কিন্তু নিজের গুরুদায়িত্ব সম্বন্ধে যতই অবহিত হোক বুলু, তবু পিসিমার কথার না দিল উত্তর, না তুলিল মুখ। রাজলক্ষ্মী আর একবার বলেন–ওরা শুনছি কলকাতায় চলে গেছে। খুবই অভদ্রতা হয়েছে ওদের এটা, তবু আমাদের কর্তব্য আমাদের কাছে। আমি সরকার মশাইকে বলে সব ঠিক করিয়ে দিচ্ছি, কাল সকালের ট্রেনে তুমি চলে যাও সরকার মশাইয়ের সঙ্গে, বুঝলে? একটা দিন কলকাতার বাড়ীতে থেকে একেবারে পরশু বৌমাকে নিয়ে ফিরবে।
এতক্ষণে বুলু কথা বলে, বলে বেশ সজোরে মাথা নাড়িয়া-ও সব আমি পারব না–চিনি না, কিচ্ছু না।
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–চিনতে তো হবে! নাকি হবে না? তোকে কিছুই বলতে কইতে হবে না বাপু, শুধু লোক-দেত্তা একবার গিয়ে দাঁড়াবি, যা বলবার সবই সরকার মশাই বলবেন।
–সরকার মশাই নিজেই যান না তবে!
–না রে বাপু, তা হয় না। এ সব সমাজ-সামাজিকতার ব্যাপার, যা নিয়ম তা করতেই হয়! তোমার দায় যখন
–হ্যাঁ দায়! ভারি একেবারে ইয়ে–আমাকে কেউ চেনে বুঝি?
–নাঃ, এ ছেলেটা অচেনার ভয়েই সারা হলো দেখছি! ওরে বাপু, এই সূত্রে চেনা-পরিচয় করে নেওয়াটাও তো হবে! হুট করে কাজটা হয়ে গেছে, মেয়ের মা-বাপ জানতে পারেনি, ব্যাপারটা তো একটু জগাখিচুড়ি মতনই হয়ে রয়েছে, পরিষ্কার করা দরকার নয় কি? অবিশ্যি নিন্দে আমি ওদের করবই–যতই হোক মেয়ের পিতামহী যখন নিজে বসে সম্প্রদান করেছেন, তখন মা-বাপের আর বলবার কি আছে? তাছাড়া হিঁদুর মেয়ের বিয়ে, ফিরিয়ে দিতে পারবি না তো? এদিকে এই এত বড় বিপদ ঘটে গেল, উদ্দিশ নেই, কিছু নেই, মেয়ে নিয়ে গট গট করে চলে গেলি! মেয়েই নয় তোদের মস্ত দামী বুঝলাম, কিন্তু আমাদের ছেলেই বুঝি ফেলনা?
বলা বাহুল্য রাজলক্ষ্মী দেবী যে উপযুক্ত শ্রোতা ভাবিয়াই বুলুকে এসব কথা শোনাইতে বসিয়াছেন তা নয়, বুলু উপলক্ষ্য মাত্র, নিজের মনের বিরক্তিটাই প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গীতে প্রকাশ করিতে থাকেন তিনি।
বকিতে বকিতে তিনি সরকার মশাইকে ডাকিতে পাঠাইবার উদ্যোগ করিতেই বুলু মরীয়া হইয়া বলে–পিসিমা, ও সব কিছু করতে-টরতে হবে না। সত্যিই নয় কিছু, শুধু শুধু–
পিসিমা সন্দিগ্ধভাবে বলেন–কি সত্যি নয়?
–ওই তো ওই সব সুকুমার লাবণ্যময় মুখ লজ্জায় লাল হইয়া ওঠে বুলুর।
তবু পিসিমা বুঝিয়া উঠিতে পারেন না। অথবা না বোঝার ভান করেন হয়তো। বলেন—’কি সব’–তাই খুলে বল না বাপু? না বললে বুঝব কি করে?
বুলু সবেগে মাথা নাড়িয়া বলিয়া ওঠেনাঃ, তুমি কিছু বুঝতে পারো না–সব বাজে কথা–বোঝো না বই কি!
