বাহির হইতে মণীন্দ্রকে যতই অনুগত আর পত্নীসব দেখাক, আসলে যে সেটা কত ভুয়ো, চিত্রলেখার মত এমন মর্মান্তিক করিয়া আর কে জানে?
অথচ অদৃশ্য বস্তুর সঙ্গে লড়াই চলে না। মণীন্দ্রর বাহিরের ভঙ্গীটা নিতান্তই আত্মসমর্পণের ভঙ্গী। তাই না এত জ্বালা চিত্রলেখার!
মেয়েকে ‘চৌকস’ করিয়া তুলিবার সাধটা নিজেরই নিতান্ত প্রবল বলিয়া মেয়ের সাধের স্বপক্ষেই রায় দিতে হয় চিত্রলেখাকে। অবশ্য অনেকগুলি শর্তাধীনে নিমরাজী ভাব দেখাইয়া।
সম্মতি দেওয়ার পর আর চুলের ডগা দেখিতে পাওয়া যায় না মেয়ের। মনে হয় যেন হাওয়ায় ভাসিতেছে।…যাক মন্দের ভালো! সবটাই তো বুড়ীর মত, একটা বিষয়েও তবু প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দিয়াছে!
নির্দিষ্ট দিনে বেবি অভী গাড়ীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইতেই অক্ষয় ভালোমানুষের মত পিছনদিকে উঠিয়া বসে। যেন তাহার আর কোনো কাজ নাই, হাত-পা ছড়াইয়া বসিয়া যাইবে।
–ও কি, তুমি ভেতরে বসলে যে? তাপসী সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে।
–কেন, আজ তো তুমি চালাবে, আমার ছুটি!
–বাঃ, আমি তো সবে আজ থেকে শিখব! আমি বুঝি চালাতে পারি?
–ওঃ, তাই বুঝি! আমি ভাবছি বেবিদিদি আজ আমাকে ছুটি দিয়ে দিলে!
ইস্, ভারি তো কাজ, আমি খুব পারি। অমিতাভ সগর্বে চালকের আসনে উঠিয়া বসে এবং স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়া গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে–লাইসেন্স যে নেই, ওই তো হয়েছে মুশকিল!
–এই অভী, দুষ্টু ছেলে–যা ভেতরে বসগে যা, আজকে আমি শিখব। অক্ষয় এসো না লক্ষ্মীটি, এখুনি হয়তো মা’র মত বদলে যাবে!
–বা রে, আমি শিখব না বুঝি? অমিতাভ প্রায় দিদির মতই নাকিসুর তোলে- মেয়েদের তো ভারি দরকার, শুধু শখ! ছেলেদেরই তো5
–আরে তুমি আবার শিখবে কি, তোমার তো সব শেখাই আছে। অক্ষয় হাসিতে হাসিতে স্বস্থানে আসিয়া বসে। বলে–বেবিদিদি এসো।
আগে ‘বেবিই’ বলিত, আজকাল কি ভাবিয়া কে জানে ‘দিদিটা’ যোগ দিয়াছে। অমিতাভ অনিচ্ছামন্থর গতিতে পিছনের সীটে’ এবং তাপসী মহোৎসাহে সামনের ‘সীটে’ উঠিয়া বসে।
–আজ শুধু দেখে নাও মন দিয়ে, বুঝলে? কোন্ দিকে যাব?–কেন, রেস কোর্সে! অমিতাভ ফোড়ন দিয়া ওঠে-ওখানেই তো চক্কর দেওয়ার সুবিধে।
–তা কেন? তাপসী ক্ষীণকণ্ঠে আপত্তি জানায় তার চাইতে এমনি যেদিকে ইচ্ছে–
–হ্যা যেদিকে ইচ্ছে, অমিতাভ পুরুষোচিত তীব্রকণ্ঠে মন্তব্য করে–দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যেতে হবে নাকি? অক্ষয় তুমি দিদির কথা শুনো না, ওর যদি কোনো বুদ্ধি আছে!
–না, কোনো বুদ্ধি নেই, যত বুদ্ধি তোর মাথায় ভরা আছে! তাপসী ঝঙ্কার দিয়া ওঠে–কলকাতার সব কিছুই বুঝি আমরা দেখেছি! এই যে, কলকাতায় ক’টা কলেজ আছে। জানিস? দেখেছিস সব?
