–আমার বাড়ী? গরীবের বাড়ীর আর কি দেখবে অভীবাবু, তোমার মা শুনলে রাগ করবেন।
-মা তো সর শুনলেই রাগ করেন, ছেড়ে দাও মায়ের কথা। চলো তুমি। গাড়ী চলিতে থাকে।
তাপসী ম্লানমুখে চুপচাপ বসিয়া থাকিতে থাকিতে একসময় বলে–অভী, তুই এদিকে এসে বোস্, আমার ভাল লাগছে না।
ছেলেমানুষের কণ্ঠে এমন শ্রান্তির সুর কেন? অক্ষয় চকিতভাবে বলে–শরীর খারাপ লাগছে বেবিদিদি? বাড়ী ফিরবে?
-না-না, বাড়ী বিশ্রী।
‘বিশ্রী’ হইলেও একসময়ে ফিরিতেই হয় বাড়ীতে।
মণীন্দ্র সহাস্যমুখে বলেন–কী হল তোমাদের? কতটা এগোলো?
–ছাই এগোলো! অমিতাভ বলে–দিদির শুধু মুখেই ওস্তাদি, শিখতে পারলে তো! খোলা জায়গায় গিয়ে তবে তো শিখতে হয়, তা নয়–কি শখ, না কলকাতায় ক’টা কলেজ আছে দেখব!
মণীন্দ্রনাথ চমকিয়া বলেনক’টা কি আছে?
–কলেজ! দু’ বছর পরে কবে পাস করবেন তাই এখন থেকে কলেজ দেখে বেড়াবেন! মা যেমন শাড়ীর দোকান দেখে বেড়ান–কোনটা পছন্দ হয় না, তাই না বাবা?
বাবা কিন্তু কথার উত্তর দেন না, তীক্ষ্ণভাবে একবার স্ত্রীর মুখের পানে চাহিয়া গুম হইয়া বসিয়া থাকেন। কন্যার দর্শন মেলে না। কোথায় সে সরিয়া পড়িয়াছে পাত্তা পাওয়া যায় না।
অমিতাভ বাপের কাছে ঘেঁষিয়া বসিয়া হাসিতে হাসিতে দ্রুতভঙ্গীতে বলিয়া চলে– দিদিটা আজকাল কী বোকাই হয়েছে বাবা! আজ রবিবার তা খেয়াল নেই, কলেজের ছেলে গুনতে বসেছিলেন বাবু! আচ্ছা বাবা, প্রেসিডেন্সী কলেজে কত স্টুডেন্ট আছে? দিদি বলছে এক হাজার! এত ছেলে কোথায় ধরে বাবা?
.
দিন যায়।
এইভাবেই বারে বারে ছোট ভাইয়ের কাছে অপদস্থ হইতে থাকে তাপসী। ছেলেমানুষ অমিতাভ সত্যই অক্ষয়ের কাছে বসিয়া প্রায় হাত পাকাইয়া ফেলে, আর লাইসেন্স পাইবার বয়স আসিতে আরো কতদিন লাগিবে, সনিঃশ্বাসে তাহার হিসাব কষিতে থাকে।
অথচ তাপসী গাড়ীতে উঠিয়াই অনর্থক শুধু এলোমেলো ঘুরাইয়া মারে অক্ষয়কে। কলিকাতার প্রত্যেকটি রাস্তাঘাট, প্রতিটি স্কুল-কলেজ, পার্ক, সিনেমা দেখিয়া বেড়াইবার কি যে। এক বাজে খেয়াল চাপিয়াছে তাহার!
অমিতাভর সঙ্গে তর্কের বেলায় অবশ্য যুক্তি তারও আছে। কলিকাতায় বাস করিয়া যদি কলিকাতার সবকিছু না দেখা হইল তবে আর গাড়ী থাকিয়া লাভ কি? কিন্তু একই জায়গা বার বার দেখিবার স্বপক্ষে আর যুক্তি যোগায় না তার, ছোট ভাইয়ের জেরার মুখে কাঁদিয়া ভাসায়।
চিত্রলেখা এত খবর রাখেন না, রাখেন মণীন্দ্র এবং কেন জানি না মনে মনে শঙ্কিত হইতে থাকেন।
.
