আমায় পাগল করবি? এ রকম সেকেলেপনা দেখলে কিরীটী কি মনে করবে বল তো?
–পাগল তোমায় নতুন করে করতে হবে না মা, নিজেই তুমি যথেষ্ট পাগল আছ। জগতে এত লোক থাকতে মিস্টার মুখার্জি কি মনে করবেন ভেবে এত দুশ্চিন্তা কেন?
চিত্রলেখা মেয়ের ইচ্ছাকৃত ন্যাকামি আর বরদাস্ত করিতে পারে না, জ্বলিয়া উঠিয়া বলে দুশ্চিন্তা কেন তা তুমি বোঝ না? তুমি কি মনে কর তুমি ভিন্ন আর পাত্রী জুটবে না ওর? নেহাৎ নাকি অতি অমায়িক, অতি ভদ্র ছেলে, তাই এখনো পর্যন্ত তোমার খামখেয়ালীপনা সহ্য করছে! একবার যদি মন ঘুরে যায়–
তাপসী এইবার কিঞ্চিৎ গম্ভীর হইয়া পড়ে। ধীরস্বরে বলে কার কখন মন ঘুরে যাবে সেই ভয়ে কাতর হওয়া আমার পোয় না মা। বাংলাদেশে পাত্রীর অভাব নেই, ওঁর যে একটাও জুটবে না এমন বাজে কথা ভাবতেই বা যাব কেন? কিন্তু আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক কি? শুধু শুধু খানিকটা ভুল ধারণা নিয়ে থেকো না।
ভুল ধারণা! চিত্রলেখা করিবে ভুল ধারণা? মেয়েকে বরং সে বুঝিয়া উঠিতে অক্ষম হইয়া পড়ে মাঝে মাঝে, কিন্তু কিরীটীর বিষয়ে ভুল করিবার কিছু নাই। কাছাকাছি আসিলেই তাহার চোখে মুখে যে আলো জ্বলিয়া ওঠে সে আলো চিনিতে কি ভুল হয়? সাত সমুদ্র তের নদী পার হইয়া কত নীলনয়না রূপসীর, বিদ্যাবতী তরুণীর মোহ এড়াইয়া সে যে চিত্রলেখার মেয়ের হৃদয়দ্বারে প্রার্থী হইয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এটাই কি সোজা বিস্ময়? হউক না তাহার সুন্দর মেয়ে, তবু বিদেশিনীদের রূপগুণ হাস্যলাস্য আকর্ষণী শক্তির কাছে কি? তাহাদের তুলনায় সত্যই কিছু আর চোখে পড়িবার মত নয় তাপসী। তবু কিরীটী যে বেবির প্রেমে পড়িয়াছে একথা চন্দ্র সূর্যের মতই সত্য। চিত্রলেখার ধারণা ভুল নয়।
হঠাৎ একটা কথা মনে হয়–তাপসীর এই যে অবহেলার ভাব, বোধ করি বা অভিমান, হয়তো কিরীটীর প্রেমে আজও সন্দেহ আছে তার, তাই মাঝে মাঝে নিজেকে সরাইয়া লয়। তাই মাকে বলিল, মিথ্যে খানিকটা ভুল ধারণা নিয়ে থেকো না। অর্থাৎ মিথ্যা আশা মনে পোষণ করিও না।
মেয়ের খামখেয়ালী ব্যবহারের খানিকটা হদিস আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়া চিত্রলেখা বেশ খানিকটা ধাতস্থ হয়। প্রসন্ন কণ্ঠে বলে–ভুল ধারণা কিছুই নয় রে বাপু, কিরীটীর মন জানতে আর বাকী নেই আমার, এখন শুধু অপেক্ষায় আছে বোধ হয়–দেখি এদিক থেকে কোনো প্রস্তাব ওঠে কিনা। তা এইবার আমি—
প্রস্তাব তো চিত্রলেখা কবেই করিত, কেবলমাত্র মনমর্জি’ মেয়ের ভয়েই সাহস করে না। যা থাকে কপালে, এইবার একটা হেস্তনেস্ত করিয়া ছাড়িবে সে নির্ঘাত।
তাপসী আরো বেশী গম্ভীরমুখে বলে-দেখ মা, তোমায় বাপু বারণ করে দিচ্ছি, ওসব যা তা করতে যেও না। মানুষ কি পুতুল–যে একটাকে নিয়েই বার বার খেলা যায়?
–কি হল কথাটা? চিত্রলেখা তীক্ষ্ণ সুরে প্রশ্ন করে-তোমার এ কথার অর্থ?
–অর্থ-টর্থ জানিনে মা, শুধু তোমায় বলে রাখছি, আমার ওপর থেকে আশা ছাড়ো। আজ মিস্টার মুখার্জি পছন্দ করবেন না বলে আমি শাড়ী ছেড়ে স্কার্ট ধরব–অথবা কাল মিস্টার লাহিড়ী পছন্দ করছেন না ভেবে চা ছেড়ে কোকো ধরব–এসব আমাকে দিয়ে হবে না।
দুই চোখে অগ্নিবাণ হানিয়া চিত্রলেখা কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর ক্রুদ্ধ স্বরে বলে–তোমার মতলবটা আমাকে খুলে বলবে?
–আমার আবার মতলব কিসের! যেমন আছি তেমনি থাকব–ব্যস!
–ব্যস্? এ কি ছেলেখেলা পেয়েছ নাকি?
–অকারণ রাগ করছ কেন মা? নানির দেওয়া গয়নাগুলো আমার পরতে ভালো লাগে তাই। পরি, তোমার যদি খুব বিরক্তিকর লাগে, আর পরব না। কপাল হইতে সিঁথিটা খুলিয়া ফেলিতে উদ্যত হয় বেবি।
চিত্রলেখা বোধ করি কিছুটা অপ্রতিভ হয়, ঈষৎ নরম গলায় বলে–থাক থাক, ব্যস্ত হবার দরকার নেই, কিন্তু কথা হচ্ছে, কিরীটীর বিষয়ে একটা কিছু স্থির করে ফেলা উচিত নয় কি? সত্যি কিছু আর এভাবে অনিশ্চিতের আশায় দিন কাটিয়ে বসে থাকবার মত সস্তা ছেলে ও নয়, শুধু তোমাকে একটু বিশেষ পছন্দ করে ফেলেছে বলেই এখনো তোমার এসব খামখেয়াল সহ্য করছে। কিন্তু জেনে রেখো সুযোগ বার বার আসে না। অবশ্য ওকেও যদি তোমার পছন্দ না হয় আলাদা কথা, কিন্তু তা না হলে বলব সেটা তোমার পক্ষে রীতিমত দুর্ভাগ্য।