.
শেষ পর্যন্ত রাজলক্ষ্মী বেশ কিছু ভণিতা করিয়া একখানি চিঠি লিখিয়া সরকার মশায়ের হাতে পাঠাইয়া দেন এবং বৌ আসার আশা আর আশঙ্কায় ঘণ্টা গুনিতে বসেন।
কিন্তু আশার জয় হইল না, হইল আশঙ্কার। সরকার মশাই ফিরতি ট্রেনেই ফিরিয়া আসিলেন। বলা বাহুল্য একলা। আসিয়া নূতন কুটুম্ব সম্বন্ধে এমন মন্তব্য প্রকাশ করিলেন, যেটা শ্রুতিমধুরও নয়, খুব বেশী সম্মানসূচকও নয়। কেবলমাত্র আশাভঙ্গের মনস্তাপে নয়–অপমানের জ্বালায় রাজলক্ষ্মী যা মুখে আসিল তাই বলিয়া গালি দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত একটা কটু দিব্যির সঙ্গে বলিয়া বসিলেন– থাকুক ওরা মেয়ে নিয়ে। দেখব কান্তি মুখুজ্জের নাতির আর বৌ জুটবে কিনা, বুলুর আমি আবার বিয়ে দেবই দেব।
নিজের পড়ার ঘরে বসিয়া সব কিছুই শুনিল বুলু, কিন্তু তাহাকে আর কেহ কিছু জ্বালাতন করিল না। নিজে হইতে তার আর বলিবার কি আছে? শুধু একবার মনে করিতে চেষ্টা করিল-সরকার মশাইয়ের পিছু পিছু আর একটা মানুষ ঢুকিলে লাগিত কেমন!
মানুষ না ছবি? দাদুর ঘরে একখানা বীণাবাদিনী সরস্বতীর ছবি আছে, ঠিক সেই ধরনের দেখিতে নয় কি? অবশ্য সেই অদ্ভুত রাত্রের কথা প্রায় কিছুই মনে পড়ে না, মনে করিতে গেলেই দিনের আলোয় দেখা একখানা ঝকঝকে জরিদার লাল শাড়ীমাত্র চোখের উপর ভাসিয়া ওঠে। ভাবিতে গেলে বল্লভজীর মন্দিরের ছায়াটাই শুধু চকিতের মত মনে পড়িয়া যায়।
খানিকটা:আলো আর খানিকটা অলৌকিকত্ব।
তাছাড়া আর কি?
.
শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটিয়া গেলে কলিকাতায় রওনা হইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল বুলু, কিন্তু রাজলক্ষ্মী দেশের বাড়ী ছাড়িয়া যাইতে রাজী হইলেন না। কেন কি দরকার তার কলিকাতায়? বুলু নাকি হোস্টেলে থাকিয়া পড়াশোনার ব্যবস্থা করিতেছে, তবে? কিসের দায় রাজলক্ষ্মীর যে গোটাকতক ঝি-চাকর লইয়া সেই বৃহৎ বাড়ীখানা আগলাইয়া পড়িয়া থাকিবেন? কি ছাই আছে কলিকাতায়? এ তো তবু ভালো কিছু না হোক ‘বল্লভজী’র মন্দিরটায় দু’দণ্ড বসিলেও মনটা ভালো থাকিবে। রাণীগঞ্জে ফিরিবার প্রয়োজনও ফুরাইয়াছে। মামার সেবার জন্যই কতকটা, তাছাড়া কতকটা বুলুর জন্যও বটে, সর্বত্রই মামার সঙ্গে থাকিয়াছেন, আজ সব দিক দিয়াই মুক্তি।
মাতৃহীন শিশু এখন তো স্বাবলম্বী বীরপুরুষ হইয়া উঠিয়াছে–আর মামা নিজে তো দিব্যি নিজের পথ বাছিয়া সরিয়া পড়িলেন। অতএব রাজলক্ষ্মীরও এবার কর্তব্য ফুরাইয়াছে।
তবে হ্যাঁ, স্বাভাবিক নিয়মে যদি সংসারটা চলিত সে আলাদা কথা। পড়ুক না বুলু হোস্টেলে থাকিয়া, পড়ার যদি অসুবিধাই হয় তাহাতে রাজলক্ষ্মী কি আর বাধা দিবেন? এমন অবুঝ নন তিনি। ছেলে মূর্খ হইয়া কোলজোড়া করিয়া থাকুক এ সাধ তাহার নাই, কিন্তু বৌটিকে কাছে আনিয়া রাখিবার সাধ কি খুব বেশী অসঙ্গত? কত আদরে স্নেহে মমতায় সর্বদা কাছে কাছে রাখিয়া সকল বিষয়ে সুশিক্ষিত করিয়া তুলিতেন তাহাকে। তারপর যার সংসার তার হাতে। তুলিয়া দিয়া ছুটি লইতেন। বুলুর মা’র পরিত্যক্ত গৃহস্থালি কুড়াইয়া লইয়া কিসের আশায় আগলাইয়া বসিয়া আছেন এতদিন? বুলুর বৌয়ের হাতেই তুলিয়া দিবার সুদূর আশা লইয়া নয় কি?
