রাজলক্ষ্মী আর একবার চোখ মুছিবার জন্যে কথা থামাইতেই বুলু তাড়াতাড়ি একটা প্রণাম ঠুকিয়া–’দেরি হয়ে যাচ্ছে পিসিমা’–বলিয়া ব্যস্ত হইয়া ওঠে। ওসব কথার আলোচনা তাহার পক্ষে অস্বস্তিকর।
কিন্তু রাজলক্ষ্মীর যেন আর অন্য চিন্তা নাই, অন্য কথা নাই। নিজে ভুলিতে পারেন না বলিয়াই বোধ করি অপর কাহাকেও ভুলিতে দেন না। অথচ ভুলিয়া যাওয়াই সব চাইতে ভালো ছিল না কি!
.
ট্রেন ছুটিতে থাকে। বুলুকে ঘুমাইবার পরামর্শ দিয়া, সরকার মশাই নিজে নাক ডাকাইতে শুরু করেন–আর খোলা জানলার বাহিরে নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলিয়া বিনিদ্র বুলু বসিয়া থাকে। বসিয়া বসিয়া কি ভাবে কে জানে!
কৈশোর কাল–স্বপ্ন দেখিবার কাল। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্ন, নিজেকে রচনা করিবার দুরন্ত ইচ্ছার উদ্দাম স্বপ্ন–আবহমান কাল হইতে পৃথিবীর সমস্ত কিশোরচিত্ত যে বেদনাময় আনন্দের স্বপ্ন দেখিয়া আসিতেছে তাহার স্বপ্ন।
আসিবার সময় পিসিমা এমন একটা কথা বলিয়া বসিলেন–অদ্ভুত! এদিকে নিজেই তো ‘ধর্মসাক্ষীটাক্ষী’ কত কি বলিলেন! ফেরত দিবার উপায় নাই’ ‘বদলাইবার উপায় নাই’ কত সব কথা! এখন আবার উল্টোপাল্টা কথা শুরু করিয়াছেন!
ধ্যেৎ! দাদু যা করিয়া দিয়া গিয়াছেন–তাহার উপর বুঝি সদারি ফলাইতে আছে? আর এত ভাবনারই বা কি দরকার? বুলুর বুঝি লেখাপড়া নাই? কলিকাতার পড়া সাঙ্গ করিয়া বুলু বিলাত যাইবে না যেন!
কলিকাতায় আসিয়া কলেজে ভর্তি হইল বটে, কিন্তু প্রথমটা কিছুতেই মন বসাইতে পারিত না বুলু। তাহার সদ্য শোকাহত উদভ্রান্ত মনের অবস্থায় সহপাঠীদের হৈ-হুঁল্লোড়, অকারণ হাসি, অর্থহীন গল্প নিতান্ত বাজে আর বিশ্রী লাগিত। সকলের সঙ্গে মেলামেশা করার মত সপ্রতিভ নয় যে, কাজেই মনমরা ভাবে আপনার লেখাপড়া লইয়া একপাশে কাটাইয়া দিত।
কিন্তু বয়সটা যোলো আর জায়গাটা ছাত্রাবাস। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিয়া একপাশে পড়িয়া থাকা বেশীদিন সম্ভব নয়। প্রবল বন্যার আকর্ষণে কে কতদিন অটল থাকিতে পারে? আসন্ন যৌবনের সোনার কাঠি ঘুমন্ত মনকে নাড়া দিয়া জাগাইয়া তোলে, চিত্ত শতদলের এক একটি দল বিকশিত হইতে থাকে, উন্মুখ হৃদয় বিরাট বিশ্বকে আপনার ভিতর গ্রহণ করিতে চায়। সকলকে ভালোবাসিতে ইচ্ছা হয়, সকলকে আপনার মনে হয়–অকপট সরলতায় ধীরে ধীরে ধরা দেয় বুলু।
দলের মধ্যে সুকুমার নামক ছেলেটিই চাই। সদাহাস্যময় কৌতুকপ্রিয় এই ছেলেটিকে প্রত্যেকেই ভালোবাসে, বলিতে গেলে বুলু তো তার প্রেমমুগ্ধ ভক্ত। কিন্তু সুকুমারই একদিন তাহার মাথা খাইয়া বসিল।
বুলু তখন ধরে অনুপস্থিত, কি একটুকরা কাগজ লইয়া হাসির বান ডাকিয়াছে ঘরে। উপলক্ষ্যটা যে বুলুসেটা একটু লক্ষ্য করিলেই বোঝা যায়।
বেশ কিছুক্ষণ হুল্লোড়ের পর রঙ্গমঞ্চে বুলুর অবির্ভাব ঘটে। সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা প্রচণ্ড হাসির রোল। বুলুও হাস্মুখে প্রশ্ন করে-কি হল হঠাৎ?
