প্রাণকেষ্ট হোস্টেলের চাকর।
পরেশের কথায় সকলেই আর এক দফা হাসিয়া ওঠে।
–প্রফেসর দিগ্বিজয় রায়ের নামটাই বা লিখতে বাধা কি ছিল? ওঁকে যখন অত পছন্দ করি আমরা! বুলু হাসিয়া প্রশ্ন করে।
বলা বাহুল্য উক্ত ভদ্রলোকটি ছাত্রমহলের দু’চক্ষের বিষ।
–ওই দেখ, সুকুমার তীক্ষ্ণস্বরে বলে–নিজের কথাতেই ধরা পড়ে যাচ্ছে ছোঁকরা! দিগ্বিজয়কে আমরা পছন্দ করি না বলেই ঠাট্টা করতে ওর নামটাই মনে পড়ল বুলুর! তার মানে-ঠাট্টাটা বাদ দিলে এই দাঁড়ায়, যাকে পছন্দ করি খাতার পাতায় তার নাম লিখি।
–চমৎকার! তুই আবার বলিস কিনা তুই অঙ্কে কাঁচা! বলিয়া গায়ের শার্টটা খুলিতে খুলিতে নিজের ঘরে চলিয়া যায় বুলু। কিন্তু এ ঘরে আর তাড়াতাড়ি আসে না, চুপচাপ বিছানায় বসিয়া থাকে। কি আশ্চর্য! এত নাম থাকিতে ও নামটাই বা লিখতে গেল কেন সে? নিজের জ্ঞাতসারেই লিখিয়াছিল কি? স্পষ্ট মনে পড়ে না, খেয়ালের মাথায় একবার লিখিয়া ফেলিয়া বার বার সেইটাই চালাইয়া গিয়াছে মাত্র।–ধ্যেৎ! কি মনে করিল ওরা কে জানে? সত্যই কিছু সন্দেহ করিবে না তো? কাগজখানা ছিঁড়িয়া ফেলিলেই ভালো ছিল!
.
কয়েকটা দিন কাটিয়াছে। সেদিনের কথা বুলুর তো মনে নাই বটেই আর কেহ যে মনে রাখিবে এমন সন্দেহ করিবার হেতু নাই। হঠাৎ সুকুমার একদিন কোথা হইতে যে কি পাকা দলিল যোগাড় করিয়া বসিল কে জানে-বুলু দেখিয়া অবাক হয়, তাহার দিকে যে তাকায় সে-ই হাসিতে শুরু করে।
ব্যাপার কি? বুলু কি রাতারাতি চিড়িয়াখানার নূতন আমদানি চীজ বনিয়া গেল নাকি? যত দূর মনে পড়ে সেদিনের মত বোস বোকামি তো আর একবারও করিয়া বসে নাই।
তবে?
সংক্রামক ব্যাধির মত এ হাসি যে ক্রমশই ছড়াইয়া পড়িতেছে।
নাঃ, আজ আর নিজে যাচিয়া ব্যাপার জানিতে যাইবে না বুলু। তাহার যেন আর মানমর্যাদা নাই! মনে মনে হঠাৎ ভারি একটা অভিমান হয়, বিশেষত সুকুমারের উপর। এত ভালোবাসে বুলু সুকুমারকে, অথচ সুকুমারই তাহাকে অপদস্থ করিবার জন্য নিত্য নূতন ফন্দী আবিষ্কার করিয়া বেড়ায়!
স্বভাবদোষে সুকুমার সকলকেই ক্ষেপাইয়া মারে বটে, কিন্তু আজকে বুলুর প্রতি আক্রমণটা যেন বড় প্রবল। কেন? ক্লাসসুদ্ধ ছেলেকে বলিয়া বেড়াইবার মত কি এমন অপকর্ম করিয়া রাখিয়াছে বেচারা?
যাকগে, কারণ জানিবার প্রয়োজন নাই। নিজের ঘরে আসিয়া সকালের পড়া খবরের কাগজখানা মুখের সামনে ধরিয়া মনে মনে রাগে ফুলিতে থাকে বুলু।
কিন্তু বুলুকে আজ আর ওরা স্বস্তিতে থাকিতে দিবে না। মিনিট কয়েক পরেই সদলবলে সুকুমারের আবির্ভাব। একটানে কাগজখানা টানিয়া লইয়া হৈ হৈ করিয়া ওঠে–কি বাবা যুধিষ্ঠির, কি হলো? এত বড় কাণ্ডটা বেমালুম চেপে যাচ্ছিলে? এখন যে হাটে হাঁড়ি ভাঙল তার কি! দুধে দাঁত না ভাঙতেই বিবাহ-পর্বটা সেরে বসে আছ বাবা!