বৌটি এখানে থাক–ছুটিছাটা পাইলেই বুলু এক-আধবার বাড়ী আসুক। হইলই বা ছেলেমানুষ, কিন্তু সত্যকার ভালোবাসিবার বন্ধুত্ব করিবার নিবিড় সখ্যতায় অন্তরঙ্গ হইবার বয়স তো এই। নব পরিণয়ের মাধুর্য উপভোগ করিবার অবকাশ তো এখনই লজ্জা সঙ্কোচ কুণ্ঠার আড়ালে।
বঞ্চিত নারীহৃদয়ের ঔৎসুক্য লইয়া-কল্পনায় অনেক মধুময় ছবি আঁকিতে বসেন রাজলক্ষ্মী এই কিশোর দম্পতিকে কেন্দ্র করিয়া, কিন্তু ছবি সম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার ভাগ্য রাজলক্ষ্মীর নয়। বারে বারে তাই উজ্জ্বল রঙের তুলি বিবর্ণ হইয়া আসে। আর তাপসীর উপর রাগে ব্রহ্মার জুলিতে থাকে।
অবশ্য তাপসীর আর দোষ কি, দোষ তার বাপ-মার। ভারি পয়সা মণীন্দ্র বড়য্যের, তাই ধরাকে সরা দেখিতেছে! মুখে উচ্চারণ করিলে শুনিতে খারাপ, তা নয়তো বুলুর পয়সায় বুলু অমন দশটা মণি বাঁড়য্যেকে চাকর রাখিতে পারে। ছেলের শীঘ্রই আবার বিবাহ দিবার সংকল্পটা এ রকম সময় খুব প্রবল হইয়া ওঠে, কিন্তু তাপসীর মুখোনি মনে পড়িলেই যেন সংকল্প শিথিল হইয়া যায়।
সেকালের রাজপুত্রেরা যেমন বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধার করিয়া আনিত-তাপসীকে তেমনি উদ্ধার করিয়া আনা যদি সম্ভব হইত বুলুর পক্ষে!
যাক, মনে মনে মানুষ কত কিই ভাবে, বাস্তবক্ষেত্রে তো দাম নাই সে সব কথার। যে কথার দাম আছে সেই কথাই কহিতে হয়।
বুলুর কলিকাতা যাইবার মুখে তাই রাজলক্ষ্মী তাহাকে ডাকিয়া সাবধান করিয়া দেন–দেখ বাপু, একটি কথা বলে রাখছি–কোনো ছলে কোনো উপলক্ষ্যে ওদের বাড়ীর ছায়াটি মাড়াবে না!
অন্যমনা বুলু ফস করিয়া প্রশ্ন করে, কাদের বাড়ী পিসিমা?
–কাদের আবার, তোর ওই গুণধর শ্বশুর মশাইয়ের! এখন তো অগ্রাহ্য করে মেয়ে নিয়ে চলে গেল, যেন কোনো সম্বন্ধই নেই! শেষে পস্তাতে হবে–তখন যে টুপ করে ওখানে থেকে যাওয়া-আসা করিয়ে জামাইটিকে বশ করে নেবেন তা হতে দিচ্ছি না!
–ধ্যেৎ! পিসিমার যত্ত সব ইয়ে! বশ আবার কি? যাচ্ছে কে?
রাজলক্ষ্মী মুচকি হাসিয়া বলেন–তা কি জানি, টুকটুকে বৌ হয়েছে, তোর যদি শ্বশুরবাড়ী যাবার মন হয়, তাই সাবধান করে দিচ্ছি। তোর পড়াশুনো শেষ হওয়াটা পর্যন্ত দেখব, খোশামোদ করে মেয়ে পৌঁছে দেয় তো ভালো কথা–নচেৎ আবার তোর বিয়ে দেব আমি। কি বলব- মামা নেই তাই, নইলে এখুনি ওদের নাকের সামনে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে বৌ ঘরে তুলতাম, ওর মেম-ফ্যাশানী মা মেয়ে নিয়ে বসে বসে দেখত। মামা অসময়ে চলে গিয়ে–