ধীরে ধীরে আবার কিছুটা সহজ হইয়া আসে, আবার সহপাঠীদের আক্রমণের ফাঁদে ধরা দিতে হয়। সভা-সমিতি, শোভাযাত্রা, পিকেটিং, কর্তৃপক্ষের অনুশাসনের প্রতিবাদে ধর্মঘট–ছাত্রজীবনের বহুবিধ উত্তেজনার মধ্যে কাটিতে থাকে দিনগুলি। অতীতের দুঃস্বপ্ন আর তেমন অব্যবস্থিত করিয়া তুলিতে পারে না। ভীতিবিহ্বল কিশোরচিত্তে আসে যৌবনের দৃঢ়তা, অগাধ সমুদ্রের রহস্যময় আহ্বানে সাড়া দিবার সাহস খুঁজিয়া পায়, নূতন নূতন জ্ঞান আহরণের সংকল্পে সেই সমুদ্র পাড়ি দেয় বুলু।
.
অবলম্বনহীন রাজলক্ষ্মী রোষে ক্ষোভে স্বর্গগত মাতুল হইতে শুরু করিয়া বুলুর অবিবাহিতা বধু পর্যন্ত সকলকে গালি দেন, নিত্য দুইবেলা কাশীবাসের সংকল্প ঘোষণা করেন আর বাঘিনীর মত আগলাইয়া থাকেন বুলুর ঘর-বাড়ী বিষয়-সম্পত্তি। সাতসমুদ্র পার হইয়া বুলু যেদিন ঘরে ফিরিবে, সেইদিন তাহাকে সবকিছু বুঝাইয়া পড়াইয়া তবে তাহার ছুটি।
ইত্যবসরে বার-দুই সরকার মহাশয়কে লুকাইয়া মূল্যবান উপহারসহ বুলুর শ্বশুরবাড়ী লোক পাঠাইয়াছিলেন, বলা বাহুল্য ফলাফলটা সুবিধাজনক হয় নাই।
চিত্রলেখা তাহাদের তো উপহার-দ্রব্যসমেত পত্রপাঠ বিদায় করিয়াছে বটেই, কিন্তু না করিলেও যে শেষ পর্যন্ত বিশেষ শোভনীয় ব্যাপার ঘটিত এমন নয়। অসম্ভব কল্পনা হইলেও চিত্রলেখা যদি রাজলক্ষ্মীর স্নেহ-ক্ষুধার তৃপ্তি সাধনাৰ্থে: মেয়েকে পাঠাইতেই রাজী হইত, সালোয়ার-পাঞ্জাবি-পরা সাইকেল-চাপা বৌকে লইয়া রাজলক্ষ্মী তৃপ্ত হইতে পারিতেন কি?
আসল কথা, মিলের যেখানে একান্তই অভাব, সেখানে মিশ খাওয়াইবার চেষ্টাই প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। বিপজ্জনকও বটে। তাই না শূন্যমণ্ডলবাহী লক্ষ লক্ষ গ্রহ কেহ কাহারও নিকটবর্তী হইতে পারে না, সুদূর ব্যবধানে আপন আপন কেন্দ্রে পাক খাইয়া মরে!
চিত্রলেখা আর রাজলক্ষ্মী ভিন্ন গ্রহবাসী, ভুলক্রমে পরস্পরের কাছাকাছি আসিবার চেষ্টা করিতে গেলে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন মধুর পরিণতির সম্ভাবনা কোথায়?
কে জানে সাত সমুদ্র পার হইতে বুলু কোন্ ভিন্নমূর্তি লইয়া ফিরিবে? রাজলক্ষ্মীকে চিনিতে পারিবে তো?
.
ঢিলে পায়জামা আর হাফশার্ট পরা তাপসীকে রাখিয়া দীর্ঘদিনের জন্য বিদায় লইয়াছিলাম, যবনিকা উত্তোলন করিতেই দেখা গেল–আকাশপাতাল পরিবর্তন ঘটিয়াছে তাপসীর। কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তাই যে তাহাকে ভাঙিয়া চুরিয়া নূতন ছাঁদে গড়িয়া রূপের উপর অপরূপত্ব দান করিয়াছেন তাহা নয়, প্রয়োগ-নৈপুণ্যের নিখুঁত কৌশলে সৃষ্টিকর্তার উপরও টেক্কা দিতে শিখিয়াছে সে। বাস্তবিক রূপচর্যাকে যদি শিল্পকলা হিসাবে ধরা যায় তো তাপসীকে ভালো শিল্পী বলা উচিত। সাজসজ্জায় অতিমাত্রায় আধুনিক হওয়াটাই যে সৌন্দর্যের মাপকাঠি এ বিশ্বাস তাহার নাই, তাই ফ্যাশনশাস্ত্র লঙ্ঘন করিয়া নিজেকে ইচ্ছামত ফুটাইয়া তুলিতে কিছুমাত্র দ্বিধা বোধ করে না সে।
মেয়ের সঙ্গে তাই আর কোনকালেই বনিল না চিত্রলেখার।
নিজের তো সব পথ বন্ধ–বৈধব্যের বেশের উপর কতটাই আর পালিশ লাগানো যায়? অতএব মেয়ের উপর দিয়া মনের সাধ মিটানোর ইচ্ছাটা কি খুব বেশী অন্যায় চিত্রলেখার? কিন্তু মেয়ে যেন বুনো ঘোড়া। তা নয়তো দেশী বিলাতী সকল দোকান ঘুরিয়া চিত্রলেখা নিজে যে শাড়ী ব্লাউজ জুতা ম্যাচ করিয়া কিনিয়া আনিয়াছে, মানানসই সেই জুতাটাকে বাতিল করিয়া দিয়া একটা জরির চটি পরিয়া বেড়াইতেছে মেয়ে! তার উপর আবার কপালের উপর পিতামহীর আমলের একটা মুক্তার সিঁথি!