উঃ! ধৈর্যের বাঁধ আর কতক্ষণ থাকে মানুষের? এত বড় আঘাতেও ভাঙিয়া পড়িবে না? ক্ষোভে অপমানে স্বর্গত দাদুর উপর দুরন্ত অভিমানে আপাদমস্তক আলোড়িত হইয়া এক ঝলক জল আসিয়া পড়ে চোখে।
হায়! এটা বাড়ী নয়, কিংবা পিসিমার স্নেহচ্ছায়া নয় যে চোখের জলের মূল্য থাকিবে। ফল ফলিল বিপরীত। একবাক্যে সকলে স্থির করিল বৌয়ের জন্য মন কেমন করিতেছে বুলুর।
বলা বাহুল্য কোথা হইতে সংবাদ সংগ্রহ করিয়া আনিয়া সহপাঠীমহলে রাষ্ট্র করিয়া দিয়াছে সুকুমার-বুলু বিবাহিত।
অতঃপর অনেক প্রশ্ন বর্ষণ হইতে থাকে বুলুর উপর।
বুলুরা সত্যই বাঙালী অথবা খোট্টা? বিবাহ কি তাহার দুগ্ধপোষ্য অবস্থাতেই স্থির হইয়া গিয়াছিল? এ হেন শুভকর্মটি একেবারে সারিয়া লইয়া কলেজে ঢোকার কারণ কি বন্ধুবর্গকে নিমন্ত্রণে ফাঁকি দেওয়া? বৌ দেখিতে কেমন? বন্ধুদের একদিন দেখাইবে কিনা বুলু? এই সব অজস্র প্রশ্ন।
প্রশ্ন এবং পরিহাসের ভঙ্গীতে অবশ্য দুগ্ধপোয্যতা’র আভাস খুঁজিয়া পাওয়া শক্ত হয়। সহপাঠীদের মধ্যে দু-চার বছরের বড় ছেলের তো অভাব নাই।
বুলু কোন উত্তরই দেয় না, আর কাঁদিয়াও ফেলে না। ভারী মুখে চুপচাপ বসিয়া থাকে। বন্ধুদের উপর রাগ করিতেও যেন পথ থাকে না। সত্যই তো সে একটা খাপছাড়া সৃষ্টিছাড়া অভিশপ্ত জীব। জীবনের প্রারম্ভে যে অভিশাপ বর্ষণ করা হইয়াছে তাহার উপর, তাহার ফল ভুগিতে হইবে না? এই সভ্যজগতে সভ্যসমাজে এমন অসভ্য ব্যাপার কি কাহারও জীবনে ঘটে?
বন্ধুদের উপর অভিমানে কিছুদিন আর ভালোভাবে মেলামেশা করে না বুলু, আপনমনে নিজের পড়াশোনা লইয়াই থাকে। নিজেকে যেন সকলের চাইতে স্বতন্ত্র মনে হয়। ভালোও লাগে না। এই ছোট গণ্ডির মধ্যে সামান্য কয়খানা পাঠ্য-পুস্তক নাড়াচাড়া করিয়া দিন কাটানো, আর পরীক্ষার শেষে গোটাকয়েক নম্বর বেশী পাওয়ার মধ্যেই কি জীবনের সার্থকতা?
দূর-দূরান্তরের দেশ হইতে কে যেন হাতছানি দিয়া ডাকে–কোথায় সেই অগাধ সমুদ্র, তুষারকিরীট পর্বতমালা, বিচিত্র ভাষাভাষী মানবগোষ্ঠী, জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্মভূমি, সভ্যতা আর সৌন্দর্যের লীলানিকেতন–বিশাল পৃথিবী–বিরাট জগৎ–এতটুকু একটা ঘরের মধ্যে নিজেকে আটকাইয়া রাখিবার জন্যই কি মানুষের সৃষ্টি?
কিন্তু অপেক্ষা করিতে হইবে, আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই, বিশ্বের দরবারে যে এখনও নিতান্তই নাবালক সে।