বীরদর্পে স্বামী নামক পোষা প্রাণীটির উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়। যদিও মণীন্দ্র সব বিষয়েই। চিত্রলেখার রীতিমত অনুগত, সাদাকে কালো এবং কালোকে সাদা বলিতেও আপত্তি দেখা যায় না তার–যদি চিত্রলেখা সন্তুষ্ট থাকে–কিন্তু এক্ষেত্রে হঠাৎ এমন একটা কথা বলিয়া বসিলেন। যেটা সম্পূর্ণ বেসুরো। বলিলেন–কিন্তু সত্যি এত যখন ইচ্ছে হয়েছে ওদের হয় গেলই!
তিন ছেলেমেয়ে যে এইমাত্র অনেক হতাশামোদের ঘুষ দিয়া উকিল লাগাইয়া গিয়াছে। তাঁকে–সেটা আর প্রকাশ করেন না।
চিত্রলেখা অবাক হইয়া বলে–না হয় গেলই! তোমাকে মাথার চিকিৎসা করানো বিশেষ দরকার হয়েছে দেখছি। এই গরমে ওরা যাবে সেই পচা পুকুরে চান করতে?
মণীন্দ্র হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–পচা পুকুরে চান করতেই বা যাবে কেন? আর মা তাই করতে দেবেন কেন? তবে গরম যদি বল–বাঙলা দেশের পাড়াগাঁ খুব যে–
–থাক হয়েছে, তোমাকে আর পল্লীগ্রামের হয়ে ওকালতি করতে হবে না, কিন্তু হঠাৎ তোমার ছেলেমেয়েদের এত দেশ-প্রেম উথলে উঠল কেন, সে খোঁজ রেখেছ?
মণীন্দ্র উড়াইয়া দিবার ভঙ্গীতে বলিলেন–ছেলেমানুষের আবার কারণ-অকারণ, মা’র মুখে গল্প-টল্প শুনে থাকবে হয়তো
–থাক যথেষ্ট হয়েছে, তুমি আর বালক সেজো না। কিন্তু আমি এই বলে রাখছি, আমার ছেলেমেয়েদের কানের কাছে দিনরাত ওই সব বিষমন্তর ঝাড়তে দেব না আমি। ছেলেরা আজকাল আমাকে গ্রাহ্য করে না তা জানো?
-ওটা এ বংশের ধারা, বুঝলে? বলিয়া মণীন্দ্র হাসিতে থাকেন।
এরকম ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় কার না গা জ্বালা করে?
চিত্রলেখা বিরক্তভাবে বলে–তোমাদের বংশের ধারা শোনবার মত সময় আমার নেই, কিন্তু জেনো–ছেলেমেয়েদের অসুখ করলে সে দায়িত্ব তোমার আর তোমার অপরিণামদর্শী মা’র।
–ছি ছি, অসুখ করবে কেন?
–না, অসুখ করবে কেন! চিত্রলেখা বিদ্রূপহাস্যে মুখ বাঁকাইয়া বলে–বাগানের আম খেয়ে মোটা হয়ে আসবে।
–আমের কথা যদি বললে–মণীন্দ্র হাসিতে হাসিতে বলেন–ছেলেবেলায় আমিও খুব…ও তুমি বুঝি আবার ওসব পেঁয়োমি পছন্দ করো না? তবে সত্যি, এ সময় মোটা হয়ে যেতাম।
–বেশ তো, তুমিই বা বাকি থাকো কেন? যাও না অমন দাওয়াই রয়েছে যখন, আমাকে সেজকাকার কাছে মুসৌরী পাঠিয়ে দিয়ে চলে যেও। টনিকের বদলে আম-কাঁঠাল-মন্দ কি?
মণীন্দ্র সন্ধির সূরে বলেন–এটা তোমার রাগের কথা, কিন্তু একবার সকলে মিলে দেশে গেলেই বা মন্দ কি চিত্রা?
সত্য বলিতে কি, ছেলেমেয়েদের উৎসাহের বাতাসে মনের মধ্যে কোথায় একটু স্নিগ্ধ সুর বাজিতেছিল, মায়ের জন্য একটু সহানুভূতি। কিন্তু চিত্রলেখা কি ধার ধারে এ সুরের?