বৎসর ঘুরিতে দেরি লাগে না। মণীন্দ্র ভাবিয়া চিন্তিয়া একদিন প্রস্তাব তুলিলেন– এবারে গ্রীষ্মের ছুটিতে মায়ের কাছে কাশী যাওয়া যাক। ছেলেরা তোতা এক পায়ে খাড়া, তাপসী অধীর আগ্রহে চিত্রলেখার মুখপানে চাহিয়া অপেক্ষা করে মা কী রায় দেন, কিন্তু চিত্রলেখা যেন এক ঝটকায় সকলের উন্মুখ চিত্তকে তছনছ করিয়া দিলেন।
–আবার ‘সামার ভেকেশনে’ মা’র কাছে! বলতে লজ্জা করল না তোমার? মুখে আটকাল না? বেশ যেতে পারো, কিন্তু মনে জেনো তার আগে পটাসিয়াম সায়ানাইড খাব আমি। তারপর যা খুশী কোরো তোমরা।
অতএব কথাটা চাপা পড়িয়া যায়।
.
ঢিলে পায়জামা আর হাফশার্ট পরাইয়া মেয়েকে চিত্রলেখা ছেলেদের সঙ্গে সমানভাবে মানুষ করিতে থাকেন আর নিজের বুদ্ধিগৌরবে উত্তরোত্তর আত্মপ্রসাদ অনুভব করিতে থাকেন।
কাটিতে থাকে দিনরাত্রি। সূর্য আর চন্দ্র নিজের নিয়মে আবর্তিত হইতে থাকে। বয়স বাড়িতে থাকে পৃথিবীর–বাড়িতে থাকে মানুষের। রাত্রির যবনিকা দিনের পৃথিবীকে ঢাকিয়া দেয়– মৃত্যুর যবনিকা মানুষকে ঢাকে।
কিন্তু পৃথিবীর জীবনে ঘটে নূতন সূর্যোদয়, ঘটে ঋতুচক্রের আবর্তন। দীর্ঘ অবসরের সুযোগে ফিরিয়া দেখা দেয় ফুলের পাপড়িতে পাপড়িতে রঙের সমারোহ–প্রজাপতির পাখনায় নিত্যনূতন বৈচিত্র্য। ত্রুটিহীন প্রকৃতি দেবীর প্রতিটি কাজ সমাপ্তি-মধুর।
হায়, মানুষ এখানে হার মানিয়াছে। তার জীবনে অবসর নাই, তাই ত্রুটিবহুল জীবনে তার সব কিছুই অসমাপ্ত।
মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবিয়া মণীন্দ্রনাথ যত বেশী পীড়িত হইয়াছেন, তার শতাংশের একাংশও যদি কার্যকরী হইত, তবে হয়তো তাপসীর জীবনের ইতিহাস হইত অন্যরূপ। কিন্তু কিছুই করিতে পারিলেন না মণীন্দ্র, অনেক কিছু পরিকল্পনা মাথায় লইয়া হঠাৎ একদিন চির অন্ধকারের পথে পাড়ি দিলেন।
.
সংসার ত্যাগ করিয়া আসিয়া হেমপ্রভা কাশীবাসিনী হইয়াছিলেন সত্য, কিন্তু এখানেও ধীরে ধীরে কেমন করিয়া যেন গড়িয়া উঠিতেছিল নূতন সংসার। সংসার ভিন্ন আর কি? মানুষই সংসার। যাহারা মুখাপেক্ষী, যাহারা আশ্রিত, তাহাদের জন্য নিজের স্বামী-পুত্রের সংসারের মতই খাঁটিতে হয়, চিন্তা করিতে হয়। হেমপ্রভাকে কেন্দ্র করিয়া এমন একটি আশ্রিতের সংসার গড়িয়া উঠিয়াছিল।
মা-বাপ-মরা যে ছেলে দু’টি স্কুলে যায় তাহাদের আহারের তদ্বির সারিয়া হেমপ্রভা সবে গঙ্গার ঘাটে স্নানে গিয়াছেন, রাঁধুনী বামুনঠাকরুণ ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া কহিল–মা চান হয়েছে? কলকেতা থেকে আপনাকে নিতে এসেছে!
–নিতে এসেছে? সে কি! কে?
–জানি না মা। নাম বললে লালবেহারী
–হ্যাঁ, কলকাতার বাড়ীর সরকার–কি বলছে সে? অজানা একটা আশঙ্কায় বুকটা থর থর করিয়া কাঁপিতে থাকে হেমপ্রভার।