–কিছু বলছে না–শুধু বলছে–”ঠাকুমাকে নিতে এসেছি”।
হেমপ্রভা আর প্রশ্ন করিতে সাহস করেন না। ধীরে ধীরে বাড়ী ফেরেন। বাহিরের ঘরে। লালবিহারী বসিয়া ছিল চুপচাপ। হেমপ্রভা আসিয়া দাঁড়াইতেই পায়ের উপর হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ওঠে।
আপাততঃ সত্য খবর গোপন করিয়া মণীন্দ্রর সাংঘাতিক অসুখের ছুতায় হেমপ্রভাকে লইয়া যাইবার সংকল্পে মনে মনে কত কথা সাজাইয়া আসিয়াছিল, কিছুই বজায় রাখিতে পারে না, মেয়েমানুষের মত বিলাপ করিয়া কাঁদিতে থাকে।
নাঃ, সন্দেহের আর অবকাশ নাই। হেমপ্রভার জন্য চরম দণ্ডাজ্ঞা উচ্চারণ করিয়া গেল মণীন্দ্র। অপরাধের ভারে ভারাক্রান্ত হেমপ্রভা নিজেই তো নিজের জন্য নির্বাসন দণ্ড বাছিয়া লইয়াছিলেন, তবুও তৃপ্তি হইল না তাহার? আরো শাস্তির প্রয়োজন হইল?
কাঁদিলেন না, মূৰ্ছা গেলেন না, কাঠের মত বসিয়া রহিলেন হেমপ্রভা, দেওয়ালে পিঠ ঠেসাইয়া।
অনেকক্ষণ কঁদিয়া লালবিহারী নিজেই স্থির হইল। চোখ মুছিয়া বলিল–আমার সঙ্গে যেতে হবে যে ঠাকুমা!
–যেতে হবে? হেমপ্রভা চমকিয়া উঠেন, কার কাছে লালবিহারী?
–মা’র কাছে, খোকা-খুকীদের কাছে, আমাদের কাছে। আপনি না গেলে আমরা কোথায় দাঁড়াব ঠাকুমা!
হেমপ্রভা এক মিনিট চুপ থাকিয়া বলেন–বৌমা কি আমাকে নিয়ে যেতে তোমায় পাঠিয়েছে লালবিহারী?
লালবিহারী টেক গিলিয়া বলে–তার কি আর মাথার ঠিক আছে ঠাকুমা? পাঠিয়েছেন বৈকি, তিনিই তো খবর দেবার জন্যে
হেমপ্রভা ম্লান হাসির সঙ্গে বলেন–খবর দিতে বলেছে তা জানি। বলবে বৈকি, সকলের আগে আমারই তো এ খবর পাওয়া উচিত। কিন্তু যেতে আমি পারব না লালবিহারী। বৌমাকে এ মুখ দেখাতে পারব না আমি।
–কিন্তু ঠাকুমা, খোকা-খুকীদের–
–তাদের আর আমি কি করতে পারব লালবিহারী? হয়তো অনিষ্টই করে বসব! সত্য কথা এই চিত্রলেখা শুধু টেলিগ্রাম করিয়া দিবার হুকুম দিয়াছিলেন। লালবিহারী নিজের বুদ্ধি খাটাইয়া: সরাসরি চলিয়া আসিয়াছে।হেমপ্রভার স্থির মুখভাব দেখিয়া আর ভরসা থাকে না তাহার, তবু কাতরভাবে বলে–তাহলে একলা ফিরে যাব ঠাকুমা?
–একলাই তো সবাইকে ফিরতে হবে লালবিহারী!
হেমপ্রভা আর একবার ম্লান হাসেন।
আবার কিছুক্ষণ কাটে। একসময় বলেন–ওঠো লালবিহারী, স্নানটান করো, জল মুখে দাও। লালবিহারী আর একবার হাহাকার করিয়া ওঠে—ও অনুরোধ আর করবেন না ঠাকুমা।
হেমপ্রভা স্থিরস্বরে বলেন–করব বৈকি লালবিহারী, করতে তো হবেই। আমি নিজেই কি এখুনি স্নান-আহার করব না? আজ না পারি, কাল করব।–মণি যখন ‘মা’ বলে আমাকে এতটুকু দয়ামায়া করল না, আমি আবার কোন্ লজ্জায় অভিমান করব, শোক করব?