–সকলে মিলে মেন্টাল হসপিটালে গেলেই বা মন্দ কি? বলিয়া বিদ্রূপ হাস্যে মুখ ঘুরাইয়া উঠিয়া যায় চিত্রলেখা।
মণীন্দ্র নিঃসন্দেহ হন। মুসৌরীই তাহাকে যাইতে হইবে। চিত্রলেখার পূজনীয় সেজকাকার আশ্রয়ে না হোক, কাছাকাছি। কারণ চিত্রলেখার বাপের বাড়িতে এই সেজকাকাটির কাছে আর সকলেই নিষ্প্রভ, তাই জ্যোতি যদি বিকীর্ণ করিতেই হয় তবে সেজকাকীমার চোখের উপর করিতে পারাই চিত্রলেখার পক্ষে চরম সুখ।
ছেলেমেয়েদের জন্য একটু মন কেমন করে মণীন্দ্রর। এত উৎসাহে জল ঢালিয়া দিবেন? তাছাড়া ছুটিতে বেড়াইতে গিয়া ‘সেজকাকাদের বাড়ির আওতায় থাকা? সেবারে দার্জিলিং গিয়া কি বিড়ম্বনা! উঠিতে বসিতে মায়ের কাছে সেজকাকার বাড়ির আদর্শের খোঁটা খাইতে খাইতে আধখানা রোগা হইয়া গেল ছেলেমেয়েগুলো। মায়ের সেই খুড়তুতো ভাইবোনদের মত কায়মনোবাক্যে সভ্য’ হইবার যোগ্যতা তাদের কই? উপরের খোলসটা খুলিয়া ফেলিলেই আসল চেহারা বাহির হইয়া পড়ে যে– সেজকাকাদের চাইতে হেমপ্রভার সঙ্গেই যার অধিক মিল।
শাশুড়ীর উপর এত বিষদৃষ্টি চিত্রলেখার কি সাধে?
ছেলেমেয়েদের মনের মত করিয়া মানুষ করিবার সাধ যে মিটিল না, হেমপ্রভার জন্যই নয় কি? কুসংস্কার আর কুদৃষ্টান্তের পাহাড় হইয়া বসিয়া আছেন চিত্রলেখার স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার পথ জুড়িয়া। স্বাস্থ্যটা হেমপ্রভার আবার এমনি অটুট যে দূর-ভবিষ্যতেও কোন আলোকরেখা খুঁজিয়া পায় না চিত্রলেখা, বরং নিজেরই তার বারো মাসে দুইবেলা টনিক না খাইলে চলে না।
নিতান্ত অর্থনৈতিক কারণেই সহিয়া থাকা, তা নয়তো বিধবা মানুষের পক্ষে কাশীর মত উপযুক্ত স্থান আর কোথায়? মনে পড়িলেই স্ত্রৈণ শ্বশুরের উপর মন বিরক্তিতে ভরিয়া যায় চিত্রলেখার।
.
শেষ পর্যন্ত কিন্তু ছেলেমেয়েদের জেদই বজায় থাকিল।
অবশ্য চিত্রলেখা মুসৌরী চলিয়া গেল। বাধ্য হইয়া মণীন্দ্রকেও যাইতে হইল। না যাইলে যে কি হইতে পারে সে কথা ভাবিবার সাহস মণীন্দ্রর নাই। শুধু মাকে ও ছেলেমেয়েদের পাঠাইয়া দিবার জন্য কয়েকটা দিন পরে গেলেন।
চিত্রলেখার ছেলেমেয়েরা মাকে কতটা ভয় করে আর কতটা ভালবাসে সে বিচার করা সহজ নয়, তবে আপাততঃ দেখা গেল মায়ের অনুপস্থিতিটা তাদের কাছে প্রায় উৎসবের মত। নিজেদের ট্রাঙ্ক সুটকেস গুছাইয়া লওয়ার মধ্যে যে এত আমোদ আছে, একথা কি আগে জানা ছিল? চিত্রলেখা অতটা না চটিলে হয়তো এদিকস্টার তদারক করিয়া যাইত, কিন্তু রাগ-অভিমানের একটা বাহ্যিক প্রকাশ চাই তো!
তাপসী বড়, অতএব ম্যানেজমেন্টের দায়টা তার, সে ভাইদের পোশাক-পরিচ্ছদের বহুবিধ ব্যবস্থা এবং অনেক উপদেশ বর্ষণান্তে পিতার কাছে আসিয়া একটা অদ্ভুত আবদার করিয়া বসিল। মণীন্দ্রর পিতার আমলের একটা পুরানো দেরাজ–যেটা জাতিচ্যুত অবস্থায় ভাঁড়ার ঘরে ঠাঁই পাইয়াছে–তার চাবিটা চাই তাপসীর।