–পারলাম না, রাজলক্ষ্মী হতাশ ভঙ্গীতে বলেন–না পারলে উপায় কি বল? ‘ওই সব’ ‘সেই সব’ বোঝ আমার কর্ম নয়।
–আঃ বাবারে! সেদিন যা সব কাণ্ড হল মোটেই কিছু সত্যি নয়, দাদু শুধু শুধু কেন যে আমাকে–সহসা দাদুর নাম মুখে আসিতেই অভিমানে বেদনায় নীল আকাশের মত উজ্জ্বল চোখ দু’টি আসন্নবর্ষণ মেঘের ছায়ায় গভীর কালো হইয়া আসে। এক ঝাঁপটা শীতল বাতাসের অপেক্ষা, ঝরিয়া পড়িতে বিলম্ব হইবে না।
‘দাদু’ ‘দাদু’! যে নাম তাহার অস্থিতে মজ্জায় শিরায় শোণিতে একাকার হইয়া মিশিয়া আছে সে নামের অধিকারী যে আজ ত্রিভুবনের কোনখানে নাই একথা বিশ্বাস করা কি সহজ! বিশ্বাস করিবার মত করিয়া তলাইয়া ভাবিতে বসাও তো সম্ভব নয়! দাদু নাই’ একথা মনে মনে উচ্চারণ করা মাত্রই যে মাথার মধ্যে কেমন একটা প্রবল আলোড়ন হয়, দুই চোখ ঝাঁপসা হইয়া। আসে! ছুটিয়া গিয়া ধরিয়া আনা যদি সম্ভব হইত! শোক কি দুঃখ তা বুঝিতে পারে না বুলু, মনে হয় রাগ। হা, রাগই হয় তার দাদুর উপর। বুলুকে এমন ভাসাইয়া দিয়া দিব্য কোথায় গিয়া বসিয়া রহিলেন–বুলু এখন করে কি?
শুধু কি বিষয়-সম্পত্তি, কোলিয়ারির হিসাবপত্র, অথবা বুলুর নিজের ভবিষ্যতের ভাবনা? আর একটা কি বিকেল কাণ্ডই না করিয়া গেলেন! সেটা যে ভালোমত করিয়া ভাবিতেও সাহস হয় না। তবু যাই হোক ঘটনাকে কিছু নয়–খেলা” গোছের ভাবিয়া লইয়া এই দিন আষ্টেকের মধ্যে ধাতস্থ হইতেছিল বেচারা, পিসিমা আবার নূতন করিয়া ফ্যাচাং তুলিলেন!
‘বুলুর বিবাহ হইয়া গিয়াছে!’
কথাটা শুনিলে বন্ধুরা বলিবে কি? কিন্তু বিবাহটাই কি সত্য? দাদুর মৃত্যুর মত এটাও যেন একটা নিতান্ত অবিশ্বাস্য ব্যাপার, কিছুতেই মনকে মানাইয়া লওয়া যায় না। অথচ একেবারে ভুলিয়া থাকাও কঠিন।
রাজলক্ষ্মীও বুলুর কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আঁচলে চোখ মুছিয়া বলেন–সে কথা সত্যি, শেষটায় মামার যে কি জেদ হল! জানি না ভালো করলেন না মন্দ করলেন! তারাই বা কি রকম মানুষ কে জানে–এই তো যা ব্যবহার দেখালে! তবুও ধর্মসাক্ষী করে বিয়ে যখন হয়ে গেছে বাবা, সত্যি নয়’ একথা তুই বলতে পারিস না। আর তাও বলি– এখনই হাসির কথা হয়েছে, নইলে এন্ট্রেস পাস করে বিয়ে, আগের আমলে খুবই ছিল। …তুই যা বাবা, অমত করলে হবে না। সরকার মশাইয়ের হাতে একটা চিঠি দিয়ে দিই আমি, পাঠিয়ে দেবার কথা জোর দিয়ে বলে দিই। বলতে গেলে আধখানা বিয়ে হয়ে রয়েছে, বৌভাত ফুলশয্যা পর্যন্ত হয়নি-শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে গেলে ওটাও করে নিতে হবে যে!
–ধ্যেৎ! আমি কখনো পারব না! বলিয়া উঠিয়া পালায় বুলু।