দেখিয়া গলায় দড়ি দিয়া মরিতে ইচ্ছা হয় কিনা!
বাছিয়া বাছিয়া আবার কেমন দিনটিতে এহেন কিম্ভুত সাজ করা! কিনা যেদিন কিরীটীর আসিবার কথা!
কত চেষ্টায় চিত্রলেখা এই ছেলেটিকে যোগাড় করিয়া আনিয়া মেয়ের চোখের সামনে ধরিয়া দিয়াছে–আর মেয়ের মোটে গ্রাহ্যই নাই! অথচ এমন একটি পাত্র গাঁথিয়া তুলিতে পারিলে যে কোনো মেয়ে ধন্য হইয়া যায়!
শুধুই কি বিদ্যায়? বুদ্ধিতে, সৌজন্যে, অর্থে, স্বাস্থ্যে অতুলনীয় বলিলেও অতিরঞ্জন হয় না। তার উপর রূপ–যেটা পুরুষের পক্ষে বাড়তি বলিলেও চলে। সে হিসাবে সৃষ্টিকর্তার একটি বেহিসাবী অপচয়ের নমুনা কিরীটী। এত রূপ, এত গুণ, এত টাকা কিরীটীর, তবু মেয়ের অন্ত পাওয়া ভার। কখনো মনে হয় বেশ সুরাহা-কিরীটীর আসার কথা থাকিলে মেয়ের যে উন্মুখ চাঞ্চল্য সে তো আর চিনিতে ভুল হয় না চিত্রলেখার, কিন্তু পরদিনই আবার সব গোলমাল হইয়া যায়, নিজের হিসাবের উপর আর আস্থা থাকে না। হতাশ চিত্রলেখা হাল ছাড়িয়া দিয়া নিজের মরণ কামনা করিতে বসে।
এই তো সেদিন কিরীটী আসিয়া দাঁড়াইয়াছে মাত্র, আর নাকের উপর দিয়া গটগট করিয়া বাহির হইয়া গেল বেবি! ভদ্রতা রক্ষা হইল কিভাবে–না “এই যে মিস্টার মুখার্জি, ভালো তো? বসুন, মা আছেন।” ব্যস! যেন তোর মার চরণ-দর্শন-পিপাসাতেই এক গ্যালন পেট্রল পুড়াইয়া তোদের দরজায় আসিয়াছেন মিস্টার মুখার্জি! মূর্খ! মূর্খ! তাছাড়া আর কিছুই নয়! যেমন নির্বোধের বংশ! শেষ পর্যন্ত স্বর্গবাসী স্বামী আর কাশীবাসিনী শাশুড়ী ঠাকুরাণীর উপরেই সমস্ত ক্রোধটা গিয়া পড়ে।
আজও যে মেয়ের এই সৃষ্টিছাড়া সাজ, এ আর কিছুই নয়–কিরীটীর উপর অবহেলা দেখানো আর মায়ের সঙ্গে যুদ্ধ-ঘোষণা। ওই যে সকালবেলা ফোন করিয়া জানাইয়া রাখিয়াছে কিরীটী যে সন্ধ্যার ‘শো’র জন্য চারখানা টিকিট কিনিয়া রাখিয়াছে লাইট-হাউসের, তাই আগে হইতেই বিদ্রোহের সাজ! কত বুদ্ধিমান আর অমায়িক ছেলে! বেবিকে একলা লইয়া গেলেই কি আপত্তি করিত চিত্রলেখা? তা তো নয়–তবু সব সময় অমিতাভ, সিদ্ধার্থ সকলকে সঙ্গে নেয়। অথচ বাঙালীর ঘরের কূপমণ্ডুক ছেলেও নয়–ইয়োরোপ আমেরিকা জাপান সর্বত্র ঘুরিয়া আসিয়াছে। শিক্ষা সহবৎ বুদ্ধি বিবেচনায় অনিন্দ্য। হাজারেও একটা অমন ছেলে মেলে না। কিন্তু হতভাগা মেয়ে কিছুরই মর্যাদা দেয় না।