.
যে বিবাহ ব্যাপারটাকে লইয়া এত কাণ্ড, তাপসী ভিন্ন আরও যে একটি অংশীদার আছে তাহার, সেকথা ভুলিয়া থাকিলেই বা চলিবে কেন? বেচারা বুলুর দিকেও তো একবার চাহিতে হয়! অগাধ অর্থের মালিক হইলেও মাতৃপিতৃহীন অসহায় কিশোর যেদিন জীবনের একমাত্র নির্ভরস্থল পিতামহকে অকস্মাৎ হারাইয়া বসিল, সেদিন সেই অগাধ অর্থের পানে চাহিয়া যে সে কিছুমাত্র ভরসা বোধ করিল, এমন মনে করিবার কারণ নাই।
চারিদিকে চাহিয়া–একটা নিঃশ্বাসরোধকারী গুরুভার অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়িল না তাহার!
স্বপ্নের মত কি যে একটা কাণ্ড ঘটিয়া গিয়াছে সে ছবিও স্পষ্ট মনে পড়ে না। জানিয়া বুঝিয়া বিবাহে অসম্মতি প্রকাশ করিবার মত বয়স তো তাহার নয়ই, তাছাড়া সময়ও ছিল না। ব্যাপারটা যে সত্যই ‘বিবাহ’ এ বোধই কি জন্মিয়াছে ছাই!
বিবাহ এবং ঠাকুর্দার মৃত্যু–দুইটা অপ্রত্যাশিত বস্তু যেন তালগোল পাকাইয়া হঠাৎ হুড়মুড় শব্দে ঘাড়ে পড়িয়া গেল। নিঃশঙ্কে পথ চলিতে চলিতে যেন কোথা হইতে একটা পাহাড়ের চূড়া ঝড়ে উড়িয়া আসিয়া ঘাড়ের উপর ভাঙিয়া পড়িয়াছে!
অপ্রত্যাশিত এত বড় আঘাতটায় মূঢ় বিপর্যস্ত দিশাহারা হইলেও তবু কান্তি মখুজ্জের নাতি সে! দিশাহারা হইলেও কর্তব্যহারা হইল না। শ্রাদ্ধের আয়োজনে ত্রুটিমাত্র ঘটিল না, দানধ্যান, ব্রাহ্মণ-বিদায়, কাঙালী ভোজন উচিত মতই হইল। অর্থবল, লোকবল, অভাব কিছুরই ছিল না, শুধু ইচ্ছা প্রকাশের অপেক্ষা।
নিমন্ত্রণপত্র বিলি করিবার সময় পিসি রাজলক্ষ্মী একবার কথাটা পাড়িলেন। বিবাহ যখন হইয়াছেই, উড়াইয়া দিবার তো উপায় নাই, শ্বশুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া বৌ লইয়া আসুক বুলু। স্বামী-স্ত্রী ‘একঘাট’ করিতে হয় এ কথা আর কোন হিন্দুর সন্তান না জানে? কাজেই তাপসীদের দিক হইতে আপত্তি তুলিবার আর পথ কোথায়?
নিজের পিসি নয় কান্তি মুখুজ্জের দূর সম্পর্কের ভাগিনেয়ী। তবু বুলুর মা মারা যাওয়ার পর বুলুর ভার তিনিই লইয়াছিলেন এবং নিজের পিসির বাড়া হইয়াই চিরদিন এ সংসারে আছেন। কান্তি মুখুজ্জেও কন্যার আদরেই এতদিন আশ্রয় দিয়া আসিয়াছেন তাহাকে। কাজেই বাড়ীর ভিতরকার ব্যবস্থাপনা অথবা লোক-লৌকিকতার বিষয়ে উপদেশ পরামর্শের অধিকার তাঁহারই। বুলুকে নীরব থাকিতে দেখিয়া তিনি ঈষৎ জোরের সঙ্গে বক্তব্যের পুনরুক্তি করেন।
–শোন বাবা, এখন থেকে সবই যখন তোকে মাথায় নিতে হবে তখন কোনো কিছুই তো এড়িয়ে গেলে চলবে না, শুনতে হবে বুঝতে হবে। বৌমাকে না আনলে তো চলবেই না, আনতেই হবে যে!