–কলেজ? আহা রে! কী একেবারে দ্রষ্টব্য জায়গা! তার চেয়ে বললি না কেন দিদি, কলকাতায় ক’টা গোয়াল আছে তাই দেখে বেড়াই!
তাপসীর কণ্ঠ আবার স্তিমিত হইয়া আসে–গোয়াল আর কলেজ এক হল? খুব তো বুদ্ধি! ম্যাট্রিক দেবার পর আমাকে বুঝি পড়তে হবে না?
–তাই এখন থেকে দরজা চিনে রাখবি? ভাইবোনের বাগবিতণ্ডার অবসরে গাড়ী অনেক দূর অগ্রসর হইতে থাকে।
-এই তো এসে গেল প্রেসিডেন্সী কলেজ! অক্ষয় মন্তব্য করে।
তাপসী চ্যালেঞ্জের সুরে বলে–আচ্ছা অভী, বল্ তো, প্রেসিডেন্সী কলেজে কত স্টুডেন্ট আছে?
–কত? ইঃ, কে না জানে! পাঁচশ’-বলা বাহুল্য দিদির কাছে খাটো হইবার ভয়ে ভাবনা চিন্তার অপেক্ষা না রাখিয়াই উত্তর দিয়া বসে অমিতাভ।
সঙ্গে সঙ্গে ফল ফলে, তাপসী যথেচ্ছ হাসিয়া ওঠে। খুব বলেছিস! আমি বলছি এক হাজার কিংবা দু’হাজার।–এই, এই অক্ষয়, থামাও তো গাড়ীটা, একটু দাঁড়িয়ে থাকলেই তো দেখা যাবে কত ছেলে আসবে! দশটা বাজবে তো এখুনি!
–আজ আর দশটা বাজবে না বেবিদিদি! অক্ষয় ভাইবোনের তর্ককলহটা উপভোগ করিতে করিতে সহাস্যে বলে–আজ যে রবিবার!
রবিবার! রবিবার! ওঃ, তাই তো! এই প্রচণ্ড সত্যটা ভুলিয়া বসিয়াছিল তাপসী! কী আশ্চর্য!
–দিদি এবার পাগল হয়ে যাবে। অমিতাভ গম্ভীর মত ব্যক্ত করে–যা মাথার অবস্থা হচ্ছে দিন দিন! এখন ক্লাস নাইনে পড়েন, এখন থেকেই কলেজ কলেজ’! উনি আবার কলেজে পড়বার সময় হোস্টেলে থাকবেন, জানো অক্ষয়?
–হ্যাঁ, থাকব! বলেছি তোকে?
–বললি না সেদিন! সেই যেদিন তোর গানের মাস্টারমশাই এলেন না, বাগানে চলে। গেলাম আমরা! বললি না?
-হ্যাঁ, সে তো শুধু বলেছি, হোস্টেলে থাকলে বাড়ীর থেকে পড়া ভালো হয়। হয় না অক্ষয়? বাড়ীর মত তো গোলমাল নেই!
–কি করে জানব দিদি? সাবধানে মোড় ঘুরিতে ঘুরিতে অক্ষয় উত্তর দেয়– কলেজেও পড়িনি, হোস্টেলেও থাকি নি
–পড়লে না কেন? অমিতাভ গম্ভীরভাবে বলে–শিক্ষাই জীবনের মূলধন, বুঝলে? অনেক অনেক পাস করলেই উন্নতি করতে পারতে।
অক্ষয় ক্ষুণ্ণভাবে বলে কই আর পড়তে পেলাম ভাই-বাপ-ঠাকুর্দা কাকা সবাই মারা গেল–
তাপসী উৎসুক ভাবে বলে–সবাই মারা গেলে বুঝি পড়া যায় না? খুব মন খারাপ হয়ে যায়?
অক্ষয় হাসিয়া ফেলে–মন খারাপের জন্যে নয় রে দিদি, টাকা লাগে না?
-ওঃ, টাকা! ভারি যেন আশ্বস্তভাবে তাপসী বলে–অনেক অনেক টাকা থাকলে পড়া যায়। তাহলে?
–দিদি তুই থা! অমিতাভ বিরক্তসুরে বলে–এমন বোকার মত কথা বলিস আজকাল, কোনো যদি মানে থাকে! অক্ষয় তার চেয়ে চল বরানগরে। একদিন তোমার বাড়ী দেখিয়ে আনবে বলেছিলে যে–