–আর কি হল! রমেন চশমার ভিতর হইতে চোখ পাকাইয়া বলে–কি বাবা ভালো ছেলে, ডুবে ডুবে জল খেতে শিখেছ! উঃ, আমরা ভাবি কি ইনোসেন্ট!
–তা হঠাৎ এমন কি প্রমাণ পেলে আমার বিরুদ্ধে? বুলু প্রশ্ন করে।
সুকুমার বাঁকা হাসির সঙ্গে বলে, আমরা কি জানতে পারি ‘তাপসী’ নাম্নী ভদ্রমহিলাটি কে?
–তাপসী?
আর কিছুই বলে না বুলু, কিন্তু চমকানিটা সুস্পষ্ট।
নিত্য নতুন ফন্দী আঁটিয়া আশেপাশে সকলকে ক্ষেপানো সুকুমারের একটা বিশেষ শখ। সহপাঠীদের তো বটেই, প্রফেসারদেরও ছাড়িয়া কথা কহে না সে। মাঝে মাঝে তাদের নাকালের এক শেষ করিয়া ছাড়ে। সুকুমার যখন বুলুর খাটের তলা হইতে একখানা লেটার প্যাডের পাতা কুড়াইয়া আনিয়া এত হাসাহাসি জুড়িয়া দিয়াছিল, রমেন দিলীপ পরেশ শিবনাথ প্রভৃতি সকলেই ভাবিয়াছিল এটা সুকুমারের নূতন কীর্তি। পরের হাতের লেখা নকল করিবার একটা বিশেষ ক্ষমতা সুকুমারের আছে কিনা।
কাগজখানার একটা পিঠ ভর্তি শুধু একই নাম লেখা–ইংরাজী, বাংলা, টানাহাতের মুক্তাক্ষর। আবার সবগুলির উপর হিজিবিজি আর বড় বড় করিয়া লেখা একটি নাম–তাপসী তাপসী–তাপসী!
কিন্তু বুলুর চমকানিটা যে নিতান্তই সন্দেহজনক।
–হ্যাঁ হ্যাঁ তাপসী, যাঁর নামের জপমালা তৈরী হয়েছে। চিনতে পারেন হাতের লেখাটা? রমেন সোৎসাহে প্রশ্ন করে।
চিনিতে দেরি হয় না। একটা ফাউন্টেন পেন কিনিয়া আনিয়া নিবটার গুণাগুণ পরীক্ষার্থে বার বার এই নামটাই লিখিয়াছিল বুলু লেটার প্যাডের পাতা ভর্তি করিয়া–কাল কি পরশু ঠিক স্মরণ নাই।
বুলুর অবশ্য আগের চাইতে উন্নতি হইয়াছে, তাই ধাতস্থ হইতে দেরি লাগে না। লজ্জায় লাল হইয়া পড়িয়া অপ্রতিভও হয় না। কাগজখানার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াই অবহেলাভরে বলিয়া ওঠে–ওঃ, এই! আমি ভাবলাম না জানি আমার বিরুদ্ধে কি ভয়ানক সব প্রমাণপত্র যোগাড় করেছিস! নতুন পেনটার নিবটা পরীক্ষা করতে আজেবাজে একটা নাম লিখছিলাম বটে কাল!
সুকুমার সন্দিগ্ধভাবে বলে–বলি হে বাপু, এত নাম থাকতে হঠাৎ এই নামটিই বা নির্বাচিত হল কেন?
–যা হোক কিছু–যে কোনো একটা নাম লিখলেই তোমরা তা থেকে সূত্র আবিষ্কার করতে বসতে, ওর আর কি! ধরোযদি ওর বদলে ক্ষ্যান্তকালী’ লিখতাম!
–তাই বা লিখবে কেন? পরেশ গম্ভীরভাবে বলে আমাদের আদরের প্রাণকেষ্টর নাম লিখতে